উদ্যান-পার্কে কংক্রীট ও অবকাঠামো নির্মাণের স্বেচ্ছাচার বন্ধ করুনঃ বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স (বিআইপি)

আপডেট: মে ৭, ২০২১
0

ঢাকার অক্সিজেনের আধার ও ঐতিহাসিক স্মৃতি বিজড়িত সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের উন্নয়ন প্রকল্পের নামে বৃক্ষনিধনসহ উদ্যানের গাছপালা, পরিবেশ-প্রতিবেশ এর উপর যে ধ্বংসযজ্ঞ ইতিমধ্যে চালানো হয়েছে তার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স (বিআইপি)।

নগর পরিকল্পনাবিদদের কোনরূপ সম্পৃক্ত না করেই মহাপরিকল্পনার নাম দিয়ে এবং শহর পরিকল্পনার ক্ষেত্রে আদর্শ পরিকল্পনাগত পদ্ধতি অনুসরণ না করে যদি কোন উন্নয়ন প্রকল্প প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা হলে যে পরিণতি হবার কথা ছিল, ঢাকার সোহরাওয়ার্দি উদ্যানের ক্ষেত্রে সেই পরিণতিই হয়েছে। স্থাপত্য অধিদপ্তর কর্তৃক ডিজাইনকৃত সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের উন্নয়ন প্রকল্পে বাংলাদেশের বিদ্যমান পরিকল্পনা, পরিবেশ ও উন্নয়ন সংশ্লিষ্ট আইন-বিধিবিধান অনুসরণ করা হলে সোহরাওয়ার্দি উদ্যানে পরিবেশের উপর এরূপ ধ্বংসযজ্ঞ হবার কথা ছিল না বলে বিআইপি মনে করে। পাশাপাশি ঢাকার বিভিন্ন পার্ক, খেলার মাঠ ও গণপরিসর ডিজাইনে যে পরিমান অবকাঠামো, কংক্রিটের ব্যবহার, কফিশপ, রেঁস্তোরা নির্মাণের মাধ্যমে গণপরিসরের চরিত্র পরিবর্তনের মাধ্যমে কর্পোরেটাজাইজেশন করবার সাম্প্রতিক ধারা লক্ষ্য করা যাচ্ছে, তাতে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স (বিআইপি) গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করছে। বিদ্যমান ঢাকা মহানগর ইমারত নির্মাণ বিধিমালাতে সুস্পষ্টভাবে বলা আছে, পাবলিক পার্ক এবং খোলা পরিসরে যেকোন ইমারত নির্মাণের জন্য অনুমোদনের প্রয়োজন হবে এবং খোলা পরিসরের শতকরা ৫ ভাগের বেশি জায়গায় অবকাঠামো হতে পারবে না। পাশাপাশি এই ধরনের পার্কের ক্ষেত্রে বড় ধরনের উন্নয়ন প্রকল্প নিতে গেলে ইমারত নির্মাণ বিধিমালার আওতায় গঠিত ‘নগর উন্নয়ন কমিটি’র মতামত নেয়া অত্যাবশ্যক। আইনের সুস্পষ্ট বাধ্যবাধকতা থাকা সত্বেও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের প্রকল্পের পরিকল্পনা নগর উন্নয়ন কমিটির অনুমোদন ব্যতিরেকে এবং বিশেষজ্ঞ মূল্যায়ন কিংবা জনসাধারণের কাছে মতামতের জন্য গণশুনানি ছাড়াই এই ধরনের প্রকল্প প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের উদ্যোগ আইনের সুস্পষ্ট ব্যত্যয় এবং পরিকল্পিত ও টেকসই ঢাকা মহানগরী গড়বার বৃহৎ লক্ষ্যের সাথে সাংঘর্ষিক বলে মনে করে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স, যার দায়-দায়িত্ব প্রকল্প প্রণয়নের সাথে সংশ্লিষ্ট অধিদপ্তর এবং এই প্রকল্প প্রণয়নের সাথে যুক্ত পেশাজীবিদেরই সর্বাগ্রে নিতে হবে।
উদ্যান বা প্রাকৃতিক ও প্রতিবেশগত ভাবে গুরুত্বপূর্ণ কোন স্থানের প্রকল্প প্রণয়নে যথোপযুক্ত পেশাজীবি যথা নগর পরিকল্পনাবিদ, স্থপতি, নগর নকশাবিদ, প্রকৌশলী, উদ্যানতত্ত্ববিদ, বাস্তুতন্ত্র ও প্রতিবেশ বিশেষজ্ঞ, সমাজবিজ্ঞানী প্রভৃতি বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে নকশা প্রণয়ন করাটাই বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত পদ্ধতি। পাশাপাশি এই ধরনের নকশা প্রণয়নের বিভিন্ন পর্যায়ে উদ্যান ব্যবহারকারী সহ সংশ্লিষ্ট অংশীজনদের সাথে মতবিনিময় করাটা পরিকল্পনা পদ্ধতির অতি গুরুত্বপূর্ণ অংশ যা বিশ্বের আধুনিক নগর পরিকল্পনায় ধারায় অনুসরণ করা হয়। এই প্রক্রিয়ায় প্রকল্পের পরিকল্পনা ও নকশা প্রণয়ণ এর পর তা জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয় সকলের মতামত গ্রহণের জন্য; পাশাপাশি নগর পরিকল্পনাবিদ, নগর নকশাকার, উদ্যানতত্ত্ববিদ প্রমুখ বিশেষজ্ঞ প্যানেলের কাছে নকশা উপস্থাপন করা হয় বিশেষজ্ঞ মতামত প্রদানের জন্য এবং প্রাপ্ত মতামতের ভিত্তিতে উদ্যান বা গণপরিসরের চূড়ান্ত পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা হয়।
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের উন্নয়ন পরিকল্পনায় উপরোক্ত পরিকল্পনা পদ্ধতি অনুসরণ না করেই প্রকল্প চূড়ান্তকরণের মাধ্যমে বৃক্ষ নিধন ও পরিবেশ-প্রতিবেশ ধ্বংস করে উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে যা চূড়ান্তভাবে অপেশাদারী আচরণ ও গণপরিসরের উপর জনগণের যে অংশীদারিত্ব রয়েছে তার চূড়ান্ত অবমূল্যায়ন। আরও পরিতাপের বিষয় হচ্ছে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের উন্নয়ন পরিকল্পনায় বড় পরিসরের গাড়ি পার্কিং, রেস্তোরা নির্মাণ সহ অবকাঠামোগত যে পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে তার পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন হলে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের উদ্যান চরিত্র নষ্ট হয়ে যাবার সম্ভাবনা প্রবল, যা বিদ্যমান ‘উন্মুক্ত স্থান, উদ্যান এবং প্রাকৃতিক জলাধার সংরক্ষণ আইন, ২০০০’ এর সুস্পষ্ট ব্যত্যয়।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স আন্তরিকভাবে বিশ্বাস করে, বংগবন্ধুর ৭ ই মার্চ এর ভাষণ এবং ১৬ই ডিসেম্বর পাক হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণের স্মৃতি বিজড়িত এই ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের প্রকৃতি ও পরিবেশকে অক্ষুণ্ণ রেখেই আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা সংগ্রামের এই স্মৃতিময় স্থানগুলোকে চিরভাস্মর করে রাখবার পরিকল্পনা করা সম্ভব। রেস্টুরেন্ট তৈরী, গাড়ি পার্কিং নির্মাণ কিংবা অন্যান্য যে সকল অবকাঠামো পরিকল্পনা বর্তমান নকশাতে আছে তা উপরোক্ত উদ্দেশ্য পূরণে পুরোপুরি ব্যর্থ হবে। বিদ্যমান বাস্তবতায় বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স নিম্নের প্রস্তাবনাসমূহ নীতিনির্ধারণী মহল সহ সংশ্লিষ্ট সকলের বিবেচনার জন্য সুপারিশ করছেঃ

প্রথমতঃ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ অনতিবিলম্বে বন্ধ করে দিয়ে প্রস্তাবিত প্রকল্পের পরিকল্পনাগত বিশ্লেষণ ও পরিবেশ-প্রতিবেশগত প্রয়োজনীয় সমীক্ষা করবার মাধ্যমে প্রয়োজনীয় সংশোধনী ও পরিমার্জন করে প্রকল্পের পরিকল্পনার প্রণয়ন করা।
– দ্বিতীয়তঃ প্রকল্প প্রণয়নে যথোপযুক্ত পেশাজীবি যথা নগর পরিকল্পনাবিদ, স্থপতি, নগর নকশাবিদ, প্রকৌশলী, উদ্যানতত্ত্ববিদ, বাস্তুতন্ত্র ও প্রতিবেশ বিশেষজ্ঞ, সমাজবিজ্ঞানী প্রভৃতি বিশেষজ্ঞদের অন্তর্ভূক্ত করা।
– তৃতীয়তঃ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের উন্নয়ন প্রকল্পের পরিকল্পনা ইমারত নির্মাণ বিধিমালার আওতায় গঠিত ‘নগর উন্নয়ন কমিটি’র মতামত সাপেক্ষে অনুমোদনের মাধ্যমে বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়া।
– চতুর্থতঃ স্থাপত্য অধিদপ্তর কর্তৃক সোহরাওয়ার্দী উদ্যান সংশ্লিষ্ট উন্নয়ন প্রকল্পের ডিজাইনে পেশাজীবীদের ‘প্রফেশনাল কোড অব এথিক্স এবং স্ট্যান্ডার্ড প্র্যাকটিস’ এর ব্যত্যয় ঘটে থাকলে সংশ্লিষ্টদের পেশাজীবি ইনস্টিটিউটের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্যোগ নেয়া
– পঞ্চমতঃ নগর পরিকল্পনা ও নির্মিত পরিবেশ সংশ্লিষ্ট পেশাজীবিদের ‘প্রফেশনাল কোড অব এথিক্স’ মেনে গণপরিসর পরিকল্পনায় পরিবেশ-প্রতিবেশ-জনস্বার্থ সংরক্ষণে সর্বোচ্চ পেশাদারী আচরণ নিশ্চিত করা
– ষষ্ঠতঃ সোহরাওয়ার্দী উদ্যান সংশ্লিষ্ট উন্নয়ন প্রকল্পের মাধ্যমে বৃক্ষ নিধন ও পরিবেশ-প্রতিবেশ এর ক্ষতিসাধন এর সাথে সাথে সংশ্লিষ্টদের দ্রুত তদন্ত সাপেক্ষে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে দৃষ্টান্ত স্থাপন করা উচিত যেন বাংলাদেশের আর কোথাও পরিবেশ-প্রতিবেশকে ধ্বংস করে উন্নয়ন ও সৌন্দর্যবর্ধনের নামে হঠকারি পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়া না হয়।
– সপ্তমতঃ বিশ্বের অন্যান্য দেশের ন্যায় সারা দেশের উদ্যান, পার্ক, খেলার মাঠ, গণপরিসর পরিকল্পনা ও রক্ষণাবেক্ষণে পেশাজীবিদের সমন্বয়ে অনিতিবিলম্বে বিশেষ সংস্থা গঠনের উদ্যোগ গ্রহণ করা।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স আন্তরিকভাবে বিশ্বাস করে, ঢাকা নগরের পরিবেশ-প্রতিবেশের জন্য অতি গুরুত্বপূর্ণ এবং বংগবন্ধুর ৭ ই মার্চ এর ভাষণসহ আমাদের স্বাধীনতা ও মুক্তিসংগ্রামের অনেক ঐতিহাসিক স্মৃতিবিজড়িত সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের সঠিক পরিকল্পনার প্রণয়নের মাধ্যমে ঐতিহাসিক স্মৃতি ও পরিবেশ দুটোই রক্ষা করা সম্ভব। এ ব্যাপারে পেশাজীবিসহ সংশ্লিষ্ট সবার আন্তরিকতা থাকলে আমরা পরবর্তী প্রজন্মের জন্য এই গুরুত্বপূর্ণ উদ্যান সংরক্ষণ করবার মাধ্যমে পরিকল্পিত ও টেকসই ঢাকা গড়বার অংগীকার পালন করতে সমর্থ হব।