দেড় লাখ মানুষের ভোটে ব্রিটেনের নতুন প্রধানমন্ত্রী বেছে নিচ্ছেন

আপডেট: সেপ্টেম্বর ৪, ২০২২
0

বরিস জনসনকে যখন ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী ও কনজারভেটিভ পার্টির নেতার পদ থেকে সরে যেতে হবে, তখন তার জায়গায় যিনি আসবেন তাকে নির্বাচনের জন্য কোনো সাধারণ ভোট হবে না।

এর পরিবর্তে তার নিজের রাজনৈতিক দলের প্রায় এক লাখ ৬০ হাজার সদস্য তার উত্তরসূরী নির্বাচন করবেন।

তাহলে প্রশ্ন ওঠে, গত সাধারণ নির্বাচনে যেখানে ৪০ লাখ ৭০ হাজার ভোটার নিবন্ধিত ছিলেন, সেখানে এত কম সংখ্যক লোক কিভাবে দেশের একজন নেতা নির্বাচন করতে পারেন?

এর জবাব লুকিয়ে রয়েছে ব্রিটেনের অনন্য এক রাজনৈতিক ব্যবস্থার মধ্যে। যার অর্থ, এবার নতুন প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনে শুধুমাত্র তারাই ভোট দেবেন যারা কনজারভেটিভ পার্টির চাঁদা দানকারী সদস্য।

কিন্তু ব্যাপারটি এবারই প্রথমবার নয়। কখনো কখনো এর চেয়েও কম লোক নতুন নেতা বেছে নিয়েছেন।

কেন শুধু দেড় লাখ মানুষের ভোট?

ব্রিটেনে যখন কোনো প্রধানমন্ত্রী তার মেয়াদকালের মধ্যে পদত্যাগের ঘোষণা করেন তখন কোনো সাধারণ নির্বাচনের আয়োজন করা হয় না। এর পরিবর্তে ক্ষমতাসীন দলের সদস্যরা কেবল একজন নতুন নেতা বেছে নেন।

বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন যখন পদত্যাগ করার কথা ঘোষণা করলেন তখন কনজারভেটিভ পার্টি এমপি ও দলের সদস্যদের পরবর্তী পদক্ষেপ হয় তার উত্তরসূরি বেছে নেয়া।

কিভাবে নির্বাচিত হন কনজারভেটিভ নেতা

বর্তমানে কনজারভেটিভ পার্টির সাধারণ সদস্যরা বিজয়ী প্রার্থী নির্ধারণের জন্য একটি ব্যালটে অংশ নেন। কিন্তু টোরি দলের এই প্রায় এক লাখ ৬০ হাজার সদস্য ব্রিটেনের মোট ভোটার সংখ্যার মাত্র শূন্য দশমিক তিন শতাংশ।

এই প্রক্রিয়াটি কতখানি ন্যায্য অতীতে তা নিয়ে বহুবার অভিযোগ করা হয়েছে, কিন্তু ব্রিটেনের নতুন প্রধানমন্ত্রীকে কেবল তার নিজস্ব রাজনৈতিক দল ও এর সংশ্লিষ্ট সমর্থকরাই নির্বাচিত করবেন, এটা মোটামুটি সাধারণ প্রথা।

গত অর্ধ শতাব্দী ধরে দেশের প্রায় অর্ধেক নেতা নির্বাচিত হয়েছেন তাদের রাজনৈতিক দলের মাধ্যমে, জাতীয় নির্বাচনে সাধারণ জনগণের ভোটের মাধ্যমে নয়।

এর আংশিক কারণ হচ্ছে, ব্রিটিশ রাজনৈতিক ব্যবস্থায় দুটি সাধারণ নির্বাচনের মধ্যবর্তী সময়ে জনপ্রিয়তা কমে গেলে সরকার প্রধান তার নিজের দলের মাধ্যমে অপসারণের ঝুঁকিতে পড়েন। এটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি পদ্ধতির সম্পূর্ণ উল্টো

বয়স্ক এবং শ্বেতাঙ্গ

কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলোর সদস্যপদ সামগ্রিকভাবে দেশের মোট ভোটারদের প্রতিনিধিত্ব করে না।

গবেষণা থেকে জানা যায়, অন্য প্রধান রাজনৈতিক দলের সদস্যদের মতো কনজারভেটিভ পার্টির সদস্যরা দেশের জনসংখ্যার বাকি অংশের তুলনায় একটু বেশি বয়স্ক, একটু বেশি মধ্যবিত্ত এবং একটু বেশি শ্বেতাঙ্গ।

লন্ডনের কুইন মেরি ইউনিভার্সিটি ও সাসেক্স ইউনিভার্সিটির পার্টি মেম্বার্স প্রজেক্টের প্রধান প্রফেসর টিম বেল বলেন, যারা আমাদের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী বেছে নিচ্ছেন তারা সামগ্রিকভাবে মোটেও সাধারণ ভোটারদের প্রতিনিধিত্ব করেন না। জাতিসত্তার দিকে থেকে তারা মোটেও বৈচিত্র্যপূর্ণ নন। তাদের বেশিরভাগের বাস ইংল্যান্ডের দক্ষিণাঞ্চলে। মহিলাদের তুলনায় পুরুষদের সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি। তারা সাধারণত একটু বেশি বিত্তবান। কিন্তু কেউ কেউ যেমনটা কল্পনা করেন যে তারা হয়তো ততটা বয়স্ক নন (গড়পড়তায় তাদের বয়স ৫০-এর শেষভাগে, যদিও প্রতি ১০ জনের মধ্যে চারজনের বয়স ৬০-এর বেশী। তারপরও তারা অপেক্ষাকৃত বয়স্ক। সংক্ষেপে, রাজনৈতিক বিজ্ঞানীরা যাকে ‘নির্বাচকমণ্ডলী’ বলে থাকেন, সাধারণ ভোটারদের তুলনায় এই নির্বাচকমণ্ডলী অনেকটাই আলাদা হয় ‘

অধ্যাপক বেলের গবেষণা অনুযায়ী, ব্রিটেনের বেশিরভাগ রাজনৈতিক দলের বেশিরভাগ সদস্যই মধ্যবিত্ত, কিন্তু কনজারভেটিভ পার্টির সদস্যরা তাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি মধ্যবিত্ত।

সব প্রধান দলগুলোতেই কৃষ্ণাঙ্গ ও সংখ্যালঘু জাতিসত্তার সদস্য অপেক্ষাকৃত কম।

অধ্যাপক টিম বেলের দলের তৈরি ২০১৮ সালের একটি প্রতিবেদন অনুসারে, ৯৭ শতাংশ কনজারভেটিভ সদস্য ছিলেন ‘শ্বেতাঙ্গ ব্রিটিশ,’ অন্যদিকে লেবার পার্টি ও লিবারেল ডেমোক্র্যাটদের মধ্যে শ্বেতাঙ্গ ছিল ৯৬শতাংশ।

সুতরাং এখন ব্রিটেনের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হবেন এমন একদল লোকের মাধ্যমে যারা সামগ্রিকভাবে দেশের জনসংখ্যা প্রতিনিধিত্ব করেন না। তবে এই ঘটনা যে প্রথমবারের মতো ঘটেছে তাও না। এরকম ঘটনা ভবিষ্যতেও ঘটতে পারে।

ছোট থেকে আরো ছোট

আশ্চর্যজনকভাবে, অতীতে নির্বাচনের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী বাছাই করেছেন এমন লোকের সংখ্যা ছিল আরো কম। কনজারভেটিভ পার্টির জন্য ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত এবং লেবার পার্টির জন্য ১৯৮১ সাল পর্যন্ত, শুধুমাত্র এমপিরাই নতুন নেতা বেছে নিতে পারতেন। এর ফলে ভোটার সংখ্যা মাত্র কয়েক শ‘ লোকে নেমে এসেছিল। তারা সামগ্রিকভাবে আরো কম সংখ্যায় ব্রিটেনের জনগণের প্রতিনিধিত্ব করতেন।

এই নির্বাচন প্রক্রিয়া এমনকি সবসময় গণতান্ত্রিক ব্যাপারও ছিল না। কনজারভেটিভরা ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত নতুন নেতা নির্বাচনের জন্য এমপিদের মধ্যে কোনো নির্বাচনও করেনি। প্রার্থীদের একটি গ্রুপের মধ্য থেকে একজন বিজয়ী আবির্ভূত হবেন বলেই ধরে নেয়া হতো।

দলের সিনিয়র সদস্যরা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করতেন যে কে হবেন সবচেয়ে উপযুক্ত নেতা এবং শেষ পর্যন্ত কোনো আনুষ্ঠানিক ভোট ছাড়াই একজনকে নির্বাচিত করা হতো।

ঘৃণা ও ভালোবাসা

অদ্ভুত উপায়ে ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনের পেছনে একটি কারণ হলো, অপছন্দ হলেই ব্রিটিশ রাজনৈতিক দলগুলো তাদের নেতাদের ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেয়।

কনজারভেটিভরা ২০১০ সালে প্রধানমন্ত্রীর অফিসে আসীন হওয়ার পর থেকে ডেভিড ক্যামেরন, টেরিজা মে এবং বরিস জনসন – সকলেই দলের ভেতর থেকে চাপের মুখে পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন। ব্রিটিশ রাজনীতির বিশাল ব্যক্তিত্বরাও এর থেকে রেহাই পাননি।

গত ১০০ বছরের মধ্যে নির্বাচনে সবচেয়ে সফল দুই প্রধানমন্ত্রী, কনজারভেটিভ পার্টির মার্গারেট থ্যাচার এবং লেবার পার্টির টোনি ব্লেয়ার, যারা এক দশকেরও বেশি সময় ক্ষমতায় ছিলেন, তারা উপদলীয় আক্রমণের মুখে পদত্যাগ করেছেন।

কিন্তু হাউস অফ কমন্সের এমপিরা খুশি মনে তাদের নেতাদের পিঠে ছুরি মারলেও জনসমক্ষে কিন্তু তারা ঠিকই নেতাদের প্রশংসা করেন।

পার্লামেন্টে বরিস জনসনের শেষবারের বক্তৃতার পর দেখা গেছে, একদিকে কটূক্তিপূর্ণ হৈ-চৈ আর অন্যদিকে উঠে দাঁড়িয়ে হাততালি। (হাউস অফ কমন্সে এটি একটি বিরল ঘটনা, যেখানে হাততালি দেয়াকে প্রবলভাবে নিরুৎসাহিত করা হয়)।

তাদের মধ্যে অনেকেই অবশ্য তার আগের সপ্তাহগুলোতে তাকে পদ থেকে অপসারণের লক্ষ্যে তিক্ত বিবাদ করেছেন এবং তিনি নেতৃত্ব দেয়ার জন্য অযোগ্য বলে প্রকাশ্যেই তার সমালোচনা করেছেন।

সে কারণেই নতুন উত্তরসূরীকেও মনে রাখতে হবে যে দায়িত্ব গ্রহণের পর জনসনের মতোই তাদের ভাগ্যেও ভালোবাসা আর ঘৃণার রোলার কোস্টার ওঠানামা করতে পারে।

সূত্র : বিবিসি