এবার কোথায় যাবে ক্রিমিয়ার তাতার মুসলিমরা

আপডেট: ফেব্রুয়ারি ১২, ২০২২
0

সাবেক সোভিয়েত সরকারের রোষানলের কারণে তুর্কি বংশোদ্ভূত তাতার মুসলিমরা জনগোষ্ঠী দীর্ঘদিন ক্রিমিয়া থেকে নির্বাসিত ছিলেন। বয়স যখন ২০ কোটায় তখন ইরফান মধ্য এশিয়া থেকে অন্য অনেক তাতারের মতো ক্রিমিয়ায় ফেরেন।

ইরফান কুদুসোভের বয়স ৫৩ বছর। বসবাস করেন ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভে। সেখানে একটি রেস্তোরাঁ চালান তিনি। ইউক্রেনের দক্ষিণাঞ্চলীয় উপদ্বীপ ক্রিমিয়ার সংখ্যালঘু তাতার মুসলিম জনগোষ্ঠীর একজন ইরফান।

ওই দিনের স্মৃতিচারণা করে তিনি বলেন, ‘সে এক সুখের দিন। বয়স্ক ব্যক্তিরা যখন উড়োজাহাজ থেকে ক্রিমিয়ায় নামলেন, তখন তাঁরা মাটিতে চুমু এঁকে দিয়েছিলেন। মাতৃভূমিতে ফেরার আনন্দে আমরা সবাই তখন কাঁদছিলাম।’

তবে পরিস্থিতি বদলে যায় ২০১৪ সালে, রাশিয়া ক্রিমিয়া উপদ্বীপ দখলে নিলে। ইরফানসহ প্রায় ১০ হাজার তাতার মুসলিমকে আবারও মাতৃভূমি ছাড়তে হয়। তখন থেকেই ইরফান কিয়েভে বসবাস করছেন।

এখন এক লাখের বেশি রুশ সৈন্য ইউক্রেন সীমান্তে জড়ো হয়েছে। যেকোনো সময় রাশিয়া দেশটিতে সামরিক আগ্রাসন চালাতে পারে বলে সতর্ক করে দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো। যুদ্ধ বাধলে, সেটা শুধু রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না। অনিবার্যভাবে এতে পশ্চিমারাও জড়িয়ে পড়বে। তাই ইউক্রেনে রুশ হস্তক্ষেপের আশঙ্কায় নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে নতুন ঝুঁকিতে পড়েছে তাতার জনগোষ্ঠীর মানুষ

বাধ্যতামূলক নির্বাসন

কৃষ্ণসাগরের উত্তরাঞ্চলে ক্রিমিয়া উপত্যকার ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী তাতাররা। ১৯৪৪ সালে ক্রিমিয়ায় প্রায় ১ লাখ ৮০ হাজার তাতার বসবাস করতেন। তাঁদের মূল পেশা ছিল পশুপালন। তখন ক্রিমিয়া সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্তর্গত। সোভিয়েত শাসক জোসেফ স্তালিনের রোষানলে পড়ে তাতাররা মধ্য এশিয়ায়, বিশেষত উজবেকিস্তানে পাড়ি জমাতে বাধ্য হন। বলা হয়ে থাকে, কষ্টকর এ যাত্রায় ক্ষুধা, শীত ও রোগে প্রায় অর্ধেক তাতার মারা যান। এ ঘটনাকে গণহত্যা হিসেবে চিহ্নিত করেছে ইউক্রেনসহ কয়েকটি দেশ।

একসময় কয়েক হাজারো তাতার সোভিয়েত রেড আর্মিতে কর্মরত ছিলেন। এরপরও জোসেফ স্তালিন বিশ্বাস করতেন, তাতাররা নাৎসিদের অনুগত। সোভিয়েত আমলে তাতারদের বিরুদ্ধে বছরের পর বছর ধরে এমন প্রচারণা চালানো হয়েছে। তাঁদের বিরুদ্ধে স্তালিনের গোস্‌সার এটাই কারণ। তিনি ক্রিমিয়ায় তাতারদের নিজস্ব ভাষা চর্চায় নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিলেন। এসব কারণে অতীত থেকেই তাতাররা সোভিয়েতবিরোধী মনোভাব পোষণ করেন। সেই রেশ এখনো রয়ে গেছে। সোভিয়েতের জায়গায় শুধু বসেছে রাশিয়া।

ইউক্রেনবাসীর ভাগ্য এখন অনেকটাই ঝুলে রয়েছে চলমান সংকট নিরসনে চলা বিশ্বনেতাদের কূটনৈতিক প্রচেষ্টার ওপর। ইউক্রেন আমাদের জন্মভূমি। এখানে কী ঘটতে যাচ্ছে, সেটা নিয়ে আমরা প্রতিনিয়ত চিন্তা করি। আমাদের ভাগ্যে কী পরিণতি লেখা রয়েছে, সেটা নিয়ে আমরা উদ্বিগ্ন থাকি

—কামিলা ইয়োশেঙ্কো

তাতারদের কপাল খুলে ১৯৯১ সালের পর। তত দিনে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে গেছে। ইউক্রেন স্বাধীন হয়েছে। রাশিয়া নয়, ইউক্রেনের অংশ হয়েছে ক্রিমিয়া।

ইউক্রেন সরকার তাতারদের মাতৃভূমিতে ফেরার অনুমতি দেয়। তবে ফিরে এলেও তাঁরা ফেলে যাওয়া ঘরবাড়িতে উঠতে পারেননি, সেসব দখল হয়ে গিয়েছিল। কিয়েভে বসবাসকারী জাখিদা কাতাকি বলেন, ‘আমার দাদি তাঁর ফেলে যাওয়া বাড়িতে গিয়েছিলেন। সেটির নতুন মালিক তাঁর সঙ্গে ভীষণ খারাপ ব্যবহার করেন।’

পরের সময়টা ক্রমশ উত্থানের, ভালো থাকার। সোভিয়েত পতনের বছরই ক্রিমিয়ায় তাতারদের প্রতিনিধিত্বকারী কর্তৃপক্ষ ‘মজলিশ’ গঠিত হয়। ক্রিমিয়ায় তাতার ভাষায় বিদ্যালয় স্থাপিত হয়। তাতাররা নতুন করে থিতু হওয়ার, ঘুরে দাঁড়ানোর, জীবন গড়ার স্বপ্ন দেখেন।

তবে এ স্বপ্ন ভেস্তে যায় ক্রিমিয়া রাশিয়ার হাতে চলে যাওয়ায়। এর পর থেকে রাশিয়া-সমর্থিত বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সঙ্গে ইউক্রেনের সেনাদের লড়াই চলছে। এ লড়াইয়ে অন্তত ১৪ হাজার মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন।

প্রথম আলো