কালীগঞ্জে ভুল চিকিৎসায় প্রসূতির মৃত্যু, হাসপাতালের পরিচালকসহ গ্রেফতার ৭

আপডেট: আগস্ট ২৪, ২০২২
0

গাজীপুর প্রতিনিধিঃ গাজীপুরের কালীগঞ্জে ভুল চিকিৎসায় প্রসূতির মৃত্যুর ঘটনায় স্থানীয় জনসেবা হাসপাতাল এন্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও তার ছয় সহযোগীকে গ্রেফতার করেছে র‍্যাব। রক্তশুন্যতা দেখা দেয়ায় ‘এবি’ পজেটিভ রক্তের পরিবর্তে ‘বি’ পজেটিভ রক্ত পুশ করায় ওই প্রসূতির মৃত্যু হওয়ার ঘটনায় তাদেরকে কালীগঞ্জ উপজেলার বালিগঁাও (বড়নগর) এলাকা থেকে গ্রেফতার করা হয়। বুধবার র‍্যাব-১ এর সহকারী পরিচালক (মিডিয়া) নোমান আহমেদ গ্রেফতারের সত্যতা নিশ্চিত করেছেন।

গ্রেফতারকৃতরা হলো- গাজীপুরের কালীগঞ্জ উপজেলার বালিগঁাও (বড়নগর) এলাকার ওসমান গণির স্ত্রী ও জনসেবা হাসপাতাল এন্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বণ্যা আক্তার (৩১), টাঙ্গাইলের দেলদুয়ার উপজেলার চঁান মিয়ার ছেলে আশিকুর রহমান (২৫), কালীগঞ্জের অরুণ কস্তার মেয়ে সিনিয়র নার্স পরিচয়কারী সঙ্গীতা তেরেজা কস্তা (৩৩), একই উপজেলার ক্লেমেট ক্রশের স্ত্রী জুনিয়র নার্স মেরী গমেজ (৪০), ইয়াসীন সুমনের স্ত্রী রিসিপশনিস্ট শামীমা আক্তার (৩২) এবং নারায়নগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলার মাস্টারবাড়ী এলাকার শরীফ মিয়ার স্ত্রী নার্স সীমা আক্তার (৩৪) এবং গাজীপুরের কালীগঞ্জ থানা এলাকার ইয়াসিন সুমনের স্ত্রী শামীমা আক্তার (৩২)। তাদের কাছ থেকে হাসপাতাল পরিচালনার মেয়াদ উত্তীর্ণ কাগজপত্র উদ্ধার করা হয়।

র‍্যাব-১ এর ওই কর্মকর্তা জানান, গাজীপুরের কালীগঞ্জ উপজেলার তুমুলিয়া ইউনিয়নের দক্ষিণ চুয়ারিখোলা গ্রামের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী আব্দুর রাজ্জাকের স্ত্রী শিরিন বেগমের (৩২) প্রসব ব্যাথা উঠে। শিরিন বেগমের স্বামী ও স্বজনরা তাদের পূর্ব পরিচিত জনসেবা হাসপাতাল এন্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টারের পরিচালক বণ্যা আক্তারের সঙ্গে পরামর্শ কররেন। এসময় বণ্যা তার মালিকানাধীন হাসপাতালে সিজারিয়ান অপারেশন করার জন্য ভর্তি করার পরামর্শ দেয়। পরামর্শ অনুযায়ী গত রবিবার (২১ আগস্ট) শিরিন বেগমকে ওই হাসপাতালে ভর্তি করেন তার স্বামী আব্দুর রাজ্জাক। ভর্তির পর হাসপাতালের ওটি বয় আশিকুর রহমানের তত্ত্বাবধানে ভিকটিম শিরিন আক্তারকে প্রাথমিক চিকিৎসা ও আল্ট্রাসনোগ্রাম করে সিজার করার জন্য অপারেশন থিয়েটারে (ওটি) নেওয়া হয়। ওটিতে হাসপাতালের ডাক্তার মাসুদ গাইনোকোলজিস্ট না হয়েও ভিকটিম রোগীর সিজার করেন। অপারেশনের পর রোগীর ব্লিডিং হওয়ায় ডাক্তারের নির্দেশে আশিকুর রহমান ও বণ্যা আক্তার রোগীর পরিবারকে এবি পজেটিভ রক্ত সংগ্রহ করতে বলেন। ভিকটিমের ভাই ও ননদের ছেলের রক্ত এবি পজেটিভ হওয়ায় প্রথমে ভিকটিমের ভাইয়ের শরীর থেকে এক ব্যাগ রক্ত নিয়ে রোাগীর শরীরে পুশ করে। পরে আরো এক ব্যাগ রক্তের প্রয়োজন হলে ভিকটিমের ননদের ছেলের শরীর থেকে রক্ত নেয়ার জন্য হাসপাতালের বেডে শোয়ানো হয়। এর ফঁাকে হাসপাতালের কর্তব্যরত নার্সরা প্রসূতির শরীরে বি পজেটিভ রক্ত পুশ করে। এবি পজেটিভের পরিবর্তে বি পজেটিভ রক্ত পুশ করায় রোগী খিচুনি শুরু করলে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের অনুপস্থিতে অসুস্থ্য শিরিন আক্তারের চিকিৎসা চালিয়ে যান ওটি বয় আশিকুর রহমান। অবস্থার অবনতি হলে রোগীকে দ্রুত ঢাকায় নিয়ে যাওয়ার জন্য স্বজনদের পরামর্শ দেন বণ্যা আক্তার ও আশিকুর রহমান। স্বজনেরা রোগীকে অ্যাম্বুলেন্সে করে ঢাকা নেয়ার পথে অবস্থার অবনতি হলে তাকে উত্তরার একটি হাসপাতালে নিয়ে যায়। ওই হাসপাতালের কর্তব্যরত চিকিৎসক অ্যাম্বুলেন্সে থাকায় অবস্থায় প্রাথমিক পরীক্ষা করে রোগীকে মৃত ঘোষনা করে। ভুল চিকিৎসায় প্রসূতির মৃত্যুর ঘটনা বিভিন্ন গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। পরে কালীগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তার নির্দেশে কালীগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের গাইনী বিভাগের চিকিৎসক সানজিদা পারভীনকে আহবায়ক করে তিন সদস্য বিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। পরে র‍্যাব-১ এর সদস্যরা ভুল চিকিৎসায় প্রসূতিকে হত্যায় জড়িতদের গ্রেফতার করে।

প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতারকৃতরা জানায়, জনসেবা হাসপাতাল এন্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টারে নিয়মিত কোনো চিকিৎসক থাকতো না। মেয়াদ উত্তীর্ণ কাগজপত্র দিয়ে চিকিৎসা সেবা চালিয়ে যাচ্ছিল হাসপাতালটি। এসব অনিয়মের ভিতর গড়ে প্রতি মাসে ২৫ থেকে ৩০টি সিজারিয়ান অপারেশনসহ প্রায় ৫০টির অধিক বিভিন্ন অপারেশন হতো। হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বন্যা আক্তারের কোনো নার্সিং ডিগ্রী নেই। সে স্থানীয় একটি হাসপাতালে সাত বছর নার্সিং ও আড়াই বছর ব্যাবস্থাপক হিসেবে চাকরি করেছিলেন। পরবর্তীতে যৌথ মালিকানায় এ হাসপাতালটি চালু করেন তিনি।

তিনি আরো জানান, গ্রেফতারকৃত আশিকুর রহমান, সঙ্গীতা তেরেজা কস্তা, মেরী গমেজ, সীমা আক্তার এবং শামীমা আক্তার এসএসসি পাশ। এদের মধ্যে আশিকুর টাঙ্গাইল ম্যাটস থেকে ৩ বছরের ডিএমএফ কোর্স পাস করে হাসপাতালের ওটি বয় হিসেবে কাজ করে আসছিল। নার্স ও ভিকটিম পরিবার তাকে ডাক্তার হিসেবে জানত। সে রোগী তদারকি, ডাক্তারদের সঙ্গে সার্বক্ষণিক সমন্বয় রাখা, বিভিন্ন ধরণের টেস্ট করা ও ডাক্তারদের পক্ষে কাগজপত্রে ভুয়া স্বাক্ষর করার সঙ্গে জড়িত ছিল। সঙ্গীতা তেরেজা কস্তা ৩বছরের জুনিয়র নার্সিং কোর্স পাশ করে সিনিয়র নার্স হিসেবে চাকুরি করছিলেন। সীমা আক্তার নার্স হিসেবে কর্মরত থাকলেও তার নার্সিং কোর্স বা ডিপ্লোমা ডিগ্রী নেই। গ্রেফতারকৃত শামীমা আক্তার রিসিপশনার এবং রোগী দেখার সিরিয়ালার হিসেবে কাজ করে। তার কোন নার্স কোর্স বা ডিপ্লোমা নেই।

র‍্যাব কর্মকর্তা আরো জানান, জনসেবা হাসপাতাল এন্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টারের লাইসেন্সের মেয়াদ গত বছরের ৩০ জুন এবং ট্রেড লাইসেন্সের মেয়াদ চলতি বছরের ৩০ জুন পর্যন্ত ছিল। ফায়ার ও শিল্প প্রতিষ্ঠান লাইসেন্স মেয়াদ উত্তীর্ণ এবং কোনো পরিবশেগত ছাড়পত্র পাওয়া যায়নি। পরবর্তী আইনগত ব্যবস্থা গ্রহনের জন্য গ্রেফতারকৃতদের সংশ্লিষ্ট থানায় সোপর্দ করা হয়েছে।

###