জাতিসংঘ সম্মেলনে বেনজির আহমেদের নাম অর্ন্তভুক্ত করে সরকার গুম-খুনকে বৈধতা দিচ্ছে—মীজা ফখরুল

আপডেট: আগস্ট ২৭, ২০২২
0

জাতিসংঘের পুলিশ প্রদানদের সম্মেলনের বাংলাদেশের প্রতিনিধি দলে পুলিশের মহাপরিদর্শক বেনজির আহমেদের নাম অন্তর্ভুক্তির সরকারের সিদ্ধান্তকে ‘অপরিনামদর্শী ফ্যাসিবাদী’ অভিহিত করে এতে ‘দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করা হয়েছে’ বলে মন্তব্য করেছেন মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।

শনিবার দুপুরে গুলশানে চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে বিএনপি মহাসচিব এই মন্তব্য করেছেন। করেন।

তিনি বলেন, ‘‘ জাতিসংঘের পুলিশ প্রধানদের সম্মেলনে বাংলাদেশ সরকার জাতিসংঘকে যে ডেলিগেশসের তালিকা প্রদান করে সেখানে ইচ্ছাকৃতভাবে বাংলাদেশের ভামূর্তি ক্ষুন্নন করা হয়েছে। অবৈধ আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাকে নিরঙ্কুশ করার লক্ষ্যে বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের গুম,খুন,বিচারবর্হিভূত হত্যাকান্ডের মতো ভয়ংকর মানবাধিকার লঙ্ঘনকারীদেরকে বৈধ্যতা প্রদানের চেষ্টা করেছে।”

‘‘ আমরা অবাব বিস্ময় ও ক্ষোভের সঙ্গে লক্ষ্য করলাম জাতিসংঘের প্রতিনিধি হিসবে আন্তর্জাতিকভাবে চিহ্নিত এই অপরাধীকে প্রতিনিধি দলের যুক্ত করার মধ্য দিয়ে তারা প্রমাণ করলো তারা তাদের হিংস্র মানবতাবিরোধী অপততপরতা চালিয়ে যাবে বিশ্ববিবেক ও মতামতকে তোয়াক্কা না করে। সরকারের এই অপরিনামদর্শী ফ্যাসিবাদী সিদ্ধান্তের দায়-দায়িত্ব কেবলমাত্র সরকারকেই বহন করতে হবে।”

বেনজির আহমেদের ভিসা পাওয়ার প্রসঙ্গ টেনে সংবাদ সম্মেলন মির্জা ফখরুল বলেন, ‘‘ পুলিশ প্রধান বেনজির আহমেদকে যুক্তরাষ্ট্রে শর্ত সাপেক্ষে ভিসা প্রদান করায় জনগনের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে জাতিসংঘের ১৯৪৭ সালের চুক্তি অনুযায়ী মার্কি যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক নিষেধাজ্ঞা প্রাপ্ত কোনো ব্যক্তি শুধুমাত্র জাতিংঘের সুনির্দিষ্ট উক্ত সম্মেলনে যোগ দিতে পারবেন এবং তার অবস্থান সীমিত থাকবে জাতিসংঘ প্রাঙ্গনে।”

‘‘ আমরা মনে করি, এই ধরনের শর্তসাপেক্ষে ভিসা প্রদান বাংলাদেশের জন্য অবমাননাকর। সরকারের এই ধরনের দায়-দায়িত্বহীন উদ্ধর্তপূর্ণ আচরণের কারণে আন্তর্জাতিক সম্পর্ককে ঝুঁকির মধ্যে ফেলেছে।”

তিনি বলেন, ‘‘ বিএনপিসহ দেশের প্রায় সকল গণতান্ত্রিক দল সরকারের হিংস আচরণ নিয়ে বলে আছে দীর্ঘদিন ধরে। আমাদের দেশের অসংখ্য নেতা-কর্মীকে সরকার গুম করেছে, ক্রসফায়ারে হত্যা করেছে, বিনা বিচারে গ্রেফতার করে নির্যাতন করেছে। দেশে কোনো গণতান্ত্রিক পরিবেশ নেই, মিটিং মিছিল করার কোনো অধিকার নেই, বিনা অনুমতিতে এমনকি কোনো সমাবেশ পর্যন্ত করতে দেয়না ও গণমাধ্যমগুলোর উপর একটা সেলফ সেন্সারশীপে বাধ্য করা হয়েছে।”

‘‘ সেরকম পরিস্থিতিতে দেশের মানুষের কথা কর্ণপাত করা তো দূরের থাকুক এমনকি জাতিসংঘের মতো বিশ্বের সবচেয়ে গ্রহনযোগ্য শক্তিশালী সংস্থার পক্ষ থেকেও বার বার উদ্বেগ প্রকাশ করা হলেও তারা তোয়াক্কা করছে না। হত্যা, গুম-খুন তারা চালিয়ে যাচ্ছে। যে প্রেক্ষিতে যুক্তরাষ্ট্র তাদের দেশের আইন অনুযায়ী একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে মানবাধিকার লঙ্ঘনকারীদেরকে চিহ্নিত করেছে যারা ক্ষমতাসীনদের পক্ষে থেকে এসব মানবাধিকার বিরোধী অপততপরতা চালাচ্ছে এবং সেই অভিযোগেই আমাদের দেশের প্রতিষ্ঠান র‌্যাবের উপর এবং র‌্যাব ও পুলিশের কয়েকজন ব্যক্তিকদের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ, ভিসা বাতিল ও তাদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করেছে।”

মির্জা ফখরুল বলেন, ‘‘ ভোলায় গুলি করে দুই জনকে হত্যা, ঢাকা ও কুমিল্লায় পুলিশের হেফাজতে দুই জনের মৃত্যু এবং সারাদেশে জ্বালানি তেল ও নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির প্রতিবাদে বিএনপির চলমান আন্দোলনে পুলিশ ও সরকারি দলের হামলাতে এটা প্রতিয়মান হয় যে, এই সরকারের এই অপরিনামদর্শী ফ্যাসিবাদী সিদ্ধান্তের দায় কেবল সরকারকেই নিতে হবে।”

‘‘ আমরা মনে করি, সত্য ও ন্যায়ের পথে জনগনেনর বিজয় অনিবার্য্।”

গত ২২ আগস্ট থেকে জেলা-উপজেলা পর্যায়ে জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধি, নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধি ও বিদ্যুতের লোডশেডিংয়ের প্রতিবাদে বিএনপি চলমান কর্মসূচি হামলার ঘটনা তুলে ধরে বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘‘ এখন পর্যন্ত ৫০টির অধিক স্থানে হামলা হয়েছে, আহত হয়েছে প্রায় তিন শতাধিক ও গ্রেফতার হয়েছে প্রায় দুই শতাধিক। ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে প্রায় ২০টার মতো জায়গায়, আসামী করা হয়েছে প্রায় দুই হাজার মানুষকে এবং মামলা করা হয়েছে ১৫টার উপরে।”

‘‘ ঠাকুরগাঁওয়ের বালিয়াডাঙ্গি, গাইবান্দার গোবিন্দগঞ্জ, নোয়াখালীর সেনবাগ, ফেনীর ছাগলনাইয়া-ফুলগাজী, মুন্সিগঞ্জের শ্রীনগর, ময়মনসিংহের ফুলপুর, ত্রিশাল, বরিশালের মেহিন্দিগঞ্জে, খাগড়াছড়ির লক্ষীছড়ি, খুলনার দৌলতপুর, টাঙ্গাইলে ঘাটাইল, সফীপুর, মানিকগঞ্জের সাটুরিয়া, নেত্রকোনার কেন্দুয়া, চট্টগ্রামে সন্দ্বীপ ও বাশখালী, ঝালকাঠি, যশোর, ঝিনাইদাহের শৈলকুপা, নরসিংদীর রায়পুরা, রাজশাহীর কাশিডাঙ্গাসহ প্রায় ৫০ টির অধিক জায়গায় হামলা হয়েছে। হামলা করা হয়েছে যশোরে দলের স্থায়ী কমিটির প্রয়াত সদস্য তরিকুল ইসলামের বাড়িতে, জেলার সাধারণ সম্পাদক সাবেরুল ইসলাম সাবু, মিজানুর রহমান, ফেনীতে শহিদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানির বাড়িতে হামলা, টাঙ্গাইলের সফীপুরে আহমেদ আজম খানের গাড়িতে হামলার ঘটনা ঘটেছে। এসব হামলার পরও হাজার হাজার নেতা-কর্মী মাঠে অবস্থান করছে।”

এই হামলার পর বিএনপি কী আন্দোলন থেকে সরে দাঁড়াবে কিনা প্রশ্ন করা হলে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘‘ প্রশ্নই উঠে না। বিএনপি তো আন্দোলন শুরুই করেছে, আমাদের লক্ষ্য একটাই এই ভয়াবহ দানবীয় মনস্টার একটা শক্তি যারা ক্ষমতায় বসে আছে এদেরকে সরানো এবং এদেরকে সরিয়ে গণতান্ত্রিক একটা ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করাই আমাদের মূল লক্ষ্য।”

‘‘ সেজন্য আমরা একটা নিরপেক্ষ নির্বাচন চাই এবং সেই নির্বাচনের মাধ্যমে আমরা আবার একটা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ফিরে পেতে চাই।”

‘স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর বক্তব্যের সত্যের অপলাপ’

জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাই কমিশনার মিশেল ব্যাসেলেটের যে রিপোর্ট দেয়া হয়েছে তাতে এমন কিছু বলা হয়নি যে বাংলাদেশ সম্পর্কে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন- স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর এহেন বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় মির্জা ফখরুল বলেন, ‘‘ তিনি(স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী) অপব্যাখ্যা দিয়েছেন এবং সত্যের অপলাপ করেছেন। ইউএস হিউম্যান রাইটসের যে রিপোর্ট সেই রিপোর্টে আজকে না পর পর গত চার-পাঁচ বছর ধরে বাংলাদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়গুলো উঠে আসছে। আপনারা নিজেরাও জানেন। জাতিসংঘের মানবাধিকার রিপোর্টেও তা উঠে এসেছে।”

‘‘ মিশেল ব্যাসেলেটের যে সাংবাদিক সম্মেলন সেখানে পরিস্কার করে সুনির্দিষ্ট করে বলা হয়েছে যে, মানবাধিকার লঙ্ঘন চলছে এবং এটাও বলা হয়েছে যে, এভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘন যদি চলতে থাকে এবং এর সঙ্গে যদি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কেউ জড়িত থাকেন সে বিষয়টা তারা উল্লেখ করেছেন। তাহলে সেব্যাপারেও সেটাকে দেখার জন্য দেখার জন্য একটা সিষ্টেম তৈরি করা উচিত। সব শেষে গুরুত্বপূর্ণ যে কথা যেটা বলেছেন, এটার জন্যে একটা সম্পূর্ণ স্বাধীন সংস্থা তৈরি করতে হবে যারা স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়গুলো তদন্ত করবে।”

স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘‘ জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাই কমিশনার বাংলাদেশের বিষয়ে বাংলাদেশে অবস্থানকালে পরিস্কার করে বক্তব্য দিয়ে গেছেন। উনি যে প্রেস কনফারেন্স করেছেন সেখানে পরিস্কারভাবে বলে গেছেন বাংলাদেশে কোথায় অবস্থান করছে। উনি লাস্টে যেটা বলেছেন, এই অবস্থা থেকে মুক্ত হতে গেলে একটা স্বচ্ছ, স্বাধীন ও নিরপেক্ষ তদন্ত করার প্রয়োজনীয়তা আছে। উনি তদন্তের প্রস্তাব দিয়ে গেছেন এবং প্রয়োজনে জাতিসংঘের ওয়ার্কি গ্রুপ এই তদন্তে সহায়তা করবে-এটাও বলে গেছেন।”

‘‘ তারপরেও যদি এদের(সরকার) মাথায় এই বিষয়টা না ঢুকে তাহলে তাদের মাথা ড্রিল করার ছাড়া উপায় নাই। ড্রিল করে ঢুকাতে হবে তাহলে এটা ঢুকবে না-আমি বলছি।”

সংবাদ সম্মেলনে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য আবদুল মঈন খান, ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু ও ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ আল নোমান উপস্থিত ছিলেন।

এ সময়ে বিএনপির মিডিয়া সেলের শহিদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানি, শায়রুল কবির খান ও চেয়ারপারসনের প্রেস উইংয়ের শামসুদ্দিন দিদার উপস্থিত ছিলেন।