নদীর জলে রক্তের দাগ

আপডেট: নভেম্বর ১০, ২০২৩
0

ডা জাকারিয়া চৌধুরী :

কল্পনার গল্প দিয়াই শুরু করি। গল্পটা কল্পনার কিন্তু সে গল্প যে নিছক কল্পনার ভিত্তিতে শেষ হইবে না তাহা এক প্রকার নিশ্চিত। যদি কেহ এই দুই বাক্যে আস্থা রাখিতে পারেন তবে আপনি নিরাশ হইবেন বলিয়া মনে হয় না। চলুন গল্পে যাই-

ল্যাতিন আমেরিকার দেশ ব্রাজিল। সেইখানে আছে আমাজান নদী। নদীবাহিত ফরেস্টের কথা বর্তমান জমানায় কেহ কিছুই শুনেন নাই এমন লোক দুনিয়ায় খুজিয়া বাহির করিতে কষ্ট হইবে নিশ্চিত। তো একদা সেই নদীর তীরে বসিয়া খোশ গল্পে ব্যাস্ত ছিল দুই নও জোয়ান। তাহাদের দোস্তি গভীর, বোধ করি তাহাদের দোস্তী আর বয়সের ব্যাবধান সামান্যই কম হইবে। যাহার মানে দাড়ায় তাহাদের বন্ধুত্ব দীর্ঘ দিনের; তাহাদের বয়সের কাছাকাছি। দুই বন্ধুর নানান কথার ফাকে ফাঁকে এক সময় দুইজনেই নিজ নিজ বীরত্বের ব্যাপারে আপন অবস্থানে দাঁড়াইয়া গেল। কেহই নিজেকে ছোট সেয়ানা এবং অন্যকে বড় সেয়ানা ভাবিতে নারাজ। দুজনাই নিজেকে সেরা বীর দাবিতে অনড় অবস্থানে টানিয়া লইয়া গেল। এখন কে বড় বীর, কে-ই বা খাটো, এই ফেরের ফয়সালা করিবে কে? তীরে ত তৃতীয় কেহ নাই। দুইজনেই যে শ্রেষ্ঠত্বের দাবিদার। অবশেষে একজন অন্যজনকে নদীর পানিতে গোসল করিয়া তাহার বীরত্ব প্রমানের চ্যালেঞ্জ ছুড়িয়া দিলে অন্যজনা কোনরূপ ভাবনা চিন্তা ছাড়াই উহা গ্রহন করিয়া নিল এবং কাল বিলম্ব না করিয়া নদীতে ঝাপাইয়া পড়িল।


আমাজানের জল কুমির, এ্যানাকোন্ডা, অজগর, পিরানহা মাছ সহ আরও নানান হিংস্র প্রানিতে ভর্তি। সেখানকার ছোট শিশুরাও এই সত্য জানে। সব জানিয়া শুনিয়াও সে এই রকম বেয়াক্কেলের মত কাজ করিবে জানিলে এমন প্রস্তাব তাহারে কেউ দিয়া বসিত কিনা সন্দেহ আছে। বীরকেও সময়ে এবং প্রয়োজনে দমানো যায় কিন্তু বীরত্বের লোভ যাহাকে পাইয়া বসে তাহাকে দমানোর সাধ্য কাহারো নাই। বীরত্বের লোভ আর বড়ত্বের দাবি ইতিহাসে মুর্খতার দাগ পলে পলে রাখিয়া গিয়াছে। অথচ সে খবর আজ বিস্মৃত। কেহ মনে রাখে না।


যাহা বলিতেছিলাম –

ঘটনার মোড় ঘুরিতে মুহূর্ত কাল বিলম্ব হইল না। বিরাট এক কুমির পানিতে ঝাপ দেয়া বন্ধুর পা কামড়াইয়া ধরিল। উপরের সুজন এই ঘটনায় বিমুঢ় হইয়া পড়িল। অবস্থার গুরুত্ব অনুধাবন করিয়া নিজের জীবন বিপন্ন হইতে পারে বুঝিয়াও নদীতে ঝাপ দিল। তাহার এই রন মূর্তিতে কুমির বাবাজি কি জানি কি বুঝিয়া শিকার ছাড়িয়া ডুব দিয়া উধাও হইয়া গেল। যে জনা প্রথমে পানিতে ঝাঁপাইয়া পড়িয়াছিল সে তখন কোন দিকে না তাকাইয়া নিজের জান নিয়া তীরে ফিরিল বটে, ফেরত আসা হইল না ২য় বন্ধুর। কারন অন্য আরেকটা কুমির যে ততক্ষনে তাহার ঘাড় কামড়াইয়া ধরিয়া ফেলিয়াছে। তাহার কোন হদিস আর পাওয়া গেল না। নদী জলে রক্তের দাগ রহিল ক্ষনকালের জন্যে।

সকলে পরে জানিল প্রথম জনে প্রতিশ্রুতি অনুসরন করতঃ একটা বিশাল কুমিরকে যুদ্ধে হারাইয়া আমাজান নদীতে গোসল সম্পন্ন করিয়া জীবন বাচাইয়া ফেরত আসিতে পারিয়াছে। দ্বিতীয়জন কুমির দেখিয়া-ই জ্ঞান হারাইয়া ফেলিয়াছে। ফলে কুমির তাহারে টানিয়া লইয়া গিয়াছে। সকলে এই কথা শুনিয়া তাহাকে বীর মানিয়া লইল। পরাজিতের গল্প ইতিহাসে স্থান পায় না। দ্বিতীয় বন্ধু তাই পরাজিতের টালিতে পরিয়া ইতিহাসেও রইল না। আত্মীয় স্বজনেরাও বেশিদিন বিলাপ করিল না। সকলে যে গল্প শুনিয়াছিল তাহা যে আংশিক সে কথা চ্যালেঞ্জ করিবার কেহ ছিল না। গল্প যেটুকু প্রচারিত হইয়াছে তাহাতে দোষ ধরিবার কোন এলিমেন্ট যে নাই।


ফলে, যে মরিল, সকলে তাহাকে বোকারাম ভাবিল। গল্প শেষ। এইটাই আমার কাল্পনিক গল্প।

এইবার আসি সত্যান্বেষনে। নবকুমারের কথা কয়জনে মনে রাখিয়াছেন? কপাল কুন্ডলার নবকুমার !! মনে পড়ে ! বনের হিংস্র ব্যাঘ্রের ভয়ে কেহই শুকনা কাঠ সংগ্রহে রাজি হইতেছিল না। এইদিকে কাঠ না হইলে রান্নার কাজ বন্ধ হইয়া যাইবে। নৌকায় থাকা সকল যাত্রীকে অনাহারে পরিতে হইবে!! নৌকার সকলকে না খাইয়া মরিতে হইবে। এই যখন অবস্থা তখন নবকুমার কাধে কুঠার লইয়া একাই বাহির হইয়া পড়িল কাষ্ঠ সংগ্রহের উদ্যেশ্যে। নবকুমারের দেরি দেখিয়া সকলে ধরিয়াই নিল তাহাকে ব্যাঘ্রে খাইয়াছে। নদীতেও জোয়ার আসিয়া পরিয়াছে। তাই তাহারা কাল বিলম্ব না করিয়া নদীতে জোয়ার আসিবার সাথে সাথেই মাস্তুল হইতে কাপড় নামাইয়া যেইদিকে বাতাস সেইদিকেই পাল তুলিয়া দিল। জাহাজ নড়িয়া চড়িয়া হেলিয়া দুলিয়া স্রোতের অনুকুলেই ভাসিল। গভীর বন হইতে ফিরিল নবু ( আমাদের নবকুমার ) তবে দেরি হইল যথেস্ট। নিজের জীবনের মায়া তুচ্ছ করিয়া যেই নবু সকলের জন্য কাষ্ঠ আনিল সেই সকলে এখন কোথায় ? বঙ্কিম বাবু নবকুমারের স্থানে নিজেকে ভাবিয়া যাত্রীদেরকে বলিয়া বসিলেন, ‘তুমি অধম। তাই বলিয়া আমি উত্তম না হইব কেন’ ? ইস্কুলের বইয়ে গল্প পড়িয়াছিলাম এইটুকুই। এইবার আসি নবুর জীবনের পরের কথায়। সে কি চিরকালের জন্য জংগলে আটকা পড়িয়াছিল ? নাকি বাড়ি ফিরিবার পথ পাইয়াছিল ?

ফিরিবার প্রশ্নে নবুর স্থানে আবারো বঙ্কিমের উত্তর, ‘ফিরিয়া-ই ফল কি ? জগতে কে কাহার ?’

পুতুল নাচের ইতিকথায় কুসুমের চরিত্রে ফিরিবার প্রশ্নে মানিক বন্দোপাধ্যায় বলিয়াছিল, ‘এখন হাতে ধরা কেন বাবু ? তখন তো ইশারা করিলেই চলিয়া আসিতাম।’

হাজার বছর ধরে’তে জহির রায়হানের উত্তর- এ আর হয়না মিয়া। এখন আর হয়না।

এত এত মহাজনের মাঝে ফিরিবার প্রশ্নে নিজের মত সংযোজন করিবার স্পর্ধা দেখাইব না। মাঝে মাঝে কেবল মনে হয়, পুড়িয়া কয়লা হইলাম, আর ফিরিয়া তোমার কয়লার চাহিদা পুর্ন করিলাম। দুই জীবনে দগ্ধ হইবার জন্যেই যেন কেহ কেহ প্রভুর নিকট হইতে তাহার নিয়তির খাতা নিজ হাতে লেখাইয়া নিয়া আসে । আমি যেন সেইরকম কিছু।

১০/১১/২৩
লেখক: নির্বাহী সম্পাদক দেশ জনতা ডটকম