গাজীপুরে সুজনের নাগরিক সংলাপ :’সিটি নির্বাচনে এখনো লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি হয়নি’

আপডেট: মে ৩, ২০২৩
0

** দুর্নীতি মুক্ত সিটি কর্পোরেশন গড়ে তোলাই হবে আমার প্রধান কাজ —আ.লীগ প্রার্থী আজমত উল্লা

** গাজীপুর সিটি নির্বাচনে এখনো
লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি হয়নি– রনি সরকার।

স্টাফ রিপোর্টার, গাজীপুর : আসন্ন গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হওয়ার লক্ষ্যে সু শাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) এর উদ্যোগে গাজীপুর নাগরিক সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়েছে। গাজীপুর প্রেসক্লাব মিয়নায়তনে আয়োজিত এ সংলাপ অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন সুজনের গাজীপুর শাখার সভাপতি আমজাদ হোসেন। বুধবার ‘গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন-২০২৩, প্রত্যাশা ও করণীয়’ শীর্ষক নাগরিক সংলাপে উপস্থিত ছিলেন গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের সাতজন মেয়র প্রার্থী।

সুজনের জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক ইফতেখার শাহরিয়ারের সঞ্চালনায় মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনা করেন সুজনের জেলা শাখার সহ-সভাপতি অ্যাডভোকেট সুনীল কুমার সরকার। সংলাপ অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী অ্যাডভোকেট আজমত উল্লা খান, স্বতন্ত্র প্রার্থী সরকার শাহনূর ইসলাম রনি,দ
ইসলামী আন্দোলনের মেয়র প্রার্থী গাজী আতাউর রহমান, স্বতন্ত্র প্রার্থী আব্দুল্লাহ আল মামুন ও হারুন অর রশীদ, জাকের পার্টির মেয়র প্রার্থী রাজু আহমেদ, গণফ্রন্টের মেয়র প্রার্থী আতিকুল ইসলাম। তবে অনুষ্ঠানে জাতীয় পার্টির মেয়র প্রার্থী এমএম নিয়াজ উদ্দিন ও সাবেক মেয়র মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলমের মা জায়েদা খাতুন উপস্থিত ছিলেন না।

সংলাপ অনুষ্ঠানে সুজনের কেন্দ্রীয় নির্বাহী সদস্য ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রুবায়েত ফেরদৌস, সুজনের প্রধান সমন্বয়কারী দিলীপ সরকার, আঞ্চলিক সমন্বয়কারী তৌফিক জিল্লুর রহমান নদী বঁাচাও আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট আনোয়ার হোসেন, হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের ফেডরিক মুকুল বিশ্বাস, গাজীপুর জেলা নাগরিক ফোরামের সভাপতি অ্যাডভোকেট জালাল উদ্দিন, গার্মেন্টস শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়নের জিয়াউল কবির খোকন, ইমাম সমিতির মাওলানা নূরুল ইসালাম, প্রাইভেট হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার ওনার্স এসোসিয়েশনের হাজী আঃ সালাম প্রমুখ সহ ২৫টি পেশার প্রতিনিধিবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।

সংলাপে অংশগ্রহনকারী ব্যক্তিবর্গ ও মেয়র প্রার্থীগণ তাদের বক্তব্য তুলে ধরেন। তারা বিগত ১০ বছরেও গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন নাগরিকদের মৌলিক চাহিদা পূরণ করতে না পাড়ায় সাধারণ ভোটার ও নাগরিক সমাজ উদ্বেগ প্রকাশ করেন।

সুশাসনের জন্য নাগরিকের নাগরিক সংলাপে যোগ দিয়ে স্বতন্ত্র প্রাথর্ীরা নির্বাচনকে অবাধ নিরপেক্ষ গ্রহণযোগ্য করার জন্য তাগিদ দেন। অন্য দিকে আওয়ামীলীগের প্রাথর্ী সিটি করর্পোরেশনে জনগণকে সম্পৃক্ত করে জবাবদিহিতার আওতায় আনতে চান। সুষ্ঠু ভোট অনুষ্ঠিত করতে ক্ষমতাশীন দলের প্রতি আহবান জানায় সুজনের কেন্দ্রীয় নেতারা। সুশাসনের জন্য নাগরিকের আয়োজনে গাজীপুর সিটি করর্পোরেশন নির্বাচনে প্রত্যাশা ও করনীয় শীর্ষক নাগরিক সম্মেলনে এক টেবিলে বসে নাগরিকদের বিভিন্ন সমস্যা ও সংকটের কথা শুনেছেন মেয়র প্রাথর্ীরা। পরে উপস্থিত নাগরিকদের প্রার্থীরা গাজীপুর সিটির বিভিন্ন সমস্যা সমাধান কল্পে নাগরিকদের জন্য প্রতিশ্রুতি তথা আশ্বাসের কথা শোনান।

আওয়ামীলীগ মনোনীত মেয়র প্রাথর্ী অ্যাডভোকেট আজমত উল্লা খান বলেন, আমি মেয়র পদে নির্বাচিত হলে দুর্নীতি মুক্ত সিটি কর্পোরেশন গড়ে তোলাই হবে আমার প্রধান কাজ। আমি ১৮ বছর টঙ্গী পৌরসভার মেয়র ছিলাম ১৮ বছরে আমার বিরুদ্ধে কেউ ১৮ টাকার দুর্নীতির অভিযোগ আনতে পারেনি। এখানে স্বচ্ছতা থাকবে, জবাবদিহিতা থাকবে এবং জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত থাকবে।

তিনি গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনে জনগণকে সংম্পৃক্ত করে জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে। একটি অর্গানোগ্রাম ছাড়া সিটি কর্পোরেশন চলছে। এটা কোনো অবস্থাতেই হতে পারে না। সার্ভিস রোল ছাড়া ১০ বছর যাবৎ সিটি কর্পোরেশন চলছে। আমি নির্বাচিত হতে পারলে প্রথমেই ৬ মাসের মধ্যে একটি অর্গানোগ্রাম এবং একটি সার্ভিস রোল তৈরি করা হবে।

আজমত উল্লা খান আরো বলেন, গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন করার পরে প্রধানমন্ত্রী এ যাবৎকাল একটি প্রকল্পে তিনি ৭০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছেন। আরেকটি প্রকল্পে প্রাথমিক অবস্থায় এক হাজার ৫১০ কোটি পরবর্তীতে তা বেড়ে এক হাজার ৫৪৯ কোটি টাকা হয়েছে। আরেকটি প্রকল্পে একনেক থেকে পাশ হয়ে ৩ হাজার ৮২৮ কোটি টাকা দিয়েছে নগরীতে ময়লা আবর্জনার ব্যস্থাপনা ও ট্রাক বাসস্ট্যান্ড করার জন্য প্রধানমন্ত্রী ৭৮২ কোটি টাকা দিয়েছেন। এ টাকাগুলো দেওয়ার পর যে সময়সীমা ছিল তার অনেকটা সময়সীমা অতিক্রান্ত হয়ে গেছে। শুধুমাত্র অদক্ষতার কারণে এটা বাস্তবায়িত করা সম্ভব হয়নি। আমি নির্বাচিত হলে বিশ্বের সর্বাধুনিক যে প্রযুক্তি সেটা এনে এ বর্জ্যটাকে সম্পদে রূপান্তরিত করবো।

সংলাপ অনুষ্ঠানে স্বতন্ত্র মেয়রপ্রার্থী সরকার শাহনূর ইসলাম রনি বলেন, নির্বাচন সুষ্ঠু হলে তবেই প্রার্থীরা তাদের নির্বাচনী অঙ্গীকার রক্ষা করতে পারবেন। নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ না হলে নাগরিকদের প্রত্যাশা পূরণ হবে না। তিনি বলেন, বিগত ২০১৮ সালের গাসিক নির্বাচনে কতটুকু দুর্নীতি ও অনিয়ম হয়েছিল তা সকলেই জানেন। ওই নির্বাচনে আমার বড় চাচা বীর মুক্তিযোদ্ধা হাসান উদ্দিন সরকার মেয়রপ্রার্থী হয়েছিলেন। প্রশাসন দিয়ে কেন্দ্র দখল করে এবং ব্যাপক কারচুপির মাধ্যমে তার সুনিশ্চি বিজয় ছিনিয়ে নেয়া হয়েছিলো। ডিবি পুলিশ দিয়ে কেন্দ্র থেকে এজেন্টদের ধরে নিয়ে দূর-দূরান্তের বিভিন্ন ডিস্টিকে ছেড়ে দেয়া হয়েছিল। তখন অনেক এজেন্টের পকেটে টাকাও ছিল না। তাদেরকে মানুষের কাছে ভিক্ষা করে গাড়ি ভাড়া সংগ্রহ করে বাড়ি ফিরতে হয়েছিল। এবারের নির্বাচনেও যাতে এমন পরিস্থিতি না হয় সেজন্য তিনি সকলের সহযেগিতা কামনা করেন।
তিনি বলেন, আমরা যারা প্রার্থী হয়েছি তারা কেউ নিজেদের ব্যক্তি স্বার্থের জন্য প্রার্থী হয়নি। শুধু নগরবাসীর স্বার্থে একটি সুন্দর নগরী গড়ার প্রত্যয়ে আমরা প্রার্থী হয়েছি। নগরীর সকলের সমস্যাগুলো সামনে রেখেই আমরা নির্বাচনী ইশতেহার প্রস্তুত করবো। নাগরিকদের চাহিদাগুলো সামনে রেখে যেভাবে নগরীকে সাজালে সুন্দর হয় সেভাবেই সকলের সহযোগিতা নিয়ে নগরীটাকে সুন্দরভাবে সাজাবো।
সংলাপে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ মনোনীত মেয়রপ্রার্থী গাজী আতাউর রহমান বলেন, সিটি করপোরেশন কোনো স্বাধীন সংস্থা নয়। কেন্দ্রীয় সরকার না চাইলে এখানে মেয়ররা কিছু করতে পারেন না। গাজীপুর সিটি করপোরেশন ভালো চলুক তা কেন্দ্রীয় সরকারই চায় না। গাসিকের প্রথম মেয়র অধ্যাক এম এ মানানকে জেলে নিক্ষেপ করা হয়েছিলো, বর্তমান মেয়র জাহাঙ্গীর আলমকেও দায়িত্ব পালন করতে দেয়া হয়নি।
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রার্থী গাজী আতাউর রহমান প্রার্থীদের এসব প্রতিশ্রুতির আশ্বাস দেয়ার আগে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হওয়া নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, বিগত সিটি নির্বাচনের মত ভোট কারচুপির নির্বাচন আর দেখতে চান না তঁারা। আগে সুষ্ঠু নির্বাচন পরে হলো উন্নয়নের বিষয়। সুষ্ঠ ভোট করতে তিনি সুজন ও নির্বাচন কমিশনের প্রতি সহযোগিতার অনুরোধ জানান। এ সিটি গঠনের পর থেকে কেন্দ্রীয় সরকার বৈষম্য করেছে। এ সিটির প্রথম নির্বাচিত মেয়রকে তার দায়িত্ব পালন করতে দেয়নি। তাকে নির্যাতন করে জেলে আবদ্ধ করে রাখা হয়েছে। দ্বিতীয় মেয়রকেও তারদায়িত্ব পালন করতে দেয়নি। অতএব আমি মনে করি গাজীপুর সিটি কপোর্রেশন একটি সুন্দর, সঠিক এবং পরিবেশ বান্ধব সিটি হোক এটা কেন্দ্রীয় সরকার চায় না।

স্বতন্ত্র মেয়র প্রাথর্ী আব্দুল্লাহ আল মামুন মন্ডল বলেন, এ নগরের সর্বোচ্চ আয় শিল্প-কলকারখানা এবং শ্রমিকের ঘাম জড়ানো অংশ থেকে আসে। বাংলাদেশের সর্বোচ্চ রপ্তানী আয় আসে গাজীপুর থেকে। গাজীপুরের সমৃদ্ধ যে অর্থনীতি এটাও এখানকার শ্রমিকের ঘাম জড়ানো অর্থ থেকে। সরকারের কাছে আমার বিশেষ আবেদন থাকবে এখান থেকে রাষ্ট্রের যে আয় হয়, তার একটা নির্দিষ্ট অংক যেন গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনকে দেয়া হয় শ্রমিক অধ্যুষিত এ এলাকার উন্নয়নের জন্য। প্রাইভেট হাসপাতালের বর্জ্য বিশেষভাবে অপসারনের জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। বায়ু দুষণ, শব্দ দূষন, পানি দূষন, নদী দূষন এবং দূষনমুক্ত নগরী গড়ে তুলতে হলে আগে বুকে ধারণ এবং মনে লালন করতে হবে। আগে সিটির উন্নয়ন করতে হবে। পরে পর্যায়ক্রমে সকল পেশাজীবী ও নগরবাসীর উন্নয়ন করা হবে। তিনি আরো বলেন, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, আদবিাসী, উপজাতি ও মুসলিম সকল বর্ণ পেশার মানুষের জন্য মেহনতি ইনসাফ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে একটি শান্তির নগরী গড়ে তোলাই আমার মূল লক্ষ্য। আমি বিজয়ী হলে সকল প্রার্থীর সহযোগীতা নিয়ে সিটিকে আধুনিক ও স্মার্ট নগরী হিসেবে গড়ে তুলবো।

গণফ্রন্টের প্রার্থী আতিকুল ইসলাম বলেন, আমি গত ৫ বছর আগে থেকে মেয়র প্রার্থীতা ঘোষনা দিয়েছি। ঘোষনার পর থকে নগরের ৫৭ টি ওয়ার্ডে ৫৭ হাজারের বেশি সমস্যা আমি খঁুজে পেয়েছি।

গাজীপুর বিএম কলেজের সহকারী অধ্যাপক আসাদুজ্জামান আকাশ জানান, নির্বাচন সংশ্লিষ্ট কাজের সঙ্গে যেসব পেশাজীবীরা ভোট গ্রহণের সঙ্গে সম্পৃক্ত তাদেরকে যেন কোন কিছুতে অনৈতিক কাজে বাধ্য করা না হয়। তাদের আইশৃঙ্খলা বাহিনী কতর্ৃক অথবা কোন না কোনো অদৃশ্য চাপে যেন তঁার দায়িত্বটা অনৈতিকভাবে পালনের জন্য বাধ্য করা না হয়।

সুজনের কেন্দ্রীয় কমিটির নির্বাহী সদস্য অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস বলেন, ভোট চুরি করে নির্বাচিত হওয়া যায়, তবে মানসিক তৃপ্তি আসে না। জনগণকে দেখলে মুখ লুকায় ওসব প্রাথর্ীরা। তাই সুষ্ঠ ভোট অনুষ্ঠিত করতে ক্ষমতাশীন দলের প্রতি আহবান জানান সুজনের কেন্দ্রীয় এই নেতা।

সুশাসনের জন্য নাগরিক নির্বাচন কমিশনের কাছে প্রত্যাশা অবাধ, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশ সৃষ্টি, সকল দল ও প্রাথূদের জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করা, কালো টাকা ও পেশী শক্তির প্রভাবমুক্ত নির্বাচন অনুষ্ঠান, আইনশৃঙ্খলা বাহীনীসহ নির্বাচনে দায়িত্বে নিয়োজিত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করা এবং ভোট কেন্দ্রে অনিয়ম হলে সেই কেন্দ্রের ভোট স্থগিত করা ও প্রয়োজনে ফলাফল বাতিল করা।

সকারের কাছে তাদের প্রত্যাশা সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণভাবে নির্বাচণ অনুষ্ঠানে নির্বাচন কমিশনকে সার্বিক সহযোগীতা দেওয়া এবং রাজনৈতিক দলের কাছে প্রত্যাশ করেন যে কোনো মূল্যে বিজয়ী হওয়ার মনোভাব ত্যাগ করে নির্বাচনকে একটি প্রতিযোগীতা হিসেবে গ্রহণ করা।

তিনি প্রার্থী ও সমর্থকদের কাছে প্রত্যাশা করেন, যথাযথভাবে নির্বাচনী আচরণবিধি মেনে চলা, অর্থ বা কোনো কিছুর বিনিময়ে ভোট ক্রয় না করা, ভোটার বা প্রাথর্ীদের সমর্থকদের ভয়-ভীতি প্রদর্শণ না করা এবং যেকোন ফলাফল স্বাভাবিকভাবে মেনে নেওয়া।

###
মোঃ রেজাউল বারী বাবুল
স্টাফ রিপোর্টার, গাজীপুর।