কাঠালের বহুমূখী ব্যবহারের প্রযুক্তি উদ্ভাবন পাওয়া যাবে সারাবছর: লাভবান হবে কৃষকরা

আপডেট: জুলাই ১, ২০২১
0

বাংলাদেশ কৃষি গবেষনা ইনস্টিটিউটঃ

গাজীপুর প্রতিনিধিঃ

আমাদের দেশের জাতীয় ফল কঁাঠাল সংরক্ষনের আধুনিক কোন পদ্ধতি না থাকার কারনে প্রতিবছর বিপুল পরিমান কাঁঠাল নষ্ট হয় । ২০২০-২১ অর্থবছরে বাংলাদেশ কৃষি গবেষনা ইনস্টিটিউট (বারি)’র ফল বিজ্ঞানীদের পরিচালিত এক গবেষনায় দেখা গেছে, দেশে প্রতিবছর মোট ১০ দশমিক ৩৮ লাখ মেট্রিক টন কাঠাল উৎপন্ন হয় । কিন্ত উৎপাদিত এ কাঁঠালের শতকরা ৪০ থেকে ৪৫ ভাগ নষ্ট হয়ে যায়। এতে প্রতিবছর প্রায় ৫শ কোটি টাকার মত ক্ষতির সম্মুখিন হয় কাঁঠাল চাষীরা। বিপুল পরিমান আর্থিক ক্ষতির হাত থেকে চাষীদের রক্ষা করতে এবং কাঠালের বহুমুখী ব্যবহারের মাধ্যমে সারা বছর কাঁঠাল প্রাপ্তি সহজলভ্য করতে গাজীপুরে অবস্থিত বাংলাদেশ কৃষি গবেষনা ইনস্টিটিউটের শস্য সংগ্রহোত্তর প্রযুক্তি বিভাগের ফল বিজ্ঞানীরা উদ্ভাবন করেছেন কাঠাল সংরক্ষন ও বহুমুখি ব্যবহারের ১২টি প্রযুক্তি। এসব প্রযুক্তি ব্যবহার করে ইতোমধ্যেই তারা কাঁঠালের প্রায় ২০টির মত পণ্য উৎপাদন করেছেন। পাশাপাশি প্রযুক্তি ব্যবহারের জন্য তুলনামূলকভাবে স্বল্পমূল্যের যন্ত্রপাতিও উদ্ভাবন করেছেন। অন্যদিকে এ প্রযুক্তিকে সারাদেশব্যাপী ছড়িয়ে দিতে প্রায় ২৫০ জন পুরুষ ও মহিলাকে প্রশিক্ষন প্রদান করা হয়েছে । যাদের মধ্যে বাণিজ্যিকভাবে নানা ধরনের কাঁঠাল পণ্য উৎপাদন করে ইতিমধ্যেই দেশের কয়েকটি সুপারশপে মার্কেটিং শুরু করেছেন অনেকেই ।

বাংলাদেশ কৃষি গবেষনা ইনস্টিটিউটের শস্য সংগ্রহোত্তর প্রযুক্তি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, ঢাকায় বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর সদর দপ্তর এলাকায় কয়েক হাজার কঁাঠাল গাছ রয়েছে। এসব গাছে প্রতিবছর বিপুল পরিমান কাঁঠালের ফলন হয়। কিন্ত কাঁঠালের মৌসুমে সংরক্ষনের অভাবে বিপুল পরিমান কাঁঠাল নষ্ট হয়ে যায় । বিষয়টি কয়েক বছর পূর্বে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নজরে আসে । তিনি কাঁঠাল প্রক্রিয়াজাতকরনের জন্য সংশ্লিষ্টদের প্রতি নির্দেশনা দেন। এছাড়া গাজীপুরসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় প্রতিবছর কাঁঠাল নষ্ট হওয়ার বিষয়টিও দৃষ্টিগোচর হয় দেশের ফল বিজ্ঞানীদের। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা পেয়ে বাংলাদেশ কৃষি গবেষনা ইনস্টিটিউটের শস্য সংগ্রহোত্তর প্রযুক্তি বিভাগের বিজ্ঞানীরা ২০১৯ সালে গবেষনা শুরু করেন। প্রায় ৩ বছরের গবেষনায় তারা এ পর্যন্ত ১২টি প্রযুক্তি উদ্ভাবন করতে সক্ষম হয়েছেন, যেগুলোর সফল বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে। বাংলাদেশ কৃষি গবেষনা ফাউন্ডেশনের অর্থায়নে “কাঁঠাল সংগ্রহোত্তর ব্যবস্থাপনা, পদ্ধতি ও বাজারজাতকরন” (Post Harvest Management , Processing and Marketing of Jackfruits) শীর্ষক প্রকল্পের মাধ্যমে এ গবেষনা কার্যক্রম চলমান রয়েছে। প্রকল্পটির ব্যয় ধরা হয়েছে ২ কোটি ৪৮ লাখ টাকা ।
প্রকল্প প্রধান ও বারি’র শস্য সংগ্রহোত্তর প্রযুক্তি বিভাগের উর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা এম জি ফেরদৌস চৌধুরী জানান, গবেষনার মাধ্যমে যে সব প্রযুক্তি উদ্ভাবন করা হয়েছে, এগুলো প্রয়োগের ফলে কাঁঠাল প্রক্রিয়াজাত ও সংরক্ষনের মাধ্যমে নানা ধরনের মুখরোচক ও স্বাস্থ্যসম্মত খাবার তৈরী করা হচ্ছে । দেশব্যাপী এসব প্রযুক্তির ব্যাপক প্রসারের ফলে দেশের জাতীয় ফল কাঁঠালের বহুমূখী ব্যবহার যেমন বাড়বে, তেমনি গ্রামীণ অর্থনীতিতে ধনাত্নক প্রভাব ফেলবে। প্রতিবছর আমাদের দেশে ১০ দশমিক ৩৮ লাখ মেট্রিকটন কাঁঠাল উৎপাদিত হলেও প্রায় অর্ধেক কাঁঠালই নষ্ট হয়ে যায়। ফলে কৃষকরা বঞ্চিত হয় , আর্থিক ক্ষতির সম্মুখিন হতো তারা । তাছাড়া দেশের সব এলাকায় কাঁঠাল সহজলভ্য না থাকায় জাতীয় ফলের স্বাদ নিতে পারতো না অনেকেই । কিন্ত এখন থেকে মৌসুম ছাড়াও প্রক্রিয়াজাত কাঁঠাল পাওয়া যাবে। দেশের সব জায়গায় বাজারজাত করতে পারলে তা সবার নিকট সহজলভ্য হবে। এছাড়াও এ কৃষিশিল্পে তৈরী হবে অনেক নতুন উদ্যোক্তা।
তিনি জানান, আমাদের উদ্ভাবিত আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে কঁাচা এবং পাকা দুইভাবে কঁাঠাল প্রক্রিয়াজাত করা যায় । এসব প্রযুক্তির মাধ্যমে বর্তমানে প্রায় ২০ ধরনের খাদ্য প্রস্তত করা হচ্ছে, যেগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে-কাঁঠালের চিপস, আচার, চাঁটনী, জ্যাম, জেলী, কাঁঠাল সত্ত্ব, ফ্রেশ কাট (কঁাচা), ফ্রেশ কাট (পাকা), চিনির দ্রবনে কাঁঠাল, কাঁঠাল শুটকী (জবধফু ঃড় বধঃ), এঁচোর, লবন দ্রবনে কাঁচা কাঁঠাল (দীর্ঘ সময় সংরক্ষনের জন্য), ড্রাইড পাউডার, ভেজিটেবল রোল, অসমোটিক্যালী ডিহাইড্রেট জেকফ্রুট, রোস্টেড জেকফ্রুট সিড ইত্যাদি। কাঁঠালশিল্পকে কেন্দ্র করে দেশের ৪টি বিভাগের ৮টি জেলা গাজীপুর, ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল, রাজশাহী, নওগা, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম ও খাগড়াছড়িতে ২৫০ জন উদ্যোক্তাকে প্রশিক্ষন দেওয়া হয়েছে, যাদের মধ্যে অনেকেই এসব পণ্য উৎপাদন করে বাজারজাত শুরু করেছেন। ইতোমধ্যে রাজধানীর মিনাবাজারসহ কয়েকটি সুপারশপে বিক্রি হচ্ছে তাদের উৎপাদিত পণ্য । আন্তর্জাতিকভাবে বিভিন্ন দেশে বাজারজাত করার জন্যও কেউ কেউ প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
গাজীপুরের মধ্যে সবচেয়ে বেশী কাঁঠাল উৎপাদন হয় কাপাসিয়া উপজেলায় । এ উপজেলার চাঁদপুর ইউনিয়নের একজন অবসরপ্রপ্ত উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা মমতাজউদ্দিন কৃষি সেক্টরের তাঁর দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে কাঠাল প্রক্রিয়াজাতকরনে সংগঠিত করেছেন এলাকার বেশকিছু মহিলাকে। তিনি জানান, বিভিন্ন গ্রামে ২০টি ইউনিট গঠনের মাধ্যমে তিনি কাঠাল সংগ্রহ ও সংরক্ষনের বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু করেছেন। এতে গ্রামীণ অর্থনীতিতে বিরাট ভূমিকা রাখবে তার এ প্রচেষ্টা। প্রতিবছর কাপাসিয়ার অনেক কাঁঠাল নষ্ট হয়ে যায়। কৃষকরা ন্যায্যমূল্য পায় না। প্রক্রিয়াজাতকরন ব্যাপকভাবে শুরু করতে পারলে এ সমস্যার সমাধান হবে।
ঢাকার কাওলা এলাকার ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা আছমা সরকার নিজে প্রশিক্ষন নিয়েছেন গাজীপুরের কৃষি গবেষনা ইনস্টিটিউট থেকে। তিনি জানান, তার প্রতিষ্ঠান প্রসপারেটিভ এর মাধ্যমে গত বছর উৎপাদনে যান তিনি। কিন্ত করোনার কারনে বেশী দূর এগোতে পারেননি। এবার কয়েকজন নারী কমর্ীকে সাথে নিয়ে কঁাচা কাঠালের বিভিন্ন প্রডাক্ট উৎপাদন করে বাজারজাত শুরু করেন। তিনি মিনাবাজারের উত্তরা, শান্তিনগর ও ধানমন্ডি শাখায় তার পণ্য বিক্রি করছেন। এছাড়াও শেওে বাংলা নগরে অবস্থিত কৃষক বাজারে নিয়মিত বাজরজাত করছেন। তিনি পাকা কাঁঠালের পণ্যও উৎপাদন করছেন। তিনি জানান, কাঠালের এসব প্রক্রিয়াজাত পণ্যের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। সঠিকভাবে মার্কেটিং করতে পারলে ও সরকারের সহযোগিতা পেলে দেশের কৃষি অর্থনীতিতে এটা বিরাট ভূমিকা পালন করবে।
এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে বাংলাদেশ কৃষি গবেষনা ইনস্টিটিউটের শস্য সংগ্রহোত্তর প্রযুক্তি বিভাগের মূখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা হাফিজুল হক খান বলেন, সারা বিশ্বে কাঁঠালকে কেন্দ্র করে একটি বাজার চলমান থাকলেও আমাদের দেশে বিপুল পরিমান কাঁঠাল নষ্ট হচ্ছিল। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী আমরা অবশেষে কাঁঠাল প্রক্রিয়াজাতকরন শুরু করেছি। এখন উদ্যোক্তা তৈরী ও নিরাপদ এ খাদ্য বাজারজাতকরনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে । সারা বছর ধরে এ ফলের স্বাদ আস্বাদনের পাশাপাশি জাতীয় অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে এসব প্রযুক্তির ব্যবহার।
####
মোঃ রেজাউল বারী বাবুল
গাজীপুর।