`আমরা হচ্ছি ভুয়া বীরত্বের গল্প শোনা এমন এক জাতী যারা প্রশ্ন করে না’

আপডেট: অক্টোবর ১৮, ২০২৩
0

ডা . জাকারিয়া চৌধুরী :

সিরাজউদ্দৌলার নামের সাথে জড়িয়ে আছে এ অঞ্চলের স্বাধীন মুসলিম সাম্রাজ্যের সর্বশেষ দুর্ভাগ্য। এর পরতে পরতে বেঈমানি আর বিশ্বাসঘাতকা একটার পর একটা এমন ধারাবাহিক ভাবে সজ্জিত, এত নিখুত যে কিছুতেই বিশ্বাস হতে চায় না এসব ঘটনার প্রতিটি বাক্য, প্রতিটি শব্দই সত্য। পুরাঘটিত অতীতের জ্বলজ্বলে ইতিহাস। নাটক সিরাজউদ্দৌলা সিকান্দার আবু জাফরের এক অমর কীর্তি। এর প্রতিটা বাক্য কি অসম্ভব শক্তিশালী! বুকের ভেতরে শেল হয়ে বিধে যেন। এ নাটকটি সর্বপ্রথম এবং সর্বশেষ পড়ি ৯৬-৯৭ সালের দিকে। সেখানে আলেয়া চরিত্রটি ছিল না অথবা এর গুরুত্ব তুলে ধরা হয়নি, অথবা আমি নিজে আলেয়াকে বুঝে উঠতে পারিনি।

আলেয়াকে বেমালুম আলেয়া ভেবে ভেবে ভুল করে ফেলেছি। আলোয় ধাঁধানো বিভ্রমের সব আলেয়া অর্থহীন নয়। এটি মরিচিকা বা প্রতারনা অর্থেই কেবল বুঝানো হয়, কেউ বলে না পিপাসার্ত বেদুঈন আলেয়াতে পানি খুঁজে পায়না সত্য কিন্তু দিক তো নির্নয় করতে পারে। সিরাজ আখ্যানের আলেয়ার জন্মের সাড়ে তিনশ বছর পরে স্বাধীন বাংলাদেশে জন্মেও কি আমরা জাতি হিসেবে দিক ঠিক করতে পেরেছি? না, পারিনি। না পেরেছি নিজের জীবনে না দেখলাম জাতীর জীবনে। অথচ এদেশের একেকজন কীর্তিহীন মানুষ কত কত উচু মার্গের ঘেচু বিশেষন লাগিয়ে অমরত্বের মুর্তি হয়ে গলায় কাটার মত বিধে রয়েছেন! কি বিষ্ময়! ইতিহাসে আলেয়া নেই। খান আতার ছবিতে নিষ্প্রভ আলেয়া আছে কিন্তু সত্যটা স্পষ্ট নয়। কেন নয় জানিনা। আমরা হচ্ছি ভুয়া বীরত্বের গল্প শোনা এমন এক জাতী যারা প্রশ্ন করে না। প্রশ্ন করার মত মেধা এখানে নেই। যদি থাকত তবে সিরাজকে আমরা অন্যরুপে দেখতাম, সত্যটা আরও স্পষ্ট হত। ইতিহাস তো বদলে যেত না, তাই না? তবুও ইতিহাসকে বেমালুম ভুলে যাওয়া কিংবা আধা সত্য তুলে ধরা অথবা আংশিক সত্যের সাথে যার তার নাম জুড়ে দিয়ে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাংগাল বানিয়ে রাত দিন পুজা করার কাজে মারাত্মক পটু আমরা। আমরা মারাত্মক রকম শঠ, প্রতারক এবং মিথ্যুক একটা অপরাধ প্রবন জাতী যারা দোষী প্রমান হলেও দোষ স্বীকার করে না, ফাসি হলে দলবল সহ রাষ্ট্রপতির হুকুমে ক্ষমা পেয়ে যায়। এখানে ন্যায়ের চর্চা নেই, ছিল না কখনো।

দক্ষিন ভারতের আরেক দুর্ভাগা শাসক ছিলেন টিপু সুলতান। ইংরেজদের সাথে যুদ্ধে তিনি বারবার করে হায়দারাবাদের সহায়তা চেয়েও ব্যার্থ হন অকারনে। হায়দারাবাদের নিজাম গোষ্ঠী একা একা ভাল এবং স্বাধীন থাকবে বলে আশা করেছিল। একা একা ভাল এবং স্বাধীন থাকা যায় না। যদি সমাজ কোন না কোনভাবে পরাধীন থাকে কিংবা জিম্মি হয়ে পরে কোন অপশক্তির হাতে। একা ভাল থাকার কনসেপশন যে ভুল তা একটা প্রমানিত সত্য। টিপু সুলতান হাল ছেড়ে দেননি। হি কন্টিনিউড ফায়ারিং টিল দ্যা লাস্ট বুলেট। আমাদের আজকের কথা এখান থেকেই শুরু। আচ্ছা সিরাজ নিজে কি কখনো কোন যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন? ইতিহাসে তার কোন বীরত্বের গল্প নেই, যুদ্ধের কথা নেই। আছে শুধু কপাল মন্দের কারনে মহাম্মদী বেগের ছুরির আঘাতে মরনের গল্প। পৃথিবীর ইতিহাসে মুক্তির যত যুদ্ধ আছে, যত বীরের গল্প আছে তার সবকটিতেই দেখা গেছে নেতা নিজে যুদ্ধের মাঠে দাঁড়িয়ে অন্তত যুদ্ধের পরিস্থিতির উপর কড়া নজর রেখেছেন, প্রয়োজনে যুদ্ধ করে অমর হয়েছেন। আমাদের সিরাজ যুদ্ধের আগে পরিক্ষিত, প্রমানিত এক বেঈমানকে ডেকে এনে যুদ্ধের দায়িত্ব বুঝিয়ে দেন। সংগে উতকোচের মত হাতে কোরান ছুইয়ে শপথ করান আপন খালু এবং পদচ্যুত সেনা নায়ক মির জাফর আলী খানকে। বেঈমানের হাতে দেশ ও জাতীকে আমানত হিসেবে তুলে দিলে যা হবার তাই হয়েছে। এখানে ভুল কিছু দেখিনা আমি। যা সত্য তা সত্যই। সিরাজকে মরার আগ পর্যন্ত তলোয়ার দুরে থাকুক, একটা খঞ্জর হাতেও দেখা যায়নি। এটা কোন স্বাধীন রাষ্ট্রপতির স্বাভাবিক চরিত্র হতে পারেনা। ফলে যা হয়েছে তা অনিবার্য ছিল। এত অবাক যেমন হবার কিছু নেই, তেমনি দু:খের সাগরে ভেসে গিয়ে বংগোপসাগরকে আটলান্টিক বলে বর্ননা করারও কিছু নেই। এ জাতী স্বাধীনতার যুদ্ধ করে এক সাগর রক্ত দিয়েছে নাকি এমনি এমনি বাধা পশুর মত শিকার হয়েছে তা ভাবনার দাবি রাখে।

যে কথা বলতে এসে থেমে গেছি শেষে তা হচ্ছে আলেয়া। আলেয়ার আসল নাম ছিল সম্ভবত হিরা বা এ জাতীয় কিছু। সেনা নায়ক মোহনলালের আপন বোন এবং ধর্মে হিন্দু। সিরাজের হাতে তলোয়ার শোভা না পেলেও হিরাকে দেখেই তার গোপনাংগের খঞ্জর দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। যার ফল হয়- একটি নিরপরাধ শিশুর জন্ম। জমিদারী হারানোর ভয় এবং নানার হাতে অপমানিত হওয়া থেকে বাচতে এই সিরাজই তার শিশু পুত্রকে গোপনে ঘোড়ার সাথে বেধে, সে ঘোড়াকে তীর মেরে আহত করেছিলেন যেন ঘোড়াটা পালিয়ে যায়। হয়েছিলও তা-ই। পিতা সিরাজ তার প্রথম পুত্র সন্তানকে ঘোড়ায় বেধে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন। এ অমার্জনীয় অপরাধের বিচার হওয়া উচিত ছিল। এ বিচার হয়েছেও কোন না কোন উপায়ে। আমাকে যা খুশি তা ভাবতে পারেন, ক্ষেদ নেই কোন। পিতা যদি নিজ সন্তানকে আগুনে ছুড়ে ফেলে তবে ইতিহাস লেখার কাজটা করবে কে শুনি। সেই অচ্ছুৎ সন্তানই এক সময় ময়মনসিংহের জমিদার বাড়িতে পুত্র সাজে হিন্দু ধর্মে পালিত হয়ে হিন্দু জমিদারে পরিনত হয় এবং আরও নানান ট্র‍্যাজেডির ভিতর দিয়ে এ পরিবারের ইতিহাসের এক প্রকার যবনিকাপাত ঘটে ( গল্পের এ অংশটি নিয়ে ঐতিহাসিক আপত্তি আছে। নির্ভরযোগ্য সত্যান্বেষীরা একে মিথ্যা গালগল্প বলেন। হতে পারে। কারও মত উড়িয়ে দেয়া যায় না। তাছাড়া আলেয়ার সন্তান ছিল এমন প্রমান পাইনি। ) তবু কেন লিখলাম ? লিখলাম এজন্য যে, মিথ্যুকেরাও যদি এ গল্প লিখে থাকে তবে তার পরিনতি কি লিখেছিল তার একটা সম্যক ধারনা দিতে চাই। ঘটনা এমন হবার কথা ছিল। যতটুকু হয়েছে তাতে তাকে ভাগ্যবানই বলা যায়। কিন্তু নবাব পত্নী লুতফুন্নেসার দোষটা কি ছিল ? তাকে কিভাবে তার গল্পের পরিনতি দেখতে হয়েছিল সে কথা কি ভেবেছেন কখনো ? নবাব পরিবারকে ধ্বংস করেছিল যে রায় দুর্লভ, জগতশেঠ কিংবা নদীয়ার রাজা কৃষ্ণ চন্দ্রের দল, তারা কি ভাল জীবন পরে পেয়েছিল ? না পায়নি। কর্মের ফল ভোগ করতে হবে। এরচে বড় ঐতিহাসিক শিক্ষা কি ইতিহাস, ধর্ম কিংবা দর্শনে আছে ? না, নেই সম্ভবতঃ। যে ধর্মীয় হিংসা থেকে সিরাজের পতন সে ধর্ম কি ষড়যন্ত্রীদেরকে রক্ষা করতে পেরেছিল ? না পারেনি। তারা সিরাজের অস্তিত্বই কেবল মুছেনি, নিজেদের পায়ের নিচের মাটিও সরিয়ে দিয়েছিল। যে জীবনে অস্তিত্বের নিশ্চয়তা নেই সেখানে ধর্মের আবার প্রভাব কি? কতটুকু ? শুধু ধর্ম কাউকে রক্ষা করতে পারেনা। নৈতিকতা লাগে।

গেল প্রায় দেড় যুগ ধরে আমরা মানে বাংলাদেশীরা নতুন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী এবং তাদের পোষা মির জাফরদের হাতে বন্দী এবং এক প্রকার অবরুদ্ধ জীবন যাপন করছি। অথবা বিশ্বের সবচে বড় জেল খানায় বসবাস করছে বাংলাদেশের সাড়ে সতের কোটি মানুষ ( এ দেশের তিন দিক কাটা তারের বেড়ায় বেষ্টিত। অন্যদিকে উপসাগর, সাগর এবং শেষে মহাসাগর )। গাজার মানুষ মরছে লড়াই করে। অন্যদিকে আমাদের দম বের করে ফেললেও আমরা স্পিকটি নট থাকি। আমরা সব সময় নিজে ত ভাল আছি- সেই দলের লোক। এ দেশের যেসব জাতীয় নেতা হত্যাকান্ডের শিকার হলেন তাদের ব্যাপারে আমরা চুপ ছিলাম পাছে লোকে রাজাকার সন্দেহ করে। আমরা এতটাই পরিস্কার যে কাউকে কিছু সন্দেহ করার সুযোগটুকু দিতেও নারাজ। এ জাতী যুদ্ধ করে এক সাগর রক্ত দেয়নি। বলা চলে ঘরে বসে থেকে অকারনে এবং অপদার্থের মত রক্ত দান করেছে। যারা ঘোষনা দিয়ে যুদ্ধটা করেছে রক্ত কেবল তারা দিয়েছে। রক্ত তারা দিয়েছে পরাজিত হতে।

জাতি হিসেবে কিংবা নিদেনপক্ষে ভাই হিসেবেও আমরা তাদের পাশে দাড়াইনি। এখানে জয়ের ইতিহাস নেই। আন্তর্জাতিক কোন দলীলে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের কোন কথা নেই। আছে ৬৫ সালের মতই যথারীতি ৭১ সালের ভারত পাকিস্তান যুদ্ধের কথা। এত বড় ঘটনায়ও আমরা চুপ ছিলাম। স্বাধীনতা চাওয়ার দাবী যখন উঠছিল তখন আপামর জনসাধারন চুপ ছিল। যারা স্বাধীন বাংলাদেশের অস্তিত্ব থাকবে কিনা সন্দেহে ছিল তাদের ব্যাপারেও জাতি চুপ ছিল। অন্যদিকে আওয়ামীলীগ সুযোগের অপেক্ষায় ছিল। যুদ্ধের পরে রক্ষী বাহিনী যেমন যাকে ইচ্ছা তাকে রাজাকার বানিয়ে খুন করে ফেলত তেমনি গত দেড় যুগে যাকে ইচ্ছা তাকেই নাই করে দেয়া হয়েছে কেবল তাদের ইচ্ছায়। বাস্তবতার সাথে শুধুমাত্র হত্যার রকমফেরে পার্থক্য হয়েছে। হত্যার নেশায় উন্মাদ আওয়ামীলীগের ভাবনায় চুল পরিমান পার্থক্য হয়নি। এখনো আমরা চুপ আছি। দেখিনা কি হয়। সময় সুযোগ বুঝে ব্যাবস্থা নেয়া যাবে। তাড়াহুড়োর কিছু নেই। অনলাইনে আন্দোলনের বন্যা ভুমিধ্বস ঘটিয়ে দুনিয়া বিরান করে দিয়েছিল বলে যাদের নিয়ে হাসি তামসা হত; আজ তারাও প্রায় ধংস হয়ে গেছে । কেউ পাশে দাড়ায়নি, কেউ কথা রাখেনি। আমরা বসে আছি- দেখিনা কি হয় তত্ত্বে। সবাই যে যার মত নিরাপদ দুরত্বে বসে আছে। অন্যদেরকে উস্কাচ্ছে সবাই নেমে আসুন, মাঠে আসুন, আমি আছি শাহবাগের নিমতলায়। যিনি উস্কে দেন তিনি হয়ত জানেনও না যে, শাহবাগে নিমতলা নেই । তবু বলেন, তিনি শাহবাগেই আছেন। আছেন হয়ত কোন বন্ধুর মেসের খাটের নিচে। কি আর করা যাবে? একজন দায়িত্বশীল নাগরিক হিসেবে কাউকে তো আইন হাতে তুলে নেবার আহবান জানাতে পারিনা, তাইনা? বুঝেছেন তো ? আমিও।

বেগম খালেদা জিয়া, প্রায় ৮০+ বয়সী একজন মহীয়সী নারী। যার চোখের সামনে খুন হয়েছেন প্রানপ্রিয় স্বামী এবং বাংলাদেশের প্রথম প্রেসিডেন্ট শহীদ জিয়াউর রহমান বীর উত্তম, সন্তান ( কোকো ), চিরস্থায়ী পংগু হয়েছেন বড় ছেলে জনাব তারেক রহমান। তিনি কমপক্ষে চারটি মামলা মাথায় নিয়েই হয়ত পরপারে যাবেন। এই দেশ ছাড়া তার আর কোথাও কোন ঠিকানা নেই যে ! আমরা সবাই কপালে ফেট্রি বেধে তাকে নিয়ে হয়ত গোরস্থানে যাব। তিনি বাসায় স্রষ্ঠার কাছে ফিরবেন, আমরাও বাসায় ফিরব। তারপর নিজেদের বীরত্বের গপ্প নিয়ে ফেসবুককে দগদগে ঘা বানিয়ে ফেলব কি বোর্ড চাপতে চাপতে। তারপর বসে থাকব দেখিনা কি হয়ের তালে। আবার ফেসবুকে সরকার বদল করে ফেলতে শুরু করব ! আমরা বলতে পারি না, বেগম জিয়ার বাড়ির সামনে পালা করে পাহারা বসাব। কে শুনবে আমাদের বিলাপ ! শুধুমাত্র বেগম জিয়ার বাসার সামনে আপনারা রাস্তাকে ফ্রি রেখে ফুটপাতে কাগজ বিছিয়ে শুয়ে বসে থাকার কথা বলুন না। বেগম জিয়া আমাদের স্বাধীনতা ফিরিয়ে দেবেন। সন্তান হিসেবে আমরা শুধু প্রচলিত আইন মেনেই তাকে দেখে শুনে রাখব যেন কোন কোম্পানি সেদিকে চোখ ফেলতে না পারে। বয়সের ভারে ন্যুয়ে পরেও যে স্ত্রী এদেশ থেকে যায়নি, যে মায়ের সন্তানেরা নির্মম বলি হয়েছেন তিনি আপনাদের ছেড়ে যাননি কোথাও, গ্রেফতারের হুলিয়া মাথায় নিয়ে যিনি তার সাড়ে সতের কোটি সন্তানকে স্বাধীন বাংলাদেশ ফিরিয়ে দেবার প্রত্যয়ে এখনো বেচে আছেন তার জন্য এটুকু করা কি খুব বেশি হয়ে যাবে। আমরা কি এতটাই অকৃতজ্ঞ হয়ে গেলাম? এ প্রশ্নের সঠিক উত্তরের উপর নির্ভর করছে এ জাতীর আগামী ভবিষ্যত। মা না থাকলে সন্তান আসবে কোত্থেকে? সন্তান না থাকলে ইতিহাস লিখবে কি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী? যদি লিখেও তবে তা কার জন্যে ? জাতী কোন ভাগ্য বরন করবে তার উত্তর এ জাতীর কাছেই রয়েছে, খালেদা জিয়ার হাতে নয়।
কবিতালয়।


লেখক : নির্বাহী সম্পাদক , দেশ জনতা ডটকম