জামায়াতের আঁতাতের গুঞ্জন, ভুল সিদ্ধান্তে বিপর্যয় হবে আরো ভয়াবহ

আপডেট: জুন ১৮, ২০২৩
0


অলিউল্লাহ নোমান:

রাজনীতির পণ্ডিত ও সাংবাদিক মরহুম আনোয়ার জাহিদ বলতেন, ইসলামী মূল্যবোধ ও জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী ভোট এক জায়গায় করতে পারলে আওয়ামী লীগ কখনো ক্ষমতার দেখা পাবে না।

১৯৯৯-২০০৪ সাল পর্যন্ত মাঝে মধ্যেই তার বাসায় যাতায়াত ছিল। বেশ কয়েকজন রাজনৈতিক কর্মী এবং কয়েকজন সাংবাদিক নিয়মিত তাঁর বাসায় যাতায়াত করতেন। নিয়মিত যাতায়াতকারীদের মধ্যে আমিও ছিলাম একজন। রাজনৈতিক আড্ডা হতো তাঁর সাথে উত্তরায় বাসায়। সপ্তাহে অন্তত একদিন তো বসা হতই। সেই আড্ডায় যাওয়ার লোভ সামাল দিতে পারতাম না। আমাদের নানা প্রশ্নের উত্তর দিতেন তিনি। রাজনীতির অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতকে বিশ্লেষণ করতেন। মুগ্ধ হয়ে আমরা শুনতাম তাঁর রাজনীতির গল্প।

এমনই একটি রাজনীতির আড্ডায় আনোয়ার জাহিদ বলেছিলেন, ১৯৪৭ সালে আমরা পূর্ব পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হয়েছিলাম ধর্মীয় সংস্কৃতির স্বাধীনতার জন্য। ব্রাহ্মণ্যবাদীদের সাম্প্রদায়িক অত্যাচার ও নিপীড়ন থেকে মুক্তির পাশাপাশি মানুষের মনে ধর্মীয় সংস্কৃতির স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা জেগে উঠেছিল প্রবলভাবে। মানুষের সেই আকাঙ্ক্ষার বাস্তবায়ন হয়েছিল ১৯৪৭ সালের স্বাধীনতার মাধ্যমে। যতদিন জমিদারতন্ত্র ছিল এদেশের মুসলমানরা ছিল দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক। মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও অনেক ক্ষেত্রে ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান পালনে নানা শর্ত আরোপ করে রেখেছিল ব্রাহ্মণ্যবাদী জমিদাররা।

সুতরাং ধর্মীয় মূল্যবোধের উপর ভিত্তি করেই ১৯৪৭ সালে একটি জাতীয়তাবাদী চেতনার উদ্ভব হয়েছিল। এই জাতীয়তাবাদী মূল্যবোধে বিশ্বাসী মানুষের ভোট এক জায়গায় করতে পারলে আওয়ামী লীগ কখনো সুষ্ঠু ভোটে ক্ষমতার দেখা পাবে না বাংলাদেশের মানচিত্রে। তাই আওয়ামী লীগ ও তাদের মুরব্বি ভারতের মূল টার্গেট, যে কোন মূল্যে জাতিকে বিভক্ত করা। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের পর প্রথমেই তারা স্বাধীনতার পক্ষ এবং বিপক্ষ বলে কাল্পনিক একটি বয়ান তৈরির মাধ্যমে জাতিকে বিভক্ত করার অপচেষ্টায় লিপ্ত হয়। দ্বিতীয়ত, ইসলামী মূল্যবোধ ও জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ মানুষের ভোটকে পৃথক করার ষড়যন্ত্র অব্যাহত রাখে।
যখন এই আলোচনাটি আনোয়ার জাহিদ করছিলেন তখন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায়। ১৯৯৪ থেকে ১৯৯৬ সালের মার্চ মাস পর্যন্ত আওয়ামী লীগ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবীতে আন্দোলনের নামে ধবংসাত্মক কর্মকাণ্ড চালিয়েছিল। এই আন্দোলনে শরীক ছিল জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় পার্টিসহ অন্যান্য দল গুলো। যদিও জামায়াতে ইসলামী দাবী করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ধারনাটি তাদের ব্রেইনচাইল্ড। জামায়াত নয়, বরং তাদের দাবীর সাথে আওয়ামী লীগ একাত্মতা ঘোষণা করে আন্দোলনে শরীক হয়েছিল, এমনটাই বলেন দলটির নেতারা।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবীতে আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ইসলামী মূল্যবোধ ও জাতীয়তাবাদী ভোটকে বিভক্ত করার চক্রান্তে সফল হয়েছিল ভারত ও আওয়ামী লীগ। এই আন্দোলনে শেখ হাসিনা শহীদ মতিউর রহমান নিজামী, শহীদ সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর সাথে একমঞ্চে বসে কর্মসূচি ঘোষণা করেছিলেন। সেই আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ১৯৯৬ সালের ১২ জুন অনুষ্ঠিত নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ১৪৬ আসনে বিজয়ী হয়েছিল। জাতীয়তাবাদী ও ইসলামী মূল্যবোধে বিশ্বাসী ভোটে বিভক্তির পরও আওয়ামী লীগ এককভাবে সরকার গঠনের মত সীট পায়নি। সরকার গঠনের জন্য আরো ৪টি আসন দরকার ছিল। শেখ হাসিনা তখন কথিত ঐকমতের সরকার গঠনের শ্লোগান দেন। এরশাদের জাতীয় পার্টির তৎকালীন মহাসচিব আনোয়ার হোসেন মঞ্জুকে মন্ত্রিত্ব দিয়ে দলটির সমর্থন নিয়ে সরকার গঠনে সক্ষম হয়েছিল আওয়ামী লীগ। জাসদের একমাত্র বিজয়ী আ স ম রবকেও মন্ত্রিত্ব দিয়ে কথিত ঐকমতের সরকারে টেনে নেয়া হয়েছিল।

উল্লেখ্য, ১৯৯৬ সালের এই নির্বাচনে জামায়াতে ইসলামী প্রায় ৩০০ আসনেই প্রার্থী দিয়েছিল। এছাড়া সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন এনডিপি এবং ইসলামী দল গুলোর সমন্বয়ে সম্মিলিত সংগ্রাম পরিষদ নামক একটি জোট পৃথক নির্বাচনী প্রতীকে একটি করে আসনে বিজয়ী হয়েছিল। জামায়াতে ইসলামী বিজয়ী হয়েছিল মাত্র ৩টি সীটে। ১৯৯১ সালে ১৮ সিটে বিজয়ী দলটি ধপাস করে ৩ সিটে নেমে আসে তত্ত্বাবধায়ক আন্দোলনের সহযোগী আওয়ামী লীগের সাথে। বিএনপি এককভাবে ১১৬ আসনে বিজয়ী হয়েছিলে। আরো ৩০ টি আসনে বিএনপি পরাজিত হয়েছিল মাত্র ৫০ থেকে ২৫০ ভোটের ব্যবধানে। জাতীয়তাবাদী ও ইসলামী মূল্যবোধে বিশ্বাসী ভোটের বিভক্তি না হলে এই ৩০টিসহ আরো অনেক আসনে আওয়ামী লীগ পরাজিত হত অনায়াসে। এতে ১৯৯৬ সালেই আওয়ামী লীগ লাপাত্তা হয়ে হয়ে যেত ক্ষমতার রাজনীতিতে।
১৯৯৬ সালের ১২ জুনে ভোটের ফলাফলের হিসাবকে সামনে রেখে আনোয়ার জাহিদ তখন চার দলীয় জোট গঠনের জন্য দৌড় ঝাপ শুরু করেছিলেন। বিএনপি চেয়ারপার্সনের তথ্যবিষয়ক উপদেষ্টার পাশাপাশি জোট গঠনে নেপথ্য কারিগরের দায়িত্বে ছিলেন তিনি। আনোয়ার জাহিদ, জাতীয় পার্টির কাজী জাফর আহমদ, জামায়াতের শহীদ কামারুজ্জামানদের নিরলস প্রচেষ্টায় শেষ পর্যন্ত চার দলীয় জোট গঠন হয়েছিল। ২০০১ সালের ১ অক্টোবর প্রমাণিত হয়েছিল ভোটের মাঠে ইসলামী মূল্যবোধ ও জাতীয়তাবাদী শক্তির ঐক্যের প্রয়োজনীয়তা। ২০০১ সালের ১ অক্টোবর অনুষ্ঠিত ভোট নিয়ে কারো কোন রকমের প্রশ্ন তোলা সম্ভব হয়নি। সেই ভোটে আওয়ামী লীগের আসন সংখ্যা ৭০-এর ঘরে নেমে এসেছিল।
পুরাতন এই কাসুন্দি টানলাম একটি বিশেষ কারণে। প্রায় একযুগ পর গত ১০ জুন জামায়াতে ইসলামী আনুষ্ঠানিকভাবে একটি সমাবেশ করার অনুমতি পেয়েছে। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর থেকে দলটি নিপীড়নের শিকার। দলীয় প্রতীক ও নিবন্ধন বাতিল করেছে আওয়ামী লীগের অনুগত নির্বাচন কমিশন। নানা শর্তের বেড়াজাল দিয়ে ১০ জুন দলটিকে ইঞ্জিনিয়ার্স ইন্সটিটিউটের ভেতরে সমাবেশের অনুমতি দিয়েছিল ঢাকা মহানগর পুলিশ। তবে সমাবেশ ছড়িয়ে পড়েছিল ইন্সটিটিউটের চারপাশে। লোকে লোকারণ্য হয়ে উঠেছিল গোটা এলাকা। এই সমাবেশের মাধ্যমে দলটি প্রমান করার চেষ্টা করেছে ২০০৯ সাল থেকে চলমান নিপীড়নেও তৃণমূলে তাদের শক্ত অবস্থানে আগের মতই রয়েছে। শত নির্যাতন, নিপীড়নেও মাঠে কর্মীর ভাটা পড়েনি। ভোট এবং আন্দোলনের মাঠে তাদের প্রয়োজন শেষ হয়ে যায়নি।
জামায়াতে ইসলামীর এই সমাবেশের পর থেকে সোশ্যাল মিডিয়া ও আওয়ামী গণমাধ্যম গুলোতে একটি প্রচারণা খুবই লক্ষণীয়। সরকারের সাথে আঁতাতের গন্ধ বিলানোর চেষ্টা চলছে অবিরাম। চার দল থেকে সম্প্রসারিত ২০ দলীয় জোটের অস্তিত্ব এখন না থাকলেও যুগপৎ আন্দোলনের ঘোষণা রয়েছে রাজপথে। এই আন্দোলনে সন্দেহ, সংশয় তৈরি অপচেষ্টায় থাকবে আওয়ামী মিডিয়া। এটাই স্বাভাবিক। তবে এর সাথে বর্তমানে সোশ্যাল মিডিয়ায়ও নানা গুজব ছড়িয়ে সংশয় তৈরির অপচেষ্টা চলছে রাজনৈতিক একটিভিস্টদের পক্ষ থেকে। বোঝে, না বোঝে তারা এটা করছেন। সোশ্যাল মিডিয়ায় বিভক্তির রেখা প্রশস্ত করা হচ্ছে আঁতাতের বয়ান প্রচারের মাধ্যমে।
এরকম আঁতাতের গল্প আগেও প্রচার হয়েছে। চার দলীয় জোট গঠনের পর থেকেই নানাভাবে আঁতাতের কাল্পনিক গল্প আওয়ামী মিডিয়ায় প্রচার হত। বিএনপি’র ভেতরে বিভক্তি তৈরির লক্ষ্যে আওয়ামী মিডিয়া গুলো বিভিন্ন নেতার নামের আগে তাদের ভাষায় ‘কট্টরপন্থী’ ও ‘উদারপন্থী’ ট্যাগ দেওয়ার চেষ্টা করতে দেখা গেছে তখন।

২০১৪ সালের একতরফা জাতীয় নির্বাচনের আগে এবং পরবর্তীতে বহুবার এরকম আঁতাতের গল্প প্রচার হয়েছে। তবে জামায়াতের শীর্ষ নেতৃত্বে থাকা ৫ জনকে একে একে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যার মাধ্যমে প্রমান হয়েছিল সরকারের সাথে আসলে কোন আঁতাত হয়নি। আঁতাত হলে নেতাদের এভাবে বিচারের নামে প্রহসনে ফাঁসিতে ঝুলতে হতো না। এখনো জামায়াতে ইসলামীর আমীর, সেক্রেটারি জেনারেলসহ শীর্ষ নেতারা কারাগারে। সেক্রেটারি জেনারেলসহ অনেকেই একাধিকবার জামিনে মুক্তিও পেয়েছেন। কিন্তু কারা ফটক থেকে আবার তাদের আটক করে নিয়ে গেছে রাষ্ট্রীয় বাহিনী। ক্রসফায়ার এবং গুমের শিকার হয়েছেন দলটির অনেক নেতাকর্মী। নির্যাতানে অনেকেই পঙ্গুত্ববরণ করে মানবেতর জীবন-যাপন করছেন। এই অবস্থায় ফ্যাসিবাদী সরকার চাইবে বিভ্রান্তি তৈরি করতে।
এদিকে বিএনপি’র ভেতর থেকেও একটি অংশ জামায়াতে ইসলামীকে সঙ্গে নিয়ে জোট করার বিষয়ে ভেতরে ভেতরে কিছুটা নাখোশ ছিলেন শুরু থেকেই। কিন্তু বিচক্ষণ রাজনীতিক বেগম খালেদা জিয়া দূরদর্শী চিন্তায় জোটের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছিলেন। তাই আওয়ামী মিডিয়ার প্রচারণা এবং দলের ভেতরে থাকা কুচক্রীদের অপপ্রচার হালে পানি পায়নি তাঁর কাছে। তিনি একই জোটে জামায়াতে ইসলামীর চরম বিরোধী কওমীর ওলামায়ে কেরামকেও অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন। একপাশে কওমীর ওলামায়ে কেরাম এবং অপর পাশে জামায়াতের নেতৃবৃন্দকে রেখে মঞ্চে বসতেন। কারণ, কওমী মাদ্রাসা ভিত্তিক ওলামায়ে কেরামেরও গ্রামে গঞ্জে ভোটের রাজনীতির প্রভাব রয়েছে। কোন কোন আসনে তারাও ম্যাটার করেন। তাই জাতীয় স্বার্থে তাদেরকেও কাছে টেনে এনেছিলেন তিনি।

মোট কথা জাতির এই সংকটময় মুহূর্তে জাতীয়তাবাদী ও ইসলামী মূল্যবোধে বিশ্বাসী রাজনীতিকদের বিভক্তি তৈরির লক্ষ্যে অপপ্রচার, গুজব এবং নানা কাল্পনিক বয়ান প্রচার করা হবে।
উদ্দেশ্যমূলক অপপ্রচার, গুজব ও কাল্পনিক বয়ান আমলে নিয়ে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিতে ভুল করলে মাশুল শুধু নেতা-নেত্রী বা দল নয়, পুরো জাতিকেই দিতে হবে।

জামায়াত যদি সরকারের সাথে আঁতাতের রাজনীতি করেন সেটাও যেমন চরম ভুল হবে, তেমনি আরো বেশি চরম ভুল হবে নিজেদের অতি আত্মবিশ্বাসে জামায়াতসহ ইসলামী দল গুলোকে দূরে ঠেলে দেওয়া।
১৯৯৬ সালে অস্তিত্বের সঙ্কটের মুখোমুখি থাকা আওয়ামী লীগ রাজনৈতিক লাইফ ফিরে পেয়েছিল জাতীয়তাবাদী ও ইসলামী মূল্যবোধে বিশ্বাসী রাজনৈতিক নেতৃত্বের ভুল বোঝাবুঝির কারণে।

সুতরাং রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে ভুল হলে বিপর্যয় কতটা ভয়াবহ রূপ নেয় সেটার বাস্তব উদাহরণ হচ্ছে আজকের বাংলাদেশ। তাই বিভেদ, ভুল বোঝাবুঝি নয়, ফ্যাসিবাদের পতন চুড়ান্ত করতে রাজপথ ও ভোটের মাঠে জাতীয়তাবাদী এবং ইসলামী মূল্যবোধের ঐক্য আরো সুদৃঢ় হউক, এটাই প্রত্যাশা করেন সাধারণ ভোটাররা। অতএব, এটা নির্দ্বিধায় বলা যায়, কারো ভুল সিদ্ধান্তের কারণে চলমান বিপর্যয় দীর্ঘায়িত হলে জাতি ক্ষমা করবে না।
লেখক: সাংবাদিক, বর্তমানে যুক্তরাজ্যে নির্বাসিত।