টিকা ও রোহিঙ্গা সঙ্কট নিয়ে ভারত, চীন ও রাশিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের বৈঠক আজ

আপডেট: জুলাই ১৫, ২০২১
0

উজবেকিস্তানের রাজধানী তাসখন্দে আজ থেকে শুরু হওয়া কানেক্টিভিটি সম্মেলনের সাইড লাইনে ওই বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে। সেখানে ভারত, চীন ও রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে বসছেন উজবেকিস্তান সফররত পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আব্দুল মোমেন। এমন এক সময় বৈঠকগুলোর প্রস্তাব করা হয়েছে যখন বাংলাদেশের করোনা পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। এটি নিয়ন্ত্রণে হাসপাতালে আইসিইউ বেড এবং অক্সিজেন সাপ্লাই বাড়ানো বিশেষ করে হাই-ফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা ফ্যাসিলিটি বৃদ্ধির পাশাপাশি বাংলাদেশে গণটিকা কার্যক্রম জোরদারের দাবি ওঠেছে।

কিন্তু ঢাকায় এখনো পর্যাপ্ত টিকা নেই। টিকা কিনতে সর্বপ্রথম ভারতের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয় বাংলাদেশ। কিন্তু আচমকা ভারতে করোনা পরিস্থিতির অবনতি এবং টিকা বন্ধের সিদ্ধান্তে সংকটে পড়ে ঢাকা। বিকল্প হিসেবে চীন এবং রাশিয়ার সঙ্গে টিকা নিয়ে আলোচনা শুরু হয়।

চীনের সিনোফার্মের সঙ্গে এরইমধ্যে ঢাকার বাণিজ্যিক চুক্তি হয়েছে এবং কেনা টিকার প্রথম চালানটি দেশে পৌঁছেছে। রাশিয়ার সঙ্গে প্রস্তাবিত চুক্তিটিও চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে জানিয়ে কূটনীতিকরা বলছেন, সেই বিবেচনায় টিকার সরবরাহ নির্বিঘ্ন করতে বন্ধুপ্রতিম ৩ রাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে একইদিনে মন্ত্রী মোমেনের প্রস্তাবিত বৈঠকগুলো খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। উজবেকিস্তানের আয়োজনে ‘মধ্য ও দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে কানেক্টিভিটি: সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ’ শীর্ষক দু’দিনব্যাপী তাসখন্দ সম্মেলনে বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আব্দুল মোমেন। মন্ত্রী এরইমধ্যে দেশটিতে পৌঁছেছেন। উজবেক প্রেসিডেন্ট শাভকাত মিরজিইয়োইয়েভের আমন্ত্রণে যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, চীন, পাকিস্তান এবং ইইউসহ বিশ্বের অন্তত ৪০টি দেশ ও জোটের রাষ্ট্র বা সরকার প্রধান কিংবা জ্যেষ্ঠ প্রতিনিধিরা ওই সম্মেলনে অংশ নিচ্ছেন।

সম্মেলনের সাইড লাইনে হোস্ট কান্ট্রিসহ অন্তত ৬-৭টি দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের প্রতিনিধির সঙ্গে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বৈঠক চাওয়া হয়েছে জানিয়ে সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা গণমাধ্যমকে বলেন, করোনা টিকা, রোহিঙ্গা সংকট এবং বাংলাদেশের বাণিজ্য সম্ভাবনাসহ বিভিন্ন বিষয়ে ওইসব বৈঠকে আলোচনা করতে চান পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোমেন।

জয়শঙ্করের সঙ্গে বৈঠকে যা আলোচনা হতে পারে- ঢাকা ও দিল্লির কূটনৈতিক সূত্র জানিয়েছে- স্বল্প সময়ের জন্য ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. সুব্রামানিয়াম জয়শঙ্কর তাসখন্দ যাচ্ছেন। তার ব্যস্ত সফরসূচির মধ্যে জায়গা করে নিতে সক্ষম হয়েছে ঢাকা। মন্ত্রী জয়শঙ্করের সঙ্গে মন্ত্রী মোমেনের বৈঠক হচ্ছে- নিশ্চিত করে সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা গণমাধ্যমকে বলেন, সঙ্গতকারণেই ভারতের কাছ থেকে চুক্তি অনুযায়ী টিকা পাওয়ার বিষয়টি তুলবেন মন্ত্রী মোমেন। একই সঙ্গে রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার এবং অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বাংলাদেশে টিকা সরবরাহের অনুরোধ করেন তিনি। তাছাড়া ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির গত মার্চের ঢাকা সফরে যেসব বিষয়ে দুই দেশের শীর্ষ নেতৃত্ব ঐকমত্যে পৌঁছেছিল, তা করোনাকালীন এই সময়ে তা কীভাবে এগিয়ে নেয়া যায়- সেই পথ-পরিক্রমা নিয়ে তাদের মধ্যে কথা হবে।

ভারত থেকে পণ্য আমদানি ৪০ শতাংশের ওপর বৃদ্ধি পেলেও রপ্তানি আশানুরূপ বাড়েনি মন্তব্য করে এক কর্মকর্তা বলেন, ভারত পাট পণ্যের ওপর শুল্ক এখনো বলবৎ রেখেছে। ঢাকা আভাস পেয়েছে আরও কিছু পণ্যে শুল্ক এবং অ-শুল্ক বাধা আরোপ করতে পারে দেশটির সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। মন্ত্রী পর্যায়ের আলোচনায় বাংলাদেশ বিষয়গুলো স্পষ্ট হতে চাইবে এবং এটি ঠেকানোর অনুরোধ জানাবে।

চীনের সঙ্গে টিকাই হবে মুখ্য আলোচ্য:
এদিকে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়েই ই’র সঙ্গে আজকের বৈঠকে দ্বিপক্ষীয় স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়াদি নিয়ে আলোচনা হবে জানিয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা বলেন, ওই বৈঠকে মুখ্য আলোচ্য হবে টিকার সরবরাহ নির্বিঘ্ন করার বিষয়টি। চীনা কোম্পানি সিনোফার্মের কাছ থেকে দেড় কোটি ডোজ টিকা কেনার চুক্তি করেছে সরকার। আরও ১ কোটি টিকা কেনার আলোচনা চলছে। চীনের অপর কোম্পানি সিনোভ্যাকের কাছ থেকেও টিকা কিনতে চায় বাংলাদেশ। ওই দুটি কোম্পানির যেকোনো একটির সঙ্গে যৌথ উৎপাদনের প্রস্তাব নিয়ে কথাবার্তা চলছে। দুই পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বৈঠকে সেই সব বিষয়ে আলোচনা হবে। ওই বৈঠকে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বাংলাদেশকে কিছু টিকা উপহার দেয়ার ঘোষণা দিতে পারেন বলে জানা গেছে। তাছাড়া বাংলাদেশের ঘাড়ে চেপে বসা রোহিঙ্গা সংকটের সমাধানে চীনের একান্ত সহযোগিতা চায় ঢাকা। মোমেন-ওয়েই ই বৈঠকে গুরুত্বের সঙ্গে রোহিঙ্গা সংকটের সমাধান নিয়ে আলোচনা হবে। বিশেষ করে মিয়ানমারের ওপর চীনের যে প্রভাব রয়েছে তা কাজে লাগিয়ে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর অনুরোধ পুনর্ব্যক্ত করবে বাংলাদেশ।

রাশিয়ার সঙ্গে বৈঠকে থাকছে টিকা এবং মিয়ানমার প্রসঙ্গ:
ঢাকার কূটনৈতিক সূত্র জানিয়েছে, রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সার্গেই ল্যাভরভের সঙ্গে মন্ত্রী মোমেনের বৈঠকে টিকা কেনা ছাড়াও মিয়ানমার পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হবে। সম্প্রতি মিয়ানমারের সেনাপ্রধান রাশিয়া সফর করেছেন। তিনি সেখানে রাশিয়ার শীর্ষ নেতৃত্বের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। তার সফরে নিশ্চিতভাবে মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি এবং রোহিঙ্গাসহ সংকটে থাকা অন্য জাতি গোষ্ঠীর বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে মিয়ানমারের পরিবর্তিত নেতৃত্বের মনোভাব কী তা বুঝার চেষ্টায় রয়েছে ঢাকা। তারই অংশ হিসেবে রাশিয়ার কাছ থেকেও বিষয়টি স্পষ্ট হওয়ার চেষ্টা করবেন মন্ত্রী। একই সঙ্গে তিনি সংকট সমাধানে রাশিয়ার প্রভাবকে কাজে লাগানোর অনুরোধ জানাবেন।

সূত্র জানায়, বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী ও স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী উপলক্ষে যুদ্ধবন্ধু রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক নতুন উচ্চতায় নিতে চায় ঢাকা। এ জন্য রাজনৈতিক সফর বিনিময়ে একমত হয়েছে দুই দেশ। দুই মন্ত্রীর বৈঠকে সম্পর্ক বৃদ্ধির পথ ও পন্থা নিয়ে আলোচনা ছাড়াও রূপপুর বিদ্যুৎ প্রকল্পসহ উন্নয়ন এবং বাণিজ্য নিয়ে কথা হবে। ল্যাভরভকে ঢাকা সফরের আমন্ত্রণও জানাবেন মন্ত্রী মোমেন।

আফগান প্রসঙ্গ ছাড়াও ঢাকায় উজবেক কন্স্যুলেট এবং ফ্লাইট চালু নিয়ে কথা হতে পারে:
সম্মেলনের সাইড লাইনে উজবেকিস্তানের একাধিক মন্ত্রীর সঙ্গে পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোমেনের বৈঠক হবে জানিয়ে ঢাকার কর্মকর্তারা বলেছেন, দেশটির সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক জোরদারে আগ্রহী বাংলাদেশ। ফলে নিশ্চিতভাবে এ নিয়ে কথা হবে। একইসঙ্গে আফগান প্রসঙ্গ এবং দুই দেশের মধ্যে আকাশপথে সরাসরি ফ্লাইট চালু এবং ঢাকায় উজবেক কন্স্যুলেট খোলার প্রস্তাব নিয়ে কথা হবে।

কর্মকর্তারা জানান, মূলত অর্থনীতি, সংস্কৃতি ও নিরাপত্তার প্রেক্ষাপটে সংযুক্তির মাধ্যমে ঐতিহাসিক সম্পর্ক জোরদারের জন্য উজবেকিস্তানের প্রেসিডেন্ট তাসখন্দ সম্মেলনের আয়োজন করেছেন। কানেক্টিভিটির ওই সম্মেলনে সমকালীন প্রসঙ্গ হিসেবে আফগানিস্তান নিয়েও আলোচনা হতে পারে। কেননা, মার্কিন সেনা প্রত্যাহার শুরুর পর থেকে ফের সংঘাতপূর্ণ হয়ে উঠেছে আফগানিস্তান। এরই মধ্যে তুমুল লড়াই চলছে সরকারি বাহিনী ও তালেবানের মধ্যে। ধারণা করা হচ্ছে সেই সব বৈঠকে আফগান পরিস্থিতিসহ সম-সাময়িক বার্নিং ইস্যুগুলো নিয়ে আলোচনা হবে।

এ বিষয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ঢাকা ছেড়ে যাওয়ার আগে গণমাধ্যমকে বলেন, মধ্য ও দক্ষিণ এশিয়ার কানেক্টিভিটি সম্মেলনে যোগ দিতে উজবেকিস্তান যাচ্ছি। সম্মেলনটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তবে সম্মেলনের সাইড লাইনে উজবেকিস্তানসহ আরও কয়েকটি দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের সঙ্গে আমার বৈঠক হবে।