উদ্যান-পার্কে কংক্রীট ও ধূসর এলাকার পরিমাণ বাড়ছে উদ্বেগজনকভাবেঃ বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স (বিআইপি)

আপডেট: মে ৯, ২০২১
0

‘উদ্যান-পার্কের উন্নয়ন প্রকল্প ও প্রকৃতি-পরিবেশ সুরক্ষা’ শীর্ষক পরিকল্পনা সংলাপ এর সংবাদ বিজ্ঞপ্তি

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স (বিআইপি) এর উদ্যোগে ‘উদ্যান-পার্কের উন্নয়ন প্রকল্প ও প্রকৃতি-পরিবেশ সুরক্ষা’ শীর্ষক পরিকল্পনা সংলাপ অনলাইন মাধ্যমে ০৯ মে ২০২১ (রবিবার), সকাল ১১.০০টায় অনুষ্ঠিত হয়।

সাম্প্রতিক সময়ে ঢাকাসহ নগর এলাকার বিভিন্ন পার্ক-উদ্যানের পরিকল্পনা ও নকশায় প্রকৃতি-পরিবেশ-প্রতিবেশকে প্রাধান্য না দিয়ে মাত্রাতিরিক্ত অবকাঠামো নির্মাণ ও কংক্রিটের ব্যবহারের মাধ্যমে পার্ক-উদ্যানের চরিত্র পরিবর্তন করে ফেলা হচ্ছে। পরিবেশ-প্রতিবেশ ও জনস্বার্থ বিরোধী এই প্রবণতা শুধু সোহরাওয়ার্দী উদ্যানই নয়, সাম্প্রতিক সময়ের ওসমানী উদ্যান সহ সমসাময়িক অনেক পার্ক ও গণপরিসর নির্মাণের পরিকল্পনা নকশায় দেখা গিয়েছে, যা পরিকল্পনাগত, পরিবেশগত ও সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে অত্যন্ত উদ্বেগজনক। অদ্য বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স (বিআইপি) এর উদ্যোগে ‘উদ্যান-পার্কের উন্নয়ন প্রকল্প ও প্রকৃতি-পরিবেশ সুরক্ষা’ শীর্ষক অনলাইন মাধ্যমে আয়োজিত পরিকল্পনা সংলাপে আলোচকবৃন্দ উপরোক্ত মতামত প্রদান করেন।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের সাধারণ সম্পাদক পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খানের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানের সভাপতিত্ব করেন বি.আই.পি.-র সভাপতি পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক ড. আকতার মাহমুদ, এছাড়াও বি.আই.পি.-র সহ-সভাপতি পরিকল্পনাবিদ মোঃ আরিফুল ইসলাম, যুগ্ম সম্পাদক পরিকল্পনাবিদ মোহাম্মদ রাসেল কবির, ঢাকার বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক পরিকল্পনাবিদ মোঃ আশরাফুল ইসলাম সহ আর অন্যান্য বিশেষজ্ঞগণ উপস্থিত ছিলেন।

সোহরাওয়ার্দী উদ্যান সহ ঢাকা শহরের সাম্প্রতিক সময়ে উদ্যান-পার্ক এর সৌন্দর্য বর্ধন ও উন্নয়নের জন্য গৃহীত পরিকল্পনা নকশার উপর বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের সাম্প্রতিক সমীক্ষার ফলাফল উপস্থাপন করা হয় পরিকল্পনা সংলাপে। বিআইপি’র সমীক্ষায় দেখা যায়, উদ্যান-পার্ক এর উন্নয়ন প্রকল্পের মাধ্যমে অবকাঠামো, কংক্রীট ও ধূসর এলাকা আশংকাজনক হারে বাড়ছে, বিপরীতে উদ্বেগজনক হারে সবুজ এলাকার পরিমাণ কমছে।

সোহরাওয়ার্দী উদ্যান এর উন্নয়ন প্রকল্পের প্রস্তাবিত নকশায় অবকাঠামো, কংক্রীট ও ধূসর এলাকার পরিমাণ শতকরা ৩৭ ভাগ এবং ওসমানী উদ্যান এর নকশায় আছে তা ৫২ ভাগ। পাশাপাশি গুলশানে অবস্থিত বিচারপতি শাহাবুদ্দিন আহমদ পার্ক এর ক্ষেত্রে এই ধূসর এলাকার পরিমাণ আছে ৩৭ ভাগ ও বনানী পার্ক এর ক্ষেত্রে তা ৪২ ভাগ। ফলশ্রুতিতে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের প্রকৃতি-পরিবেশ ও সবুজকে ধ্বংস করে দিয়ে পার্ক-উদ্যানের উন্নয়ন প্রকল্প প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, বরং তা সাম্প্রতিক সময়ে এই ধরনের গণপরিসরের পরিকল্পনা ও নকশা প্রণয়নে পরিকল্পনাগত আদর্শ অনুসরণের বিচ্যুতির ধারাবাহিকতা।

এই বাস্তবতায় বিআইপির পরিকল্পনা সংলাপ অনুষ্ঠানে আলোচকবৃন্দ উদ্যান বা প্রাকৃতিক ও প্রতিবেশগত ভাবে গুরুত্বপূর্ণ কোন স্থানের প্রকল্প প্রণয়নে যথাযথ পেশাজীবি যথা নগর পরিকল্পনাবিদ, স্থপতি, নগর নকশাবিদ, প্রকৌশলী, উদ্যানতত্ত্ববিদ, বাস্তুতন্ত্র ও প্রতিবেশ বিশেষজ্ঞ, সমাজবিজ্ঞানী প্রভৃতি বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে নকশা প্রণয়ন; সংশ্লিষ্ট অংশীজনদের সাথে মতবিনিময় ও গণশুনানি, নগর উন্নয়ন কমিটির অনুমোদন, উন্নয়ন প্রকল্পে পরিবেশ ও প্রতিবেশের বিরূপ প্রভাব বিশ্লেষণ, জনবান্ধব উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ, সংশ্লিষ্ট আইন ও পেশাজীবী কোড অব এথিক্স এবং স্ট্যান্ডার্ড প্র্যাকটিস অনুসরণ সহ সংশ্লিষ্ট মতামত প্রদান করেন।

সংলাপের মূল প্রতিপাদ্যের উপর প্রবন্ধ উপস্থাপনে বি.আই.পি.-র সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, শহর পরিকল্পনার ক্ষেত্রে আদর্শ পরিকল্পনাগত পদ্ধতি অনুসরণ না করে বৃক্ষনিধনসহ উদ্যানের গাছপালা, পরিবেশ-প্রতিবেশ বিনষ্ট করার মাধ্যমে উন্নয়ন প্রকল্প প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা হচ্ছে যেটা ঢাকার সাম্প্রতিক পরিবেশ বিপর্যয়েরও কারণ। ইমারত নির্মাণ বিধিমালাতে সুস্পষ্টভাবে বলা আছে, পাবলিক পার্ক এবং খোলা পরিসরে যেকোন ইমারত নির্মাণের জন্য অনুমোদনের প্রয়োজন হবে এবং খোলা পরিসরের শতকরা ৫ ভাগের বেশি জায়গায় অবকাঠামো হতে পারবে না; একই সাথে ইমারত নির্মাণ বিধিমালার আওতায় গঠিত ‘নগর উন্নয়ন কমিটি’র মতামত নিতে হবে। অথচ স্থাপত্য অধিদপ্তর কর্তৃক ডিজাইনকৃত সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের উন্নয়ন প্রকল্পে বাংলাদেশের বিদ্যমান পরিকল্পনা, পরিবেশ ও উন্নয়ন সংশ্লিষ্ট আইন-বিধিবিধান অনুসরণ করা হয়নি।

উদ্যান-পার্কের উন্নয়ন প্রকল্প ও প্রকৃতি-পরিবেশ সুরক্ষায় বি.আই.পি.-র সাধারণ সম্পাদক বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স এর পক্ষ থেকে আটটি (০৮) প্রস্তাবনা তুলে ধরেন, যথাঃ

• প্রথমতঃ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ অনতিবিলম্বে বন্ধ করে দিয়ে প্রস্তাবিত প্রকল্পের পরিকল্পনাগত বিশ্লেষণ ও পরিবেশ-প্রতিবেশগত প্রয়োজনীয় সমীক্ষা করবার মাধ্যমে প্রয়োজনীয় সংশোধনী ও পরিমার্জন করে প্রকল্পের পরিকল্পনার প্রণয়ন করা।

• দ্বিতীয়তঃ প্রকল্প প্রণয়নে যথোপযুক্ত পেশাজীবি যথা নগর পরিকল্পনাবিদ, স্থপতি, নগর নকশাবিদ, প্রকৌশলী, উদ্যানতত্ত্ববিদ, বাস্তুতন্ত্র ও প্রতিবেশ বিশেষজ্ঞ, সমাজবিজ্ঞানী প্রভৃতি বিশেষজ্ঞদের অন্তর্ভূক্ত করা।

• তৃতীয়তঃ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের উন্নয়ন প্রকল্পের পরিকল্পনা ইমারত নির্মাণ বিধিমালার আওতায় গঠিত ‘নগর উন্নয়ন কমিটি’র মতামত সাপেক্ষে অনুমোদনের মাধ্যমে বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়া।

• চতুর্থতঃ স্থাপত্য অধিদপ্তর কর্তৃক সোহরাওয়ার্দী উদ্যান সংশ্লিষ্ট উন্নয়ন প্রকল্পের ডিজাইনে পেশাজীবীদের ‘প্রফেশনাল কোড অব এথিক্স এবং স্ট্যান্ডার্ড প্র্যাকটিস’ এর ব্যত্যয় ঘটে থাকলে সংশ্লিষ্টদের পেশাজীবি সংগঠনের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্যোগ নেয়া

• পঞ্চমতঃ নগর পরিকল্পনা ও নির্মিত পরিবেশ সংশ্লিষ্ট পেশাজীবিদের ‘প্রফেশনাল কোড অব এথিক্স’ মেনে গণপরিসর পরিকল্পনায় পরিবেশ-প্রতিবেশ-জনস্বার্থ সংরক্ষণে সর্বোচ্চ পেশাদারী আচরণ নিশ্চিত করা

• ষষ্ঠতঃ সোহরাওয়ার্দী উদ্যান সংশ্লিষ্ট উন্নয়ন প্রকল্পের মাধ্যমে বৃক্ষ নিধন ও পরিবেশ-প্রতিবেশ এর ক্ষতিসাধন এর সাথে সাথে সংশ্লিষ্টদের দ্রুত তদন্ত সাপেক্ষে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে দৃষ্টান্ত স্থাপন করা উচিত যেন বাংলাদেশের আর কোথাও পরিবেশ-প্রতিবেশকে ধ্বংস করে উন্নয়ন ও সৌন্দর্যবর্ধনের নামে হঠকারি পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়া না হয়।

• সপ্তমতঃ বিশ্বের অন্যান্য দেশের ন্যায় সারা দেশের উদ্যান, পার্ক, খেলার মাঠ, গণপরিসর পরিকল্পনা ও রক্ষণাবেক্ষণে পেশাজীবিদের সমন্বয়ে অনিতিবিলম্বে বিশেষ সংস্থা গঠনের উদ্যোগ গ্রহণ করা।

• অষ্টমতঃ দেশের সকল উদ্যান-পার্ক এর পরিকল্পনা ও নকশা প্রণয়নে অবকাঠামো-কংক্রিট নির্মাণের সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে এসে প্রকৃতি-পরিবেশকে অক্ষুণ্ণ রেখে উন্নয়ন পরিকল্পনা করা।

পরিকল্পনা সংলাপে বি.আই.পি.-র সহ-সভাপতি পরিকল্পনাবিদ মোঃ আরিফুল ইসলাম বলেন, পরিবেশ প্রকৃতির সংরক্ষণের মাধ্যমে বিদ্যমান উদ্যান বা পার্কের বৈশিষ্ট্য ক্ষতি না করে নতুন উদ্যান বা পার্ক উন্নয়নের কথা বিবেচনায় আনা উচিত। তিনি আরো বলেন, শহরের টেকসই উন্নয়ন, পরিবেশ ও বাস্তুতন্ত্র সংরক্ষণ এবং নগর পরিকল্পনার জন্য সবুজায়নের গুরুত্ব অনস্বীকার্য। এছাড়া বি.আই.পি.-র যুগ্ন সম্পাদক পরিকল্পনাবিদ মোহাম্মদ রাসেল কবির বলেন, উন্নয়ন প্রকল্প পরিবেশ বান্ধব হলেই তবে সেটাকে জনবান্ধব উন্নয়ন বলা যাবে। এই ধরনের উন্নয়ন প্রকল্পে আইনের ব্যত্যয় ঘটিয়ে কোন প্রকল্প গৃহীত হলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা সংস্থাকে জরিমানার আওতায় আনতে হবে এবং টেকসই উন্নয়নের জন্য সমন্বয়হীনতা দূর করতে হবে। ঢাকার বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক পরিকল্পনাবিদ মোঃ আশরাফুল ইসলাম বলেন, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান এর প্রস্তাবিত পরিকল্পনা ‘উন্মুক্ত স্থান, উদ্যান এবং প্রাকৃতিক জলাধার সংরক্ষণ আইন, ২০০০’ এর ধারা ও মূল চেতনার সাথে সাংঘর্ষিক। তিনি আর ও বলেন, পার্ক-উদ্যান এর পরিকল্পনার গণশুনানী ছাড়া কোন প্রকল্প অনুমোদন যেন না করা হয়। পাশাপাশি তিনি পেশাজীবি সংগঠনসমূহকে পার্ক-উদ্যান রক্ষায় আরো বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখবার আহবান জানান।

বি আই পি সভাপতি পরিকল্পনাবিদ ড. আকতার মাহমুদ বলেন, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান উন্নয়নের নামে বস্তুনিষ্ঠ পরিকল্পনাগত বিশ্লেষণ ছাড়াই প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করছে , অথচ সেই প্রকল্প গুলো পরিবেশের প্রতি সংবেদনশীল কিংবা জনবান্ধব কিনা সেটা যাচাই করা হচ্ছেনা। উন্নয়নের নামে গৃহীত প্রকল্পে কোন গনশুনানী বা পেশাজীবী সংস্থার মতামত নেওয়া হচ্ছেনা। এছাড়াও উদ্যান, পার্ক বা গণপরিসরের মতো জায়গায় কংক্রিটের অবকাঠামো নির্মাণের মাধ্যমে সামাজিক বৈষম্য সৃষ্টি করা হচ্ছে। বর্তমানে ঢাকা শহরে সবুজ এলাকা ও উন্মুক্ত স্থান পরিকল্পনার মানদণ্ড অনুযায়ী ৯০ ভাগের ১ ভাগ আছে, এতদসত্বেও আইন ও বিধি অমান্য করে বিদ্যমান উদ্যান, উন্মুক্ত স্থানের শ্রেনী বা বৈশিষ্ট্য পরিবর্তন করা হচ্ছে।

বি আই পি সভাপতি এই ধরনের স্বেচ্ছাচারমূলক কাজ অবিলম্বে বন্ধের জোর দাবী জানান এবং উন্মুক্ত স্থান, উদ্যান বা পার্কের চরিত্র বিনষ্ট করে এধরনের উন্নয়ন প্রকল্পের নকশা করবার প্রবণতা বন্ধ করে প্রকৃতি ও পরিবেশকে প্রাধান্য দিয়ে পরিকল্পনা প্রণয়নের আহবান জানান পেশাজীবি ও সংশ্লিষ্ট সকলের প্রতি।