টোপ দিবে আবার ধমকও দিবে কিন্তু এই সরকারের অধিনে আর কোন নির্বাচনে যাবো না —মীর্জা ফখরুল

আপডেট: এপ্রিল ১৯, ২০২২
0

দেশে দম বন্ধ করা পরিবেশ বিরাজ করছে মন্তব্য করে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, প্রতিদিন বাংলাদেশে মানুষের অধিকার নিয়ে মানুষ কথা বলার চেষ্টা করছে, বলতে পারছে না। তাকিয়ে দেখুন, চারদিকে একটা ভয়াবহ রকমের অক্টোপাসের মতো সমস্ত কিছু দম বন্ধ করার একটা পরিবেশ সৃষ্টি করে দিয়েছে।

তিনি বলেন, দেশের এই অবস্থা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। সমস্ত রাজনৈতিক দলকে সাথে নিয়ে আগামীদিনে অবশ্যই সেই ধরনের আন্দোলন তৈরি করতে সক্ষম হবো, যে আন্দোলনের মধ্য দিয়ে আমাদের ওপর চেপে থাকা ভয়াবহ দানবকে পরাজিত করে সত্যিকার অর্থেই জনগণের একটি প্রতিনিধিত্বমূলক সরকার প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হবো, সেই পার্লামেন্ট ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হবো।

সোমবার সকালে গুলশান লেকশোরে বিএনপি আয়োজিত এক আলোচনা সভায় দেশের বর্তমান অবস্থা তুলে ধরতে গিয়ে বিএনপি মহাসচিব এসব কথা বলেন।

মির্জা ফখরুল বলেন, আসুন আমরা সবাই ঐক্যবদ্ধ হয়ে আমাদের দেশকে রক্ষা করবার জন্য, আমাদের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বকে রক্ষা করবার জন্য, আমাদের গণতন্ত্রকে ফিরে পাওয়ার জন্য এবং গুম হয়ে যাওয়া সন্তানদের ফিরে পাওয়ার জন্য ঐক্যবদ্ধ হয়ে সংগ্রাম করি, আন্দোলন করি। একটা সত্যিকার অর্থেই গণতান্ত্রিক পরিবেশ ফিরিয়ে নিয়ে আসি যেখানে জবাবদিহিতা থাকবে। যেখানে এ ধরনের কোনো মা আর কাঁদবে না, কোনো সন্তান তার বাবাকে খুঁজবে না – সেই পরিবেশ আমরা তৈরি করি।

বিএনপি মহাসচিব বলেন, যারা গুম হয়ে গেছেন আমি জানি না – তারা আমাদের কাছে ফিরে আসবেন কিনা। আমরা প্রতি মুহূর্তে প্রার্থনা করি, আল্লাহর কাছে দোয়া চাই তারা(গুম হওয়া) যেন ফিরে আসেন। আর যারা খুন হয়ে গেছে, যাদেরকে হত্যা করা হয়েছে যে, তাদের পরিবার-পরিজনদের একই অবস্থা।

তিনি বলেন, আমাদের গুম হয়ে যাওয়া পরিবারগুলো আছেন, তাদের স্বজনদের কথা শুনে আমরা কষ্ট পেলেও অনুপ্রাণিত হই। তারা যে ত্যাগ স্বীকার করেছেন, এখনো করে যাচ্ছেন সেটা আমাদেরকে এই সংগ্রামে, আমাদের এই যুদ্ধে সাহস যোগাবে এবং আমরা সামনের দিকে আরো এগিয়ে গিয়ে সফল হতে পারবো।

গুম হওয়া পরিবারের পাশে বিএনপি আছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমাদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান সাহেব প্রত্যেকটি গুম হওয়া পরিবারের খবর রাখেন। আমাদের মানবাধিকার সেল তারা চেষ্টা করে বিষয়টাকে আন্তর্জাতিক মহলে নিয়ে এসে কাজ করার জন্যে।

মির্জা ফখরুল বলেন, ‘এটা এমন একটা সময় যখন ক্ষমতাসীনরা চূড়ান্ত বিপদের মধ্যে। ওরা একদিকে আপনাদেরকে স্টিক দেখাবে, আরেকদিকে ক্যারেড দেখাবে। ইংরেজিতে যেমন বলে স্টিক এ্যান্ড ক্যারেড পলিসি – ঠিক এরকম চেষ্টা করবে। আপনাদেরকে ধমক দেবে আবার ওইদিকে নির্বাচনের টোপ দেবে।’

তিনি বলেন, দেখেছেন না, নিষেধাজ্ঞা দেবার চার মাস পরে গতকালকে কুমিল্লাতে একটা আবার ক্রসফায়ার হয়েছে। এই ক্রসফায়ারের জন্য আমেরিকা বলেন, অন্যরা বলেন, নতুন করে আবার প্রশ্ন করবে, আবার তাদের নতুন করে সেঙ্কশন দেবে। আন্তর্জাতিক রাজনীতি মানবতা রেখে চলে না সবসময়। বরঞ্চ বেশিরভাগ সময় আন্তর্জাতিক রাজনীতি এমনকি দেশের রাজনীতিও কেবলমাত্র ক্ষমতার হিসাব-নিকাশের ওপরে চলে। আমি মনে করি খুবই যথার্থভাবে আপনারা বলেছেন ‘নো টু দিস গভার্নমেন্ট, আমরা একে মানি না, এর অধীনে কোনো নির্বাচন করবো না।’

বিএনপির সাবেক সংসদসদস্য ইলিয়াস আলীর নিখোঁজ হওয়ার ১০ বছরপূর্তি উপলক্ষে ‘ইলিয়াস আলীসহ সকল গুমের শিকার ব্যক্তিদের ফিরিয়ে দাও’ শীর্ষক এই আলোচনা সভা হয়।অনুষ্ঠানের শুরুতে বিএনপির ৬ শ’র অধিক ‘গুম’ হওয়ার ওপর একটি ভিডিও ক্লিপ দেখানো হয়।

২০১৭ সালে ১৭ এপ্রিল বনানীর আমতলীর কাছ থেকে এম ইলিয়াস আলী ও তার গাড়ি চালক আনসার আলীকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী প্রতিষ্ঠানের সদস্যরা তুলে নিয়ে যায়।

স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, আজকে অত্যন্ত ভারাক্রান্ত মন নিয়ে আমরা এখানে বসেছি। গুম পরিবারের সদস্যদের সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা আমাদের নাই, তাদের প্রতি কিভাবে আমরা সহানুভূতি প্রকাশ করবো তার ভাষাও আমাদের কাছে নাই। গুম করে নানা নির্যাতন করা এমনকি থানায় জিডি পর্যন্ত করতে দেয় নাই – আজকে কিন্তু এই বিষয়গুলো আর গোপন থাকে নাই। গুম হওয়া পরিবারের কান্নায় আমরা ভাষাহীন।

তিনি বলেন, আমরা স্পষ্ট করে বলতে চাই, আজকে আমাদের জনগণের কাছে এটা পরিষ্কার যে, এই অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে হলে বর্তমানে এই স্বৈরাচারী ফ্যাসিস্ট সরকারের হাত থেকে জনগণকে রক্ষা করতে হবে। এই কান্নার শেষ দেখতে হলে এই সরকারকে বিদায় করতে হবে। তা করতে হলে এদেশের সকল গণতান্ত্রিক, দেশপ্রেমিক জনগণ, ব্যক্তি, দলকে ‘সরকার হটাও’ ইস্যুতে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। তা না হলে এদেশে কারো কান্না থামবে না।

ফখরুল বলেন, সম্প্রতি প্রকাশিত আমেরিকার মানবাধিকার রিপোর্টে বাংলাদেশের মানবাধিকার বিষয়ে পুঙ্খনাপঙ্খরূপে প্রকৃত সত্য ঘটনাগুলোকে তুলে ধরা হয়েছে। অনেক মন্ত্রী বলেন, এই রিপোর্টের সাথে বাস্তবতার অনেক তফাৎ। আমি তাদের সাথে একমত যে, এই রিপোর্টের সাথে বাস্তবতার তফাত এই কারণে যে, বাস্তবতা হচ্ছে আরো কঠিন, বাস্তবতা হচ্ছে আরো অনেক ঘটনা। এই রিপোর্ট দেখলে বুঝতে পারি সরকার কোনো কিছু ধামাচাপা দিয়ে রাখতে পারেনি।

‘সিন্দাবাদের দৈত্যের চাইতে নিষ্ঠুর দৈত্য বসে আছে’

নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, এখন এতোগুলো বছর পরে এটাই হলো সত্য যে, আমরা সিন্দাবাদের দৈত্যের চাইতে নিষ্ঠুর একটা দৈত্যকে কাঁধে নিয়ে চলছি। না নিয়েও উপায় নেই। আমরা যদি অনেক জোরে কাঁধ ঝাকি দেই উনি পড়েন না, আমরা যেরকম করেই চেষ্টা করছি উনি যাচ্ছেন না।

তিনি বলেন, ভাববার বিষয়। তখনই বলেছিলাম, মাফ চেয়ে, হাতবদল করে যত মিনতি করেন, এরা আপনাদের হারানো স্বজনদের ফিরিয়ে দিতে পারবেন না। কারণ ওরা তো নিজেরাই নিয়ে গেছে এবং নিয়ে যে গেছে, এর পেছনে লক্ষ্য ছিলো একটাই – তাদের রাজনীতি, তাদের দল, তাদের ক্ষমতা পাকাপোক্ত করবে।

অনুষ্ঠানে গুম হওয়া নেতা-কর্মীদের পরিবারের সদস্যদের মধ্যে ইলিয়াস আলীর সহধর্মিনী তাহসিনা রুশদীর লুনা, সাইদুর রহমানের বাবা শফিকুর রহমান, মাজহারুল ইসলাম রাসেলের ভাই মশিউর রহমান লোটাস, পারভেজ হোসেনের ছোট মেয়ে আদিবা হোসেন হৃদি, নুরুজ্জামান রনির স্ত্রী মনিসা, মনির হোসেনের ভাই ওবায়দুল্লাহ হোসেন তাদের মনবেদনা ও আকুতির কথা তুলে ধরেন।

মির্জা ফখরুলের সভাপতিত্বে ও মানবাধিকার বিষয়ক কমিটির সদস্য অ্যাডভোকেট ফারজানা শারমিন পুতুল ও ইলিয়াস আলীর ছেলে ব্যারিস্টার আবরার ইলিয়াসের সঞ্চালনায় আলোচনা সভায় দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য আবদুল মঈন খান, গণ-অধিকার পরিষদের আহ্বায়ক ড. রেজা কিবরিয়া, শিক্ষাবিদ অধ্যাপক মাহবুব উল্লাহ এবং বিএনপির মানবাধিকার বিষয়ক সম্পাদক অ্যাডভোকেট আসাদুজ্জামান আসাদ বক্তব্য রাখেন।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, সেলিমা রহমান, জ্যেষ্ঠ নেতা শাহজাহান ওমর, জয়নুল আবদিন ফারুক, শাহজাদা মিয়া, ইসমাইল জবিউল্লাহ, অধ্যাপক সাহিদা রফিক, অধ্যাপক তাজমেরী এস এ ইসলাম, অধ্যাপক আব্দুল কুদ্দুস, অধ্যাপক মামুন আহমেদ, শ্যামা ওবায়েদ, শহিদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানি, মীর হেলাল, ফরিদা ইয়াসমীন, আবেদ রাজাসহ কেন্দ্রীয় নেতারা এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।

অনুষ্ঠানে ঢাকাস্থ যুক্তরাজ্য ও কানাডা দূতাবাসের কূটনীতিকরা ছিলেন।