জেনেশুনে নেতিবাচক স্ট্র্যাটেজি গ্রহণ করেন রাসেল: র‌্যাব

আপডেট: সেপ্টেম্বর ১৭, ২০২১
0

বহুল আলোচিত ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ইভ্যালি প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মো. রাসেল জেনেশুনে নেতিবাচক স্ট্র্যাটেজি গ্রহণ করেন বলে জানিয়েছে র‌্যাব।

আজ শুক্রবার (১৭ সেপ্টেম্বর) এক ব্রিফিংয়ে র‌্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন এ কথা জানান।

সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, প্রতারণা ও অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে ইভ্যালি’র সিইও মোঃ রাসেল ও চেয়ারম্যান শামীমা নাসরিন গ্রেফতার।

১। সাম্প্রতিক সময়ে ইভ্যালি’র ব্যবসায়িক কারসাজি দেশব্যাপী একটি বহুল আলোচিত বিষয়। কারসাজির মাধ্যমে লক্ষ লক্ষ গ্রাহকের অর্থ হাতিয়ে নিয়ে পণ্য ডেলিভারী না দেওয়ার বিষয়টি দেশব্যাপী ব্যাপক চাঞ্চলের সৃষ্টি হয়। ইভ্যালি প্লাটফর্মে প্রতারিত হয় সাধারণ মানুষ। বিভিন্ন লোভনীয় গগনচুম্বী অফার দেখিয়ে প্রলুব্ধ করে সাধারণ জনগণের কষ্টার্জিত অর্থ হাতিয়ে নিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। বেশ কয়েকটি সংস্থা ইভ্যালি’র ব্যবসায়িক কাঠামো নিয়ে পর্যালোচনা ও অনুসন্ধান অব্যাহত রেখেছে। অনিয়মের অভিযোগ উঠায় গত ১৪ সেপ্টেম্বর ইভ্যালির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বানিজ্য মন্ত্রণালয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে সুপারিশ করেছে। এছাড়া বিভিন্ন আলোচনায় আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের বিষয়টি উঠে আসে। এই প্রতিষ্ঠানটির ই-কমার্সের নামে নেতিবাচক ব্যবসার ফলে আজ দেশব্যাপী লক্ষ লক্ষ মানুষ প্রতারিত।

২। গত ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২১ তারিখে গুলশান থানায় এক ভূক্তভোগী প্রতারণা ও অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে ইভ্যালির সিইও মোঃ রাসেল (৩৭) এবং চেয়ারম্যান শামীমা নাসরিন (৩৫) এর বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন। যার মামলা নং গুলশান থানা ১৯ তারিখ ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২১ ও ধারা ৪০৬/৪২০/৫০৬ পেনাল কোড-১৮৬০। এছাড়া আরো বেশ কিছু ভূক্তোভূগির অভিযোগ রয়েছে। জানা যায় তারা বিভিন্ন সময়ে ইভ্যালির অফিসে অপমান হেনস্থা ও ভয়ভীতির স্বীকার হয়েছেন।

৩। এরই ধারাবাহিকতায় গতকাল ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২১ তারিখ বিকেলে র‌্যাব সদর দপ্তরের গোয়েন্দা শাখা ও র‌্যাব-২ এর অভিযানে রাজধানীর মোহাম্মদপুর এলাকা হতে প্রতারণা ও অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে ইভ্যালির সিইও মোঃ রাসেল (৩৭) এবং চেয়ারম্যান শামীমা নাসরিন (৩৫), ঢাকাদ্বয়’কে গ্রেফতার করা হয়। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রাহকদের প্রতারিত হওয়ার বিভিন্ন বিষয়াদি ও কৌশল সম্পর্কে তথ্য পাওয়া যায়।
৪। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, ইভ্যালির কারসাজির মূলহোতা গ্রেফতারকৃত মোঃ রাসেল যিনি প্রতিষ্ঠানটির সিইও এবং তার স্ত্রী গ্রেফতারকৃত শামীমা নাসরিন (চেয়ারম্যান) তার অন্যতম সহযোগী। গ্রেফতারকৃত মোঃ রাসেল ২০০৭ সালে একটি বিশ্ববিদ্যালয় হতে মাস্টার্স সম্পন্ন করেন এবং পরবর্তীতে তিনি ২০১৩ সালে এমবিএ সম্পন্ন করেছেন বলে জানান। তিনি ২০০৯ সাল হতে ২০১১ সাল পর্যন্ত একটি কোচিং সেন্টারে শিক্ষকতা করেন। ২০১১ সালে তিনি ব্যাংকিং সেক্টরে চাকুরী শুরু করেন। তিনি প্রায় ৬ বছর ব্যাংকে চাকুরী করেন। তিনি ২০১৭ সালে ব্যাংকের চাকুরী ছেড়ে দিয়ে ব্যবসা শুরু করেন। তিনি প্রায় এক বছর শিশুদের ব্যবহার্য একটি আইটেম নিয়ে ব্যবসা করেন এবং অতঃপর তিনি উক্ত ব্যবসা বিক্রি করে দেন। ২০১৮ সালে পূর্বের ব্যবসালব্ধ অর্জিত অর্থ দিয়ে ইভ্যালি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন। ২০১৮ সালের ডিসেম্বর মাসে ইভ্যালি কার্যক্রম শুরু হয়। কোম্পানীতে তিনি সিইও এবং তার স্ত্রী চেয়ারম্যান পদে অধিষ্ঠিত হন।
৫। ইভ্যালির ব্যবসায়িক অবকাঠামো সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, ভাড়াকৃত স্পেসে ধানমন্ডিতে প্রধান কার্যালয় এবং কাষ্টমার কেয়ার স্থাপিত হয়। একইভাবে ভাড়াকৃত স্পেসে আমিন বাজার ও সাভারে ২টি ওয়ার হাউজ চালু করা হয়। কোম্পানীতে একপর্যায়ে প্রায় ২০০০ ব্যবস্থাপনা স্টাফ ও ১৭০০ অস্থায়ী কর্মচারী নিয়োগ ছিল। যা ব্যবসায়িক অবনতিতে বর্তমানে যথাক্রমে স্টাফ ১৩০০ জনে এবং অস্থায়ী পদে প্রায় ৫০০ জন কর্মচারীতে এসে দাঁড়িয়েছে। কর্মচারীদের একপর্যায়ে মোট মাসিক বেতন বাবদ দেয়া হতো প্রায় ৫ কোটি টাকা; যা বর্তমানে ১.৫ কোটিতে দাড়িয়েছে বলে গ্রেফতারকৃতরা জানান। গত জুন থেকে অনেকের বেতন বকেয়া রয়েছে। তিনি ও তার স্ত্রী পদাধিকারবলে নিজেরা মাসিক ৫ লক্ষ টাকা করে বেতন নিয়ে থাকেন। তারা কোম্পানীর অর্থে ব্যক্তিগত ২টি দামী গাড়ী (রেঞ্চ রোভার ও অডি) ব্যবহার করেন। এছাড়া কোম্পানীর প্রায় ২৫-৩০টি যানবাহন রয়েছে। ব্যক্তি পর্যায়ে সাভারে গ্রেফতারকৃত রাসেলের কয়েক কোটি টাকা মূল্যের জায়গা-জমিসহ অন্যান্য সম্পদ রয়েছে বলে তিনি জানান। গ্রেফতারকৃতরা জানান ইভ্যালির বিভিন্ন ব্যাংক একাউন্টে বর্তমানে প্রায় ৩০ লক্ষ টাকা রয়েছে। এছাড়া কয়েকটি গেটওয়েতে ৩০-৩৫ কোটি গ্রাহকের টাকা আটক হয়ে আছে বলে গ্রেফতারকৃতরা উল্লেখ করেছেন। অর্থাৎ উক্ত অর্থ কোম্পানীর নয়।
৬। গ্রেফতারকৃতদের কোম্পানীর দায় ও দেনা সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০২১ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দেনা দাঁড়ায় ৪০৩ কোটি টাকা; চলতি সম্পদ ছিল ৬৫ কোটি টাকা, বিভিন্ন পণ্য বাবদ গ্রাহকদের নিকট থেকে অগ্রিম নেয়া ২১৪ কোটি টাকা এবং বিভিন্ন গ্রাহক ও কোম্পানীর কাছে বকেয়া প্রায় ১৯০ কোটি টাকা। বিভিন্ন সংস্থার সূত্রে প্রকাশিত বিপুল পরিমান দায়ের বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদের প্রেক্ষিতে গ্রেফতারকৃতরা কোন সদুত্তর দিতে পারেননি। জিজ্ঞাসাবাদে আরও জানা যায় প্রতিষ্ঠানটির আরও দায় দেনা রয়েছে। সর্বমোট পরিমান ১০০০ কোটি টাকার বেশী বলে গ্রেফতারকৃতরা জানায়। কোম্পানীটি প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে লোকসানী কোম্পানী; কোন ব্যবসায়িক লাভ করতে পারেনি। গ্রাহকের অর্থ দিয়েই যাবতীয় ব্যয় ও খরচ নির্বাহ করা হত। ফলে দেনা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পেয়েছে।
৭। জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতারকৃত মোঃ রাসেল আরও জানান, ইভ্যালি ছাড়াও তার আরও কয়েকটি ব্যবসায়িক প্লাটফর্ম রয়েছে তন্মধ্যে, ই-ফুড, ই-খাতা, ই-বাজার ইত্যাদি। ইভ্যালি’র ব্যবসায়িক কাঠামো শুরু হয়েছিল যতসামান্য নিজস্ব ইনভেস্টমেন্ট দিয়ে। তার ব্যবসায়িক স্টাটিজি ছিল তৈরীকারক ও গ্রাহক চেইন বা নেটওয়ার্ক থেকে বিপুল অর্থ তুলে নেওয়া। তিনি বিশাল অফার, ছাড়ের ছড়াছড়ি আর ক্যাশব্যাকের অফার দিয়ে সাধারণ জনগণকে প্রলুব্ধ করতেন। যাহাতে দ্রুততম সময়ে ক্রেতা বৃদ্ধি সম্ভবপর হয়। জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায় ইভ্যালির গ্রাহক সংখ্যা ৪৪ লাখের ও অধিক। তিনি বিভিন্ন লোভনীয় অফারের মাধ্যমে স্বল্প সময়ে এত সংখ্যক গ্রাহক সৃষ্টি করেছেন। ইভ্যালি’র বিভিন্ন লোভনীয় অফারগুলো হলোঃ সাইক্লোন অফার (বাজার মূল্যের অর্ধেক মূল্যে পণ্য বিক্রয়); ক্যাশব্যাক অফার (মূল্যের ৫০-১৫০% ক্যাশব্যাক অফার); আর্থকুয়েক অফার, প্রায়োরিটি স্টোর, ক্যাশ অন ডেলিভারী। এছাড়া বিভিন্ন উৎসবেও ছিল জমজমাট অফার; যেমন-বৈশাখী, ঈদ অফার ইত্যাদি। তাছাড়া আরও রয়েছে টি-১০, ৫ ও ৩ অফার। এভাবে বিভিন্ন অফারে প্রলুব্ধ হন সাধারণ জনগন।
৮। ব্যবসায়িক বিক্রি বাড়াতে গ্রাহকদের প্রতিনিয়ত চাহিদা তৈরী হয় এ ধরণের পণ্যকে বেছে নেওয়া হয়েছে বলে জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়। যেমন- মোবাইল, টিভি, ফ্রিজ, এসি, মোটরবাইক, গাড়ী, গৃহস্থলীপণ্য, প্রসাধনী, প্যাকেজ ট্যুর, হোটেল বুকিং, জুয়েলারী, স্বাস্থ্যসেবা সামগ্রী ও ফার্নিচার ইত্যাদি। জিজ্ঞাসাবাদে আরও জানা যায়, এহেন পণ্যের মূল্য ছাড়ের ফলে ব্যাপক চাহিদা তৈরী হয়। ধীরে ধীরে প্রতিষ্ঠানের বিশাল আকারে দায় (খরধনরষরঃরবং) তৈরী হয়। গ্রেফতারকৃতরা জানায় ব্যবসায়িক অপকৌশল ছিল নতুন গ্রাহকের উপর দায় চাপিয়ে দিয়ে পুরাতন গ্রাহক ও সরবরাহকারীর দায়ের (খরধনরষরঃরবং) আংশিক আংশিক করে পরিশোধ করা। অর্থাৎ “দায় ট্রান্সফার” এর মাধ্যমে দুরভিসন্ধিমূলক অপকৌশল চালিয়ে যাচ্ছিল ইভ্যালি। প্রতিষ্ঠানটির নেওয়ার্কে যত গ্রাহক তৈরী হত, দায় (খরধনরষরঃরবং) তত বৃদ্ধি পেত। গ্রেফতারকৃত রাসেল জেনেশুনে এই নেতিবাচক স্টাটিজি গ্রহণ করেন বলে জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছেন।
৯। গ্রেফতারকৃত মোঃ রাসেল’কে জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায় যে, একটি বিদেশী ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের লোভনীয় অফার (১ঃ২) এর আলোকে ইভ্যালির ব্যবসায়িক স্টাটিজি তৈরী করেছেন। ব্যবসায়িক ভবিষ্যত কর্ম পরিকল্পনা সম্পর্কে গ্রেফতারকৃতরা জানায় যে, প্রথমত একটি ব্রান্ড ভ্যালু তৈরীর পরিকল্পনা করা হয়। অতঃপর দায়সহ কোন প্রতিষ্ঠিত আন্তর্জাতিক কোম্পানীর নিকট বিক্রি করে লভ্যাংশ নিয়ে নেওয়া। এ উদ্দেশ্যে তারা বিভিন্ন দেশও ভ্রমণ করেছেন। অন্যান্য পরিকল্পনা সমূহের মধ্যে ছিল বিভিন্ন প্রতিষ্ঠিত কোম্পানীর নিকট কোম্পানী শেয়ারের অফার দিয়ে প্রলুব্ধ করে দায় চাপিয়ে দেওয়া। এছাড়া তিন বছর পূর্ণ হলে শেয়ার মার্কেটে অন্তর্ভূক্ত হয়ে দায় চাপানোর পরিকল্পনা নেন। তিনি জানান যে, দায় মেটাতে বিভিন্ন অজুহাতে সময় বৃদ্ধি করার আবেদন একটি অপকৌশল মাত্র। সর্বশেষ তিনি দায় মেটাতে ব্যর্থ হলে “দেওলিয়া ঘোষণার” পরিকল্পনা করেছিলেন।
১০। জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, ইভ্যালির অন্যতম কর্ণধার গ্রেফতারকৃত মোঃ রাসেল ও তার পতœী। ইভ্যালি পরিকল্পিতভাবে একটি পরিবার নিয়ন্ত্রিত ব্যবসায়িক গঠনতন্ত্র। একক সিদ্ধান্ত গ্রহণে স্বেচ্ছাচারিতা করার অবকাশ রয়েছে। ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার ঘাটতি রয়েছে। ফলে ক্রমান্বয়ে প্রতিষ্ঠানের দায় বৃদ্ধি হতে হতে বর্তমানে প্রায় অচলাবস্তায় উপনীত হয়েছে। এই অচলাবস্তা হতে উত্তরণে দিশেহারা গ্রেফতারকৃতরা। বিভিন্ন সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের নিকট দায়; গ্রাহকদের নিকট দায় নিয়ে বিচলিত প্রতিষ্ঠানটি। ইভ্যালির নেতিবাচক ব্যবসায়িক স্ট্যাটিজি উন্মোচিত হওয়ায় অনেক সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান ও অর্থ ট্রানসিশন গেটওয়ে ইভ্যালি থেকে সরে এসেছে। ব্যবসায়িক উত্তরণ নিয়ে সন্ধিহান গ্রেফতারকৃতরা। এখন পর্যন্ত উত্তরণের কোন সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা গ্রহণ করতে সক্ষম হয়নি গ্রেফতারকৃতারা।
১১। গ্রেফতারকৃতদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন।