করোনায় বাল্য বিয়ে বেড়েছে : শিক্ষায় অর্থনীতিতে পিছিয়ে পড়েছে নারী– সিডও দিবসে বিশ্লেষণ

আপডেট: সেপ্টেম্বর ৬, ২০২১
0

আন্তর্জাতিক সিডও দিবস উপলক্ষ্যে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের উদ্যোগে ’‘অর্থনীতিতে নারী ও সিডও বাস্তবায়নঃ পরিপ্রেক্ষিত জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতিমালা’’ শীর্ষক অনলাইন আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত।

আন্তর্জাতিক সিডও দিবস পালন উপলক্ষ্যে ৫ সেপ্টেম্বর ২০২১(রবিবার) বিকাল সাড়ে টায় বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের উদ্যোগে ’‘অর্থনীতিতে নারী ও সিডও বাস্তবায়নঃ পরিপ্রেক্ষিত জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতিমালা’’ শীর্ষক আলোচনা সভা অনলাইনে অনুষ্ঠিত হয়। সভায় সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি ডা.ফওজিয়া মোসলেম।

সভায় অতিথি আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের মহাপরিচালক ড.বিনায়ক সেন; জেন্ডার এন্ড সোশাল ডেভেলপমেন্ট এক্সপার্ট ফেরদৌসী সুলতানা ; ইউএন উইমেন বাংলাদেশ এর প্রতিনিধি সোহেল রানা এবং বৈশাখী টেলিভিশনের সাংবাদিক রীতা নাহার।

সভায় বক্তারা বলেন ৩৭ বছর ধরে সিডও সনদ বাস্তবায়নের কথা বলা হচ্ছে কিন্ত সরকারের বলিষ্ঠ পদক্ষেপ নেই। সিডও সনদের ২ এবং ১৬.১-এর (গ) ধারা দুটি সংবিধানের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ, অথচ বাংলাদেশ সরকার নানা কারণ দেখিয়ে থেকে ধারা দুটির উপর সংরক্ষল এখনো বহাল রেখেছেন যা নারীর উন্নয়নে ও সমতা প্রতিষ্ঠায় অন্তরায় হয়ে উঠেছে। রাষ্ট্র দায়বদ্ধ না হলে সিডও সনদ বাস্তবায়ন সম্ভব না।আন্তর্জাতিক প্রতিবেদন তৈরির সময় সরকার সিডও সনদ ও নারী নীতি বাস্তবায়নে কর্মপরিকল্পনা গ্রহনের কথা বললেও বাস্তবায়নে তেমন অগ্রগতি দেখা যায় না। সিডও সনদ বাস্তবায়ন নিয়ে গণমাধ্যমের তৎপরতাও খুব বেশি দেখা যায় না। নীতিমালাগুলো জবাবদিহিতামূলক কাঠামোর মধ্যে এনে সরকারকে বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিতে হবে। পাশাপাশি মনিটরিং, জবাবদিহিতা, বাজেট, জনবল নিশ্চিত না হলে নারীবান্ধব নীতিমালা থাকলেও অর্থনীতিতে নারীর অগ্রগতি টেকসই করা সম্ভব হবে না বলে বক্তারা উল্লেখ করেন।

স্বাগত বক্তব্যে সংগঠনের মালেকা বানু আন্তর্জাতিক ও বাংলাদেশ অঙ্গনে সিডও সনদ গৃহীত হওয়ার কথা উল্লেখ করে বলেন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ এ্যডভোকেসি কার্যক্রমের অংশহিসেবে প্রতিবছর সিডও দিবস পালন করছে। সিডও সনদের ২ এবং ১৬.১-এর (গ) ধারা দুটি সংবিধানের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ কিন্তু বাংলাদেশ সরকার নানা কারণ দেখিয়ে থেকে ধারা দুটির উপর সংরক্ষন এখনো বহাল রেখেছেন যা নারীর উন্নয়নে ও সমতা প্রতিষ্ঠায় অন্তরায় হয়ে উঠেছে। অন্যদিকে জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতিমালা বাস্তবায়নে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের পদক্ষেপ যে ফলপ্রসূ তা বলা যাবেনা। এসময় তিনি অর্থনীতিতে নারীর অবদানকে স্বীকৃতি দিতে, তাদের অংশীদারিত্ব নিশ্চিত করতে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় সিডও সনদ ও জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতিমালা বাস্তবায়নে কার্যকর ভূমিকা পালন করবেন এমন প্রত্যাশা রেখে বক্তব্য শেষ করেন।

বিশেষ অতিথির বক্তব্যে জেন্ডার এন্ড সোশাল ডেভেলপমেন্ট এক্সপার্ট ফেরদৌসী সুলতানা বলেন, নারীদের অংশগ্রহণ কর্মক্ষেত্রে বৃদ্ধি পেলেও তা ধরে রাখতে সরকারের কোটা প্রভিশন বৃদ্ধি পায় নি। নারীর কর্মসূংস্থানে মহিলা ‍ও শিশু মন্ত্রণালয় অন্যান্য মন্ত্রণালয়কে সাথে নিয়ে কাজ করে। ২০১৩ সালের নারী উন্নয়ন নীতি তে কোন মন্ত্রণালয় কতটা কাজ করবে তা বলা ছিলো না। এখন ৫৪ টি মন্ত্রনালয় আছে, মহিলা ‍ও শিশু মন্ত্রণালয় দায়িত্বে থাকলেও অন্যান্য মন্ত্রণালয় নারী বান্ধব কর্মসূচি বাস্তবায়নে সরাসরি যুক্ত। নারী উদ্যোক্তাদের জন্য প্রণোদনা দেয়া হলেও অনেকে এবিষয়ে জানেই না্ ফলে তথ্যগত ঘাটতি থেকে যাচ্ছে। তিনি এসময় বলেন বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে পরিবারের ভূমিকা,নিরাপত্তার অভাব , যথাযথ প্রশিক্ষণের সুযোগ না থাকায় বাল্যবিবাহ বাড়ছে। অনানুষ্ঠানিক খাতে কাজ করা নারীদের জন্য কোন নীতিমালা নেই। আপা (এনুয়াল পারফরমেন্স এগ্রিমেন্ট) তে জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতিমালা, প্রক্রিয়ার মনিটরিং বিষয়ে কিছু রাখা হয়নি।মনিটরিং, জবাবদিহিতা, বাজেট ,জনবল নিশ্চিত না হলে নারীবান্ধব নীতিমালা থাকলেও অর্থনীতিতে নারীর অগ্রগতি টেকসই করা সম্ভব হবে না বলে তিনি মন্তব্য করেন।

বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. বিনায়ক সেন বলেন, ’৭২ এর সংবিধানে সর্বস্তরে নারী-পুরুষের সমতার কথা বলা হয়েছে উল্লেখ করে বিভিন্ন দেশের শ্রমশক্তিতে নারীর অংশগ্রহনের একটি পরিসংখ্যান তুলে ধরে বলেন ১৯৯০ সালে বাংলাদেশে শ্রমশক্তিতে নারীর অংশগ্রহণ ছিল ২৫ % , ২০১৯ সনে এটা ৩৬% উন্নীত হয়, ভারতে বা শ্রীলঙ্কার চেয়ে যা ছিল ৩০% ভাগ থেকে ২০%। যেসব দেশে নারীর অংশগ্রহণ বেশি হয়েছে যেমন: মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া তাদের পরিকল্পনা কর্মসূচী রেফারেন্স হিসেবে দেখা যেতে পারে। আমাদের উন্নতি হলেও অনেক অন্ধকার দিকও রয়েছে। বাল্যবিবাহ বৃদ্ধি পেয়েছে। নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন দরকার অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য, তবে এতে নারীদের অবস্থা যে উন্নত তা বলা যাবে না। গবেষণায় দেখা গেছে যেসকল পোশাক শিল্পের প্রবৃদ্ধি বেশি সেখানে পোশাক শ্রমিকদের মধ্যে সহিংসতা বেশি। নারীদের অধিকার বিষয়ে সামাজিক আন্দোলনহীন কোনো দেশ অর্থনৈতিক সমতায় প্রতিষ্ঠিত হতে পারবে না। শিল্পায়নকে অবশ্যই নারীবান্ধব হতে হবে।

ইউএনউইমেন বাংলাদেশ এর প্রোগ্রাম এনালিস্ট সোহেল রানা বলেন, ৩৭ বছর ধরে সিডও সনদ বাস্তবায়নে দাবি জানানোর পরও সরকারের বলিষ্ঠ পদক্ষেপ নেই। রাষ্ট্র দায়বদ্ধ না হলে সিডও সনদ বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। নারী- পুরুষের সমতা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ৮ম পঞ্চবার্ষিকী সহ অনেক ভালো আইন হলেও বাস্তবায়ন মনিটরিং এর জোর দিতে হবে। আন্তর্জাতিক প্রতিবেদন তৈরির সময় সরকার সিডও সনদ ও নারী নীতি বাস্তবায়নে কর্মপরিকল্পনা গ্রহনের কথা বললেও বাস্তবায়নে তেমন অগ্রগতি দেখা যায় না। সিডও বাস্তবায়ন করতে নীতিমালাগুলো জবাবদিহিতামূলক কাঠামোর মধ্যে নিয়ে আসলে ফলপ্রসূ হবে বলে তিনি মন্তব্য করেন। সিডও সনদ বাস্তবায়নে সরকারকে দায়বদ্ধ করতে ঐক্যবদ্ধভাবে আরো কাজ করার উপর তিনি এসময় জোর দেন।

সাংবাদিক রীতা নাহার বলেন, দীর্ঘ সময় ধরে সিডও সনদের পূর্ণ বাস্তবায়নের জন্য আন্দোলন হলেও খুব বেশি উন্নতি হয়নি। সমতার জায়গায় এখনো অনেক পিছিয়ে। আমরা নিজেরোই এগিয়ে পিছিয়ে যাই। কোভিডের কারণে বাল্যবিয়ে বেড়েছে, এর ফলে শিক্ষায়, অর্থনীতিতে মেয়েরা পিছিয়ে যাচ্ছে। অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে সিদ্ধান্তগ্রহণের নারীকে সুযোগ দিতে হবে, দায়িত্ব দেয়া হলেও ক্ষমতা পুরোপুরি দেয়া হচ্ছে না। সিডও সনদ নিয়ে গণমাধ্যমের তৎপরতা খুব বেশি দেখা যায় না। ধারা ২ সকলের জন্য সমতা প্রতিষ্ঠার রাষ্ট্রের সাথে গণমাধ্যম ও ভূমিকা পালন করতে পারে।

সভাপতির বক্তব্যে ডা. ফওজিয়া মোসলেম বলেন, নারী আন্দোলনের অভিজ্ঞতায় দেখা যায় আন্দোলন যত শক্তিশালী হবে অধিকার প্রতিষ্ঠা তত সহজ হবে। কর্পোরেট ওয়ার্ক কালচার সমস্ত দিককে চালিত করছে। নারীকে কিভাবে তা উপস্থাপন করছে তা দেখতে হবে। তিনি বলেন ৭২ এর আন্দোলনের উজ্জীবিত নারী সমাজ এখনো নারী আন্দোলনকে পরিচালনা করছে, কিন্তু ৯০ এর আন্দোলনের সাথে যুক্ত নারী সমাজকে সাথে নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। সিদ্ধান্তগ্রহণ প্রক্রিয়ায় নারীর অংশগ্রহণ আজ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। নারীর নিজস্ব পরিচিতির জন্য উত্তরাধিকার আইন বাস্তবায়ন করতে হবে। নারী আন্দোলনের মধ্যে যখন বিভিন্ন পেশার আন্দোলন যুক্ত হবে তখন সিডও বাস্তবায়নের ক্ষেত্র তৈরি হবে বলে তিনি মন্তব্য করেন।

লিখিত বক্তব্য উপস্থাপন করেন সংগঠনের ব্রাম্মণবাড়িয়া জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক সাথী চৌধুরী। তিনি সিডও সনদের বিভিন্ন ধারায় ও বাংলাদেশের সংবিধানে অর্থনীতিতে সমানভাবে নারীদের যুক্ত করার কথা উল্লেখ করেন। , নারী অর্থনীতিতে অবদান রাখলেও এখনো নারীদের কাজের ক্ষেত্রে নানা বাধা নারীর অর্থনৈতিক অধিকার ও ক্ষমতায়নের পথে কঠিন প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে রেখেছে। অন্যদিকে করোনা মহামারী নারীদের জন্য নিয়ে এসেছে এক নতুন চ্যালেঞ্জ, বিশ্ব অর্থনীতিতে মন্দা দেখা দেয়ায় কাজ হারিয়েছে অনেক নারী কর্মী। নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের পথে প্রতিবন্ধকতা দূর করার জন্য প্রয়োজন রাষ্ট্রীয় প্রণোদনা, প্রয়োজন সমন্বিত উদ্যোগ; সিডও সনদ এবং জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতির পূর্ন বাস্তবায়নের কথা উল্লেখ করেন তিনি।

সভায় প্রস্তাবনা উপস্থাপন করেন আন্তর্জাতিক উপপরিষদ সদস্য ফেরদৌস জাহান রত্না।

উক্ত অনলাইন মতবিনিময় সভায় কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য,এসিড সারর্ভাইবার্স ফাউন্ডেশন, আউয়াজ ফাউন্ডেশন, আদিবাসী নারী নেটওয়ার্ক এর প্রতিনিধি, উপপরিষদ সদস্য, সাংবাদিক এবং সংগঠনের কর্মকর্তাসহ ৩৫ জন উপস্থিত ছিলেন। সভা সঞ্চালনা করেন সংগঠনের আন্তর্জাতিক উপপরিষদ সম্পাদক রেখা সাহা।