গংগাচড়ায় বিএনপি পুলিশ-রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ : সাংবাদিকসহ আহত ৭৫

আপডেট: সেপ্টেম্বর ৯, ২০২২
0

রংপুরের গংগাচড়ায় বিএনপির মিছিলে পুলিশের বাধা দেয়া নিয়ে বিএনপির সাথে সংঘর্ষে ২২ পুলিশ, ৫ সাংবাদিকসহ অন্তত ৭৫ জন আহত হয়েছেন। এ সময় লাঠিচার্জ ছাড়াও শতাধিক রাউন্ড রাবার বুলেট, টিয়ারশেল নিক্ষেপ করে পুলিশ।

বৃহস্পতিবার (৮ সেপ্টেম্বর) বিকেলের এ ঘটনায় গুলিবিদ্ধ হয়েছেন অন্তত ২০ পথচারী, ব্যবসায়ী ও বিএনপিকর্মী। একজনের চোখে গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। তাকে ঢাকা নেয়ার পরামর্শ দেয়া হয়েছে। গ্রেফতার হয়েছেন সাতজন। এ ঘটনায় পুলিশ ও যুবলীগ দু’টি মামলা করেছে। এদিকে গুলিবিদ্ধ দুই ছাত্রদল নেতাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকায় নেয়া হয়েছে।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, বৃহস্পতিবার বিকেলে সাড়ে ৫টার দিকে দ্রর্ব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি এবং বিভিন্নস্থানে নেতাকর্মীদের হত্যার প্রতিবাদে গঙ্গাচড়া উপজেলা সদরে বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে জিরো পয়েন্টের দিকে এগুতে থাকে বিএনপি নেতাকর্মীরা। এ সময় পুলিশ মিছিলে বাঁধা দিয়ে উপজেলা ছাত্রদলেল আহ্বায়ক কমিটির সদস্য অয়ন ইসলামকে গ্রেফতারের চেষ্টা করলে শুরু হয় দুইপক্ষের মধ্যে বাকবিতণ্ডা। একপর্যায়ে পুলিশ লাঠিচার্জ শুরু করলে বিএনপি এবং অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরাও ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে। আধা ঘণ্টাব্যাপী এ সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে আশেপাশের দোকানপাটগুলোতে। পুলিশ রাবার বুলেট ও টিয়ারশেল নিক্ষেপ করে নেতাকর্মীদের হটিয়ে দেয়।

এতে গঙ্গাচড়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) দুলাল হোসেনসহ ২২ পুলিশ সদস্য, স্থানীয় সাংবাদিক আব্দুল বারী স্বপন, সুজন আহমেদ, কামরুজ্জামান লিটন, সাজু এবং অন্তত ৫০ জন বিএনপি ও অঙ্গ সংগঠন, পথচারী, ব্যবসায়ী আহত হন। আহত পুলিশ, সাংবাদিক এবং গুলিবিদ্ধরা স্থানীয় উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন। অন্যরা রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন।

এদিকে ঘটনার পর রাত ৮টার দিকে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগ একটি মিছিল নিয়ে গিয়ে বিএনপি অফিসের সাইনবোর্ড ভাংচুর করে মাটিতে ফেলে দেয়। অফিস ভাংচুরের চেষ্টা করলে পুলিশ তা ঠেকিয়ে দেয়।

রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন দোকান কর্মচারী রিংকু মিয়া জানান, আমার চোখে গুলি লেগেছে। ঝাপ লাগাতেই পারিনি। তাতেই আমার চোখে এসে গুলি লাগে। সারা মুখেও গুলি লেগেছে। ডাক্তার বলেছেন, আমাকে ঢাকায় নিয়ে যেতে হবে। কিন্তু এতো টাকা আমি কোথায় পাবো। আমি একজন দোকান কর্মচারী আমার কী দোষ। পুলিশ কেন দোকানে দোকানে গুলি ছুড়লো। তিনি বলেন, আমার সাথে আরো ১৩ জন গুলিবিদ্ধ ব্যক্তি ভর্তি হয়েছিল এই হাসপাতালে।

উপজেলা হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা গুলিবিদ্ধ জুতার দোকান কর্মচারী আরিফুল ইসলাম জানান, সংঘর্ষের সময় আমরা ঝাপ লাগাতে শুরু করি। এ সময় পুলিশ রাবার বুলেট মারে। তখন রাবার বুলেট আমার শরীরে এসে লাগে। আমার মালিকেরও লাগে।

স্থানীয় জিরো পয়েন্টের গালামালের গুলিবিদ্ধ দোকানদার গোলাম জানান, কিছু বুঝে ওঠার আগেই পুলিশেরে গুলি এসে আমার সারা শরীরে লাগে। আমি দোকান বন্ধ করার সময়ই পাইনি। পুলিশ বৃষ্টির মতো গুলি করেছে। আমাদের অনেক দোকানদারদের গুলি সারা শরীরে লেগেছে। এখন যে আমাদের কী হবে বুঝতে পারছি না। হাসপাতালে এসে ড্রেসিং করে নিলাম।

গঙ্গাচড়া উপজেলা প্রেসক্লাবের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আব্দুল বারি স্বপন জানান, ঘটনার সময় তথ্য ও ছবি সংগ্রহ করতে গিয়ে আমিসহ পাঁচ সাংবাদিক আহত হয়েছি। এরমধ্যে আমার পুলিশের রাবার বুলেট লেগেছে। আর অন্যদেরকে লেগেছে বিএনপি নেতাকর্মীদের ইটপাটকেল।

উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আখেরুজ্জামান লিটন অভিযোগ করে বলেন, পুলিশ আমাদের যেভাবে নির্দেশনা দিয়েছিল। ঠিক সেভাবেই আমরা মিছিল করে সমাবেশে স্থলে যাচ্ছিলাম। কিন্ত হঠাৎ করেই পুলিশ বাধা দেয়। আমি পেছনে ফিরে দেখি একজন যবুলীগের ছেলে পুলিশকে লক্ষ্য করে ইট ছুঁড়ছে। তখন আমি তাকে ধরে ফেলি এবং বলি তুমি এখানে কেনো। এটা কী করছো। এটার প্রমাণ পুলিশসহ সবাই এখানে আছে। যেহেতু কর্মসূচিতে হাজার হাজার মানুষ হয়েছিল। পুলিশকে উত্তেজিত করতে যুবলীগ-ছাত্রলীগের ছেলেরা মিছিলের ভেতরে ঢুকে বাধা দেয়ার সময় পুলিশকে লক্ষ্য করেও ইটপাটকেল ছুড়েছে। আমরা এ ঘটনার তীব্র নিন্দা জানাই।

উপজেলা বিএনপির সভাপতি ওয়াহেদুজ্জামান মাবু জানান, কোনো কারণ ছাড়াই আমাদের পুলিশে বাধা দিয়ে লাঠিচার্জ, টিয়ারশেল, ছড়্ড়াগুলি এবং রাবারবুলেট নিক্ষেপ করেছে। এতে আমাদের ৫০ জন নেতাকর্মী গুলিবিদ্ধসহ ১০/১২ জন সাধারণ ব্যবসায়ী ও পথচারি আহত হয়েছেন। আমাদের সাতজন নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। মিথ্যা মামলা দায়ের করা হয়েছে। এ ঘটনার নিন্দা জানাই। জড়িত পুলিশদের শাস্তি এবং গ্রেফতারকৃতদের মুক্তি না দিলে গঙ্গাচড়ায় লাগাতর আন্দোলন গড়ে তোলা হবে।

এদিকে রাতেই আহত নেতাকর্মীদের দেখতে ছুটে আসেন বিএনপির রংপুর বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক আসাদুল হাবিব দুলু। তিনি বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হওয়া গুলিবিদ্ধ নেতাকর্মীদের পাশে যান এবং তাদের চিকিৎসার খোঁজখবর নেন।

জেলা বিএনপির সদস্য সচিব আনিছুর রহমান লাকু জানান, গঙ্গাচড়া উপজেলা ছাত্রদলের আহ্বায়ক কমিটির সদস্য তুষার আহম্মেদ ঢিউলিটি এবং মুরছালিন আহমেদের অবস্থা খারাপ হওয়ায় তাদের বৃহস্পতিবার মধ্যরাতেই অ্যাম্বুলেন্স যোগে ঢাকায় নিয়ে যাওয়া হয়। তিনি এই নগ্ন হামলার বিচার বিভাগীয় তদন্ত দাবি করে বলেন, অতি উৎসাহী পুলিশ বিএনপির মিছিলে গুলি টিয়ারশেল ছুড়েছে। তারা চিহ্নিত। তাদেরকে আইনের আওতায় আনতে হবে। এরা চিহ্নিত। এই সরকার তাদের বিচার না করলে জনগণের সরকার তাদের বিচার করবে।

এদিকে রংপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার হোসেইন মোহাম্মদ রায়হান জানান, দৃব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির প্রতিবাদ জানাতে বিক্ষোভ মিছিল করার জন্য গঙ্গাচড়া উপজেলা বিএনপি এবং অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা একত্রিত হয়েছিল। পুলিশ আগেই রুট ঠিক করে দিয়েছিল যে তারা মিছিলটা কোথায় থেকে শুরু হবে এবং সমাবেশটা কোথায় করবে। প্রাথমিকভাবে তারা এটি মেনে নিলেও বিক্ষোভ মিছিলের সময় যখন তারা পথসভা করতে যায় তখন তারা তাকওয়া মসজিদ হয়ে আশা এনজিও রোডটি না ধরে জেলা পরিষদের রোডটি ধরার চেষ্টা করে। তখন পুলিশ সেখানে তাদের বাধা দিয়ে তাদেরকে বোঝানোর চেষ্টা করে। তখন মিছিলের সামনে অংশের অনেকেই সেটা মেনে নয়। কিন্তু তখন পেছনের নেতাকর্মীরা বলাবলি শুরু করেন সামনে মারধর করা হচ্ছে, গ্রেফতার করা হচ্ছে। এই একটা গুজবকে কেন্দ্র করে বিএনপির প্রায় আড়াই হাজার নেতাকর্মী পুলিশের ওপর ইটপাকেল নিক্ষেপ শুরু করে। এতে আমাদের অফিসার ইনচার্জসহ ২০ জন আহত হন।

পুলিশের এই কর্মকর্তা আরো জানান, তখন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ প্রায় ৫০ রাউন্ড রাবার বুলেট ও টিয়ারশেল ফায়ার করতে হয়। এখন সবকিছু আমাদের নিয়ন্ত্রণে আছে। এ বিষয়ে সরকারি কাজে বাধা দেয়া এবং পুলিশের ওপর হামলার বিষয়ে মামলা করার প্রস্ততি চলছে।

এ ঘটনায় সরকারি কাজে বাধা ও পুলিশের ওপর হামলার ঘটনায় ৫৫ জন বিএনপি নেতাকর্মীর নাম উল্লেখ করে পুলিশ বাদি হয়ে এবং যুবলীগ নেতা আহত হওয়ার ঘটনায় অপর একটি মামলা হয়েছে।

এদিকে শুক্রবার দুপুরে উপজেলা আওয়ামী লীগ বিএনপির বিরুদ্ধে পুলিশের ওপর হামলার অভিযোগ এনে তাদের বিচারের দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করেছে।