দানব ঠেকাতে সাংবাদিকদের ‘বিভক্তি’ ছেড়ে ‘একাট্টা’ হতে বললেন মির্জা ফখরুল

আপডেট: মে ২১, ২০২১
0

দানব ঠেকাতে সাংবাদিকদের ‘বিভক্তি’ ছেড়ে ‘একাট্টা’ হতে বললেন মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।অনুসন্ধানী সাংবাদিক রোজিনা ইসলামের গ্রেপ্তারের প্রসঙ্গ টেনে শুক্রবার এক আলোচনা সভায় বিএনপি মহাসচিব এই অনুরোধ জানান।তিনি বলেন, ‘‘ সাংবাদিকদের মাথা তুলে দাঁড়াতে হবে। রোজিনা ইসলামেরর মতো মেয়েরা তো আছে। তারা তো মাথা তুলে দাঁড়াবার চেষ্টা করছে।”

‘‘ আমি অনুরোধ করবো বিভক্তিগুলো রাখবেন না। একটা-দুইটা-তিনটা-চারটা সাংবাদিক ভাইদের মধ্যে ইউনিয়ন, অ্যাসোসিয়েশ। তাহলে কী হচ্ছে? একজনের যে ভাষা, একজনের যে বক্তব্য সেটা কিন্তু সেই জোর পাচ্ছে না। আজকে সবাই মিলে একজোট হয়ে বলেন যে, সাংবাদিক নির্যাতন চলবে না, নির্যাতন চলবে না। তাহলে দেখবেন যে আস্তে আস্তে সন্মান বাড়ে।”

সাংবাদিকদের উদ্দেশ্য করে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘‘শুধু একটা অনুরোধ থাকবে, আপনারা অন্যায়কে অন্যায় বলবেন, স্পেটকে স্পেট, কালোকে কালো বলেন, সাদাকে সাদা বলেন।”‘‘ আসুন না আমরা নিজের দেশটাকে বাঁচানোর জন্য আমরা সবাই মাথা তুলে দাঁড়াই, অন্তত একবার দাঁড়াই। তাহলে দেখবেন অনেক কিছু সহজ হয়ে যাবে।”
তিনি বলেন, ‘‘ আপনারা দেখুন, সাংবাদিক নেতা রুহুল আমিন গাজী ভাই আজ ৭/৮ মাস হচ্ছে তিনি জেলে। কেনো জেলে? ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টের অপরাধে। এই আইনটি করার সময়ে আমাদের সকল সাংবাদিক ভাইয়েরা এক আন্দোলন করেছিলেন দাবি জানিয়েছিলো যে এই আইন করা যাবে না।দেখা গেলো সেটাই ভেঙ্গে গেলো, বেস্তে গেলো।”

‘‘ লোভের কাছে মাথা নত করা যাবে না, নিজের কাছে মাথানত করা যাবে না। নিজেকে বাঁচানোর জন্যে, নিজে ভালো থাকব, নিজে ভালো গাড়ি চড়ব, নিজের এপার্টমেন্ট ভালো পাব এই করে যদি চিন্তা করি তাহলে সাংবাদিক কমিউনিটিকে বাঁচানো ‍যাবে না, গণমাধ্যমকে বাঁচানো যাবে না।”মির্জা ফখরুল বলেন, ‘‘ দুইটি দানব আমাদের আক্রমন করেছে। একটি হচ্ছে করোনাভাইরাস কোবিড, আরেকটি হচ্ছে এই আওয়ামী লীগ সরকার। কোবিড দানব তো আসলে গোটা বিশ্বকে একদম তচনচ করে দিয়েছে। এখন বর্তমান সরকার এই দানবের মতে্াই বাংলাদেশের ৫০ বছরের যত অর্জন, তারও আগের থেকে স্বাধীনতার জন্য আমাদের আন্দোলন-যুদ্ধের যে অর্জন সব কিছুকেই এই আওয়ামী লীগ সরকারের দানব একদম লন্ডভন্ড ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছে।”

‘‘ আওয়ামী লীগের লক্ষ্যটাই হচ্ছে যে, বাংলাদেশকে ধবংস করে দেয়া, এটা তাদের লক্ষ্য। আপনারা লক্ষ্য করে দেখেন -১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের পরে তারা ঠিক একইভা্বে একই কায়দায় যেখানে আমরা গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম করেছি, সংবিধান তৈরি করেছি, সেই সংবিধানকে ছিঁড়ে ফেলেছে একদলীয় শাসনব্যবস্থা বাকশাল গঠন করা হয়েছে। আমার খুব দুঃখ হয়, কষ্ট হয় যখন আমি দেখি যে আমাদের সাংবাদিক অনেক বন্ধু আছেন, নেতা আছেন ওই সময়টা উল্লেখ করে না, ৭২-৭৫ সাল বলতেই চায় না। কেনো? লজ্জায় কোথায়। এদেশে সমস্ত পত্রিকা বন্ধ করে দিয়েছিলো কে? শেখ মুজিবুর রহমান বাকশালের মাধ্যমে। এদেশে সাংবাদিকরা কখন ফুটপাতে গিয়ে হকারের কাজ করেছে, কখন? সেই সময়ে(শেখ মুজিবুরু রহমানের সময়ে)।”

বর্তমান অবস্থা তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘‘ এখনও সেই অবস্থা তৈরি হয়েছে। আমি জানি আমাদের বহু সাংবাদিক বন্ধুগণ কর্মচ্যুত হয়ে গেছেন, অনেক পত্রিকা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। এদেশের এনফোর্স ডিজএপিয়ারেন্স, জোর করে নি্খোঁজ করে দেয়া-এটাও শুরু করেছিলেন কিন্তু ওই শেখ মুজিবুর রহমানের সরকারের আমলে। প্রায় ৩০ হাজার তরুন-কিশোর তাদেরকে হত্যা করা হয়েছিলো শুধু ভিন্নমত পোষনের কারণে। এটা বাস্তবতা।”

‘‘ আজকে আবার সেই দানব নতুন মূর্তি নিয়ে এখানে একটু পরিবর্তন করেছে আপনার গণতন্ত্রের একটা মুখোশ পড়ে আছে সামনে, ছদ্মবেশ। সেই গণতন্ত্রের মুখোশ ও ছদ্মবেশ নিয়ে তারা এখানে কাজ করছে।সর্বনাশ যেটা করেছে বাংলাদেশের সমস্ত গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ধবংস করে দিয়েছে। আজকে রোজিনা ইসলাম, এটা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এর আগে ৪২ জন সাংবাদিককে হত্যা করা হয়েছে। সাগর-রুনির হত্যাকারীদের এখন পর্যন্ত খুঁজেই বের করতে পারেনি।”

গণমাধ্যমের ভুমিকার সমালোচনা করে ফখরুল বলেন, ‘‘ দলের নেত্রী নিপুণ রায় চৌধুরীকে একটা মিথ্যা অডিও ক্লিফ তৈরি করে আমাদেরই বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে প্রচার করিয়ে তাকে বাড়ি থেকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে গেলো। সে নাকী নাশকতায় উস্কানি দিচ্ছিলো। এরকম মামলা তো আমাদের বিরুদ্ধে কমপক্ষে ৫০টার বেশি। ম্যাডাম বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে একই মামলা, একই সময়ে ৭টি স্থানে বোমা মারা- এটা জোক নয়। এদেশের রাজনীতিবিদদের বিরুদ্ধে এরকম মামলা হয়, সবচেয়ে জনপ্রিয় নেত্রীর বিরুদ্ধে এই ধরণের মামলা হয়।”

‘‘ দুর্ভাগ্য আমাদের যে, আমাদের সংবাদ মাধ্যম কিন্তু সে বিষয়ে থুব জোরে-শোরে কথা বলেন না, দুর্ভাগ্য আমাদের দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া্র যে মিথ্যা মামলা চললো, সেই মিথ্যা মামলাকে সেইভাবে মিরিট-টেরিট নিয়ে সেই নামী-দামী পত্রিকাগুলোতে কোনো ফিচার লেখতে আমি দেখিনি। এটা ডাবল স্ট্যান্ডার্ড।”

স্বাস্থ্য সেবা মন্ত্রণালয়সহ সরকারের দুর্নীতির মুখোশ উন্মোচনে বিভিন্ন অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের জন্য সাংবাদিক রোজিনা ইসলামকে ধন্যবাদ জানান তিনি।ফখরুল বলেন, ‘‘ বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার জন্য রোজিনাকে আজকে ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে, তার জামিন হচ্ছে না। আজকে নিপুণ রায় চৌধুরীর জামিন হয় না কেনো? প্রধানত কারণ হচ্ছে সে একজন প্রতিবাদী মেয়ে। তুমি এতো প্রতিবাদী হবে কেনো? তুমি হিন্দু মেয়ে হয়ে তুমি এতো লাফাচ্ছো কেনো?নিপুণকে তারা শিক্ষা দিতে চায়।”

‘‘ আর রোজিনাকেও শিক্ষা দিতে চায়, তাকে দেখিয়ে সব সাংবাদিক ভাইয়েদের দেখাতে চায়- দেখো বেশি নাচানাচি করো না। এটাই হচ্ছে ফ্যাসিস্টের চরিত্র। গোটা মানুষকে ভয় দেখিয়ে তাদের স্তব্ধ করে দিতে চায়।”তিনি বলেন, ‘‘ এরা(ক্ষমতাসীনরা) সারাদেশে মামলা দিয়ে সমস্ত গণতান্ত্রিক আন্দোলন, গণতন্ত্রের যত সংগ্রাম তাকে দলে-পিষে মিশে ফেলতে চায়। সাংবাদিক শফিক রেহমানকে জেলে পুরো, দেশ থেকে বের করে দিয়ে, মাহমুদুর রহমানকে দেশ থেকে বের করে দিয়ে, রুহুল আমিন গাজীকে জেলে পুরে, নিপুণ রায় চৌধুরীকে জেলে পুরে, রোজিনা ইসলামকে জেলে রেখে, মুশতাকতে হত্যা করে শেষ রক্ষা হবে না, শেষ রক্ষা হয়নি কোনোদিন। এটা হতে পারে না। এটা ইতিহাস, এটা বিজ্ঞান, এটা সভ্যতা।”

‘‘ মানুষ তার নিজস্ব প্রয়োজনে উঠে দাঁড়াতে শুরু করেছে। আমাদের সেই সংগ্রাম শুরু করতে হবে, সেই যুদ্ধ শুরু করতে হবে, যে সংগ্রাম আমরা এই দানবকে সরিয়ে দিয়ে বাংলাদেশকে মুক্ত করবো, দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করবো। আমরা আশা করি, মানুষ জেগে উঠবে, এই সরকারের পতন হবে।”স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, ‘‘ আমার মনে হয় যে, রোজিনা ইসলামকে যে কারণে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, সাগর-রুনির হত্যার মনে হয় এর সাথে যোগসূত্র-সামঞ্জস্য আছে –এটা সাধারণ মানুষ মনে করে।”

‘‘ রাষ্ট্রীয় সিক্রেট ডকুমেন্ট রোজিনা চুরি করেছে। কিন্তু যে ডকুমেন্টটা চুরি করলো সেটা কী আপনারা মামলার নথিতে আলামত হিসেবে দিয়েছেন। দেন নাই। সেই রাষ্ট্রীয় সিক্রেসীটা কী?যেটা জানলে দেশে-বিদেশে দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হবে। এমন কাজ করেন কেনো? যে কাজ করলে দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হয়-এটা তো অপরাধ।”

তিনি বলেন, ‘‘ সাংবাদিকদের ধন্যবাদ জানাই। রোজিনার জন্য আপনারা একসুরে কথা বলছেন, একসঙ্গে প্রতিবাদ করছেন। এই ধারাটা বজায় রাখুন।”‘‘ ওই সাগর-রুনির মতো যেন আবার হঠাত করে উপদেষ্টা হয়ে আবার সব যেন একটা কোল্ড স্টোরে না যায়, আপনাদের এই শানিত চেতনা যেন স্তব্ধ না হয়ে যায়।”

জাতীয় প্রেসক্লাবের তৃতীয় তলায় আবদুস সালাম হলে জাতীয়তাবাদী মহিলা দলের উদ্যোগে সাংবাদিক রোজিনা ইসলাম, রুহুল আমিন গাজী, রাজনৈতিক নেত্রী নিপুণ রায় চৌধুরীসহ রাজবন্দিদের মুক্তির দাবিতে এই আলোচনা সভা হয়।

মহিলা দলের সভানেত্রী আফরোজা আব্বাসের সভাপতিত্বে ও যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হেলেন জেরিন খানের পরিচালনায় আলোচনা সভায় জাতীয় প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি শওকত মাহমুদ, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি আবদুল হাই শিকদার, বর্তমান সভাপতি কাদের গনি চৌধুরী, মহিলা দলের নেত্রী নাজমুন নাহার বেবী, নেওয়াজ হালিমা আরলী, নিলোফার চৌধুরী মনি প্রমূখ বক্তব্য রাখেন।