কাশিমপুর কারাগারে ‘ আ’লীগ নেত্রী পাপিয়ার’ নির্যাতনে আইনজীবী রুনা হাসপাতালে(ভিডিও)

আপডেট: জুলাই ৩, ২০২৩
0

স্টাফ রিপোর্টার, গাজীপুর ॥ গাজীপুরে কাশিমপুর মহিলা কেন্দ্রীয় কারাগারে যুব মহিলা লীগের বহিষ্কৃত নেত্রী শামীমা নূর পাপিয়ার মারধর ও নির্যাতনের শিকার শিক্ষানবীশ আইনজীবী রুনা লায়লা এখনো হাসপাতালের বেডে শুয়ে কাতরাচ্ছেন। তিনি গাজীপুরের শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সার্জারি বিভাগের ৭০৭ নম্বর ওয়ার্ডে ভর্তি আছেন। কারাগারে মারধরের শিকার হওয়ার পর থেকে রুনা অসংলগ্নভাবে কথা-বার্তা বলছেন। সোমবার বিকেলে রুনার আব্দুল করিম বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, হাসপাতালে চিকিৎসাধীন তার শিক্ষানবীশ আইনজীবী বোনের অবস্থা এখনো খুব একটা ভালো মনে হচ্ছে না।

কারাগারে নির্যাতনের শিকার রুনা লায়লা (৩৮) গাজীপুরের কাপাসিয়া উপজেলার কড়িহাতা গ্রামের আব্দুল হাইয়ের মেয়ে এবং ঢাকার মৃত একেএম মাহমুদুল হকের স্ত্রী।

হাসপাতালের বেডে শুয়ে রুনা লায়লা জানান, ঢাকার কতোয়ালি থানার একটি মামলায় গত ১৬ জুন (শুক্রবার) তাকে কাশিমপুর মহিলা কেন্দ্রীয় কারাগারে আনা হয়। এ কারাগারে আসার প্রথমদিন থেকেই তার উপর অকথ্য নির্যাতন শুরু হয়। দ্বিতীয় দিন শনিবার (১৭ জুন) ভোর ৫ টায় মাইকিং করে আমাকে কারাগারের বিচার বৈঠকে যেতে বলে। সকাল ৯টায় বিচার বৈঠকে সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আমি ময়লা পরিষ্কার করতে যাই। বিকেল ৪টায় থালা-বাসন পরিষ্কার করি। বিকেলে আমাকে আমার কক্ষ থেকে বদলি করে এ কারাগারে বন্দি শামীমা নূর পাপিয়ার অধিনে ৪০১ নম্বর কক্ষে দেওয়া হয়। পাপিয়া যুব মহিলা লীগের বহিষ্কৃত নেত্রী।

তিনি আরো জানান, পরদিন রবিবার (১৮ জুন) ভোর ৫টায় সোনালী নামে একজন বন্দি মাইকিং করে তাকে বিচার বৈঠকে আসতে বলে। তিনি সেখানে যাওয়ার পর আবার উপরে উঠেন টয়লেটে যাওয়ার জন্য, এরপর তার নামতে দেরি হয়। এটাই ছিল আমার অপরাধ। সকাল ৭টার দিকে ফাতেমা নামে একজন আমাকে ডেকে নেয়। ফাতেমা লাঠি দিয়ে আমাকে আঘাত করে। আমি আত্মরক্ষার্থে হাতের লাঠি ফেরানোর চেষ্টা করি। এতে সে ক্ষিপ্ত হয়ে যায়। আরও মারধর শুরু করে। কিছুক্ষণ পড়ে একটা হাতুড়ি নিয়ে এসে আমাকে হাতুড়ি দিয়ে আঘাত করলে আমি পড়ে যাই। পড়ে যাওয়ার পর লাথি মারে। এসময় হঠাৎ সালমা এসে হাজির হয়। সালমা এসে আমার পড়নের কমলা রঙ্গের জামাটা ছিঁড়ে ফেলে। এমন অবস্থায় তাদের হাত থেকে রক্ষা পেতে আমি সরে যাওয়ার চেষ্টা করে পড়ে যাই। আমাকে ওরা ধরে নিয়ে আসে। নাজমা ও মিনা নামে দুজন গিয়ে আমাকে হাতকড়া পড়তে বলেন। আমি ভয় পেয়ে হাতকড়া পড়তে চাই না। তারা আমাকে জোর করে হাতকড়া পড়ায়। হাতকড়া পড়িয়ে আমাকে একটা নির্জন স্থানে (যেখানে সিসি টিভি ক্যামেরা নেই এমন নির্জন স্থান) নিয়ে যায়। সেখানে নিয়ে অমানুষিক নির্যাতন করে। তারা আবার আমাকে বিচার বৈঠকে নিয়ে আসে। সেখানে এনে আমার দুইহাত দু’দিকে উপরে তুলে লোহার শিকল দিয়ে বেঁধে দেয়। এসময় পাপিয়া এসে লাঠি দিয়ে আমার পায়ে আঘাত করতে থাকে। তখন কারাগারের সবাই আমাকে উঁকি দিয়ে দেখে। আমি আমার শরীর ঢাকতে চেষ্টা করি। পাপিয়ার বেধড়ক পিটুনিতে আমি প্র¯্রাব-পায়খানা আটকাতে পারিনি। আমি তখন পানি চাই। একপর্যায়ে আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। জ্ঞান ফেরার পর আমি বার বার পানি পানি বলে কাঁদতে থাকি। তখন তারা আমাকে খাওয়ার পানি না দিয়ে মলমূত্রসহ ময়লা পানি খেতে দেয় এবং মাথায় ঢেলে দেয়।

রুনা লায়লা বলেন, একটা সময় পাপিয়ার পিটুনিতে আমি মাটিতে পড়ে যাই। মুনিয়া নামে একজন আমাকে আমার জামা পরিবর্তনের কথা বলে ময়লা স্তুপের কাছে নিয়ে যায়। সেখানে নিয়ে পুনঃরায় এলোপাথাড়ি মারধর করে। ওইখানে ঘণ্টা খানেক মারধর করলে আমি আর কিছু বলতে পারি না। চেতনা ফিরে পেলে ওরা আমাকে ওড়না দিয়ে গাছে টানিয়ে ঝুলিয়ে রাখে। আমি খুব অসুস্থ্য বোধ করি। সন্ধ্যায় জেল সুপার ওবায়দুর আমার হাতকড়া খুলে দেন।

তিনি বলেন, কারাগারের হাজতি যুব মহিলা লীগের বহিষ্কৃত ও আলোচিত নেত্রী শামীমা নূর পাপিয়া, চিফ কারারক্ষী শামীমা, মেট্রন (সুবেদার) ফাতেমা, কারারক্ষী হাফিজা, সাহিদা, যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত রক্সি, হাজতি আন্দনিকা, অবন্তিকা, সোনালী, মুনিয়া ও নাজমাসহ কয়েকজন আমাকে বেধড়ক মারধর ও নির্যাতন করেছে।

রুনা লায়লার ভাই আব্দুল করিম বলেন, এ ঘটনায় গত ২৫ জুন গাজীপুরের জেলা প্রশাসকের কাছে নির্যাতনের লিখিত অভিযোগ করেছি। আমার বোন রুনা লায়লা একজন শিক্ষানবীশ আইনজীবী। তাকে এ কারাগারে আনার পর তার সঙ্গে দেখা করার জন্য আমি একাধিকবার কারাগারে যাই, কিন্তু আমাকে বোনের সঙ্গে দেখা করতে দেয়া হয় নি। গেইটে অপেক্ষাকালে কারাগার থেকে জামিনে বের হয়ে আসা লোকের মাধ্যমে জানতে পারি, কারাগারের ভিতর আমার বোনকে পিটিয়ে গুরুতর আহতাবস্থায় ফেলে রাখা হয়েছে। এ খবর পেয়ে আমি বোনকে উদ্ধার ও তার সঙ্গে দেখা করার জন্য কারা কর্মকর্মকর্তাদের সঙ্গে সাক্ষাত করে অনুরোধ করি। কিন্তু তারা আমার আবেদন রক্ষা করেনি। কারাগারের ডেপুটি জেলার জান্নাতুল তায়েবা জানান, আপনার বোনের কিছুই হয় নি, তার সঙ্গে সাক্ষাত করা যাবে না। বোনের সঙ্গে দেখা করার পীড়াপীড়ির এক পর্যায়ে তিনি অন্য মহিলাকে দিয়ে আমার বোন সাজিয়ে আমার ফোনে কথা বলান।

রুনার বোন রওশন আরা জানান, সোমবার (২৬ জুন) রুনা লায়লার জামিন মঞ্জুর করেন ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন আদালতের বিচারক আরফাতুল রাকিব। আদালত থেকে জামিনের কাগজ কারাগারে পৌছানোর পর তা যাচাই বাছাই করে পরদিন মঙ্গলবার (২৭ জুন) বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে মুক্তি পায় রুনা লায়লা। এরপর তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।

শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সার্জারি বিভাগে সহযোগী অধ্যাপক শামসুল হুদা বলেন, রোগীর শরীরে রক্ত শূন্যতা দেখা গেছে। বেশ কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে দেওয়া হয়েছে, সেগুলোর রিপোর্ট আসেনি। রিপোর্টগুলো আসার পর রোগীর প্রকৃত অবস্থা জানা যাবে।

কাশিমপুর মহিলা কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার (ভারপ্রাপ্ত) ওবায়দুর রহমান বলেন, ওই নারী গোপনে ৭ হাজার ৪০০ টাকা নিয়ে কারাগারে আসেন। বিষয়টি পরদিন তদন্ত করে পাওয়া যায়। টাকার বিষয়ে কারাগারের হাবিলদার ফাতেমা বেগম জানতে চাইলে তার সঙ্গে খারাপ আচরণ করেন। এ নিয়ে কয়েকজন কয়েদি তাকে চড়-থাপ্পড় মারেন। পরে তাকে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। তাকে যারা চড়-থাপ্পড় মেরেছিল, তাদের কারাবিধি অনুযায়ী শাস্তি দেওয়া হয়েছে।

###