নিজ জাতি নিধন কান্ডের ২৮ শে অক্টোবরের লগি বৈঠার আন্দোলন, ফিরে দেখা ইতিহাস

আপডেট: আগস্ট ১৫, ২০২৩
0

ডা : জাকারিয়া চৌধুরী:


পার্ট – ২

এ লেখাটির প্রথম পর্বের শিরোনাম ছিল, লগি বৈঠার আন্দোলন – মধ্যযুগের ইউরোপীয় ভাইকিংসের বর্বরতাকেও হার মানিয়েছিল। নিজ জাতি নিধন কান্ড সেই স্বাধীনতার আগে পরে সব সময় চালিয়ে এসছে বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ নামক অভিশপ্ত এই দলটি। এরশাদের জমানায় দেখেছি, যে কোনো দলের কেউ গুলিবিদ্ধ হলেই হলো! আওয়ামীলীগের লোকেরা সেই লোককে ঘিরে ফেলতো। প্রথমে মানবিকতা, দায়িত্বশীলতা…. এটা ওটা দেখাতো, আহত কর্মীকে টেনে হিচড়ে সরকারী হসপিটালে নিয়ে যেত… সেই আহত লোক মারা গেলে লাশ নিয়ে জংগী মিছিল করত, অগ্নিসংযোগ করতে শুরু করত মশাল মিছিলের নামে। এটা ওটা ঘটানো, ককটেল ফাটানো এবং দিন শেষে নিহত কর্মী টোকাই হোক, রিক্সাওয়ালা হোক, বিএনপি হোক, যাই হোক না কেন, লীগ তাদের দলীয় নেতা পরিচয় দিয়ে সর্বত্র প্রচারনা চালাতো। আমার মনে হয় না এরশাদ জমানায় আহত নিহত ৫% লোকও লীগ ব্যাতীত অন্য কোনো পরিচয়ে পরিচিতি পেয়েছে। কেবল মাত্র ভারতপুষ্ট মিডিয়ার জোরে টিকে থাকা দলটি আজ একটি অশ্লীল জগদ্দল পাথরের মত জাতির বুকে বিধে রয়েছে। এ দলটিকে সমুলে উপড়ে ফেলা এখন একটি জাতি বাচানো দায়িত্বে পরিনত হয়েছে।

১৯৮১ সালে জাতির ঘাড়ে চেপে বসা আরেক বাটপার ফ্যাসিস্ট এরশাদের ক্ষমতায় আসাকে স্বাগত জানিয়েছিল কেবল আওয়ামিলীগ। ১৯৮৬ সালের নির্বাচনে যারা যাবে তারা দেশের জাতীয় বেঈমান হবে ঘোষনা দেয়া আওয়ামী প্রধান পরদিন এরশাদের সাথে নির্বাচন নির্বাচন খেলায় অংশগ্রহন করেন জামাতের দাড়িপাল্লায় বসে। ১৯৯৬ সালের জাতীয় নির্বাচনকে প্ল্যান্ডার করে দেয় জামাত প্রধান গোলাম আজম আওয়ামীলীগের নৌকায় বৈঠা বেয়ে। এক দশকের মধ্যে কি চমৎকার রিটার্ন !! অবশ্য এতে অনেক বেশি অবাক হবার কিছু নেই! ১৯৭১ সালের ২৫ শে মার্চ মধ্য রাত পর্যন্ত পশ্চিম পাকিস্তানের সাথে লীগের হয়ে যে ছয়জন আলোচনা চালিয়ে গিয়েছিলেন, গোলাম আজম ছিলেন তাদের একজন। ইতিহাসকে অস্বীকার করা যাবে গায়ের জোরে, সত্যকে বাদ দেয়ার সুযোগ দুনিয়ার কোনো ইতিহাসে নেই। আমাদেরকে সত্যাশ্রয়ী হতে হবে।
Zakaria
Zakaria Chowdhury
১৯৯০ সালের তুমুল আন্দোলনের মধ্য দিয়ে এরশাদের মত জানোয়ারকে তার সিট থেকে লাথি মেরে ফেলে দেয়া হয়েছিল। সে সময়ের প্রধান বিচারপতি জাস্টিস শাহাবুদ্দিন সাহেব শর্ত স্বাপেক্ষে ক্ষমতা গ্রহন করে জাতিকে একটি চমৎকার নির্বাচন উপহার দিয়ে আবার নিজ আসনে ফিরে গিয়েছিলেন। সে নির্বাচন তামাম দুনিয়ায় এতোই গ্রহনযোগ্য ছিল যে, আওয়ামী প্রধান একে সুক্ষ্ণ কারচুপির নির্বাচন বলে হালে পানি পাননি। অবশ্য নির্বাচনের আগে তিনি বলেছিলেন, বিএনপি দশ আসনেও বিজয়ী হবে না। তার ভাগ্য ভাল যে, তিনি নিজে তিন আসনে ইলেকশন করে এক আসনে জিতে, দুই আসনে ফেল করে নিজের ইজ্জত কোনোনতে রক্ষা করতে পেরেছিলেন। ১৯৯৬ সালের ইলেকশনের সময় প্রধান উপদেষ্টা হয়েছিলেন জাস্টিজ হাবিবুর রহমান। তার অধীনে যে নির্বাচন হয় তাতে আওয়ামিলীগ জাতীয় পার্টিকে নিয়ে একটা জোড়াতালির সরকার গঠন করতে সমর্থ হয়। এখানে একটা কথা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য যে, ৯৬ ইলেকশনের আগে হাবিবুর রহমান তার লিখিত বইয়ে ৭ই মার্চের ভাষন সম্পর্কে লিখেন – জয় বাংলা, জিয়ে পাকিস্তান বলে মুজিব তার ভাষন শেষ করেন। লীগ ক্ষমতায় আসার পর সে বইয়ের পরের ভার্সনেই ৭ই মার্চের ভাষনের কথাগুলো কমে যায়। কথা শেষ হয় কেবলমাত্র -‘জয় বাংলা’ শ্লোগান দিয়েই। সে সময় আমার ভাবনায় বিচারপতিরা অনেক তো অনেক দুরের বিষয়, এদেশের কোনো ম্যাজিস্ট্রেট যে বিক্রি হতে পারে সে ভাবনা ভাবার মত ঘিলু তখনও আমার ঘটে জমেনি। ফলে দেশের মুক্তির ইতিহাস নিয়ে একজন প্রধান বিচারপতি ও প্রধান উপদেষ্টার এমন বালখিল্যতা দেখে সে সময় হাসতে পারিনি সাহসের অভাবে, আস্থার অভাবে। তিনি হয়ত আশা করেছিলেন, আওয়ামিলীগ তাকে রাষ্ট্রপতি বানিয়ে দেবেন। তার সে আশায় হয়তো গুড়ে বালি পড়েছে !

যে দল গোলাম আজমকে বুকে নিয়ে প্রয়োজনে ইয়াহিয়ার সাথে দুতিয়ালি করায়, প্রয়োজনে ১৭৩ দিন জ্বালাও পোড়াও করায়, আবার রাষ্ট্রপতি পদে তাদের প্রার্থীর পক্ষে ভোট দিতে গোলাম আজমের পায়ে ধরে সে দল বা তার প্রধান এত অল্পে তুষ্ট হবেন না। ১৯৭৩ সালে এবং ২০১৮ সালে তারা দেখিয়ে দিয়েছে, জাতীয় নির্বাচন তাদের অধীনে হনে একচ্যুয়ালি তাদের কি কি প্রয়োজন হয়। ফলে হাবিবুর রহমান সাহেবের এই সস্তা প্রচেষ্টাকে আওয়ামিলীগ হয়তো কানেই তুলেনি। অবশ্য তিনি নিজে কনফেশন না দিলে আমার মনে হওয়া না হওয়া নিয়ে কিছু যায় আসে না। ১৯৯৬ সালে আওয়ামিলীগ ক্ষমতায় আসার পর বাংলাদেশ বিপুল বিষ্ময় নিয়ে দেখে, দেশের মধ্যে নব দেশের সুচনা হয়েছে। লীগের লোকদের জন্য এক দেশ এক শাসন, বিএনপির জন্য এক দেশ অন্য শাসন, জামাতের জন্য এক দেশ ভিন্ন শাসন ব্যাবস্থা প্রবর্তিত হয়েছে। অরাজনৈতিক মানুষ আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে পরে গেছে। লীগ ক্ষমতায় আসার ২১ বছর আগে থেকে যে সমাজ ব্যাবস্থা গড়ে উঠেছিল সেখান থেকে হঠাৎ করে প্রচুর মানুষ এক রাতে চেঞ্জ হয়ে গেছে। যারা সারাদিন ভাই ভাই করে ফেনা তুলতো, এরাই পরদিন থেকে এলাকার সন্ত্রাসী হয়ে গেছে, হিন্দু সমাজ শতভাগ আলাদা হয়ে গেছে। এরা এখন আর আমাদের বাড়িঘরে খেতেও আসে না। সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থার নিয়ন্ত্রন জনপ্রশাসন থেকে চলে গেছে টোকাই প্রশাসন ও তাদের গড ফাদারদের হাতে। দেশ কাপতে শুরু করেছে জয়নাল হাজারী, ওসমান পরিবার, গোলন্দাজ পরিবার, মায়া পরিবারদের হাতে। সে সময়ের প্রধানমন্ত্রী নিজের ইমেজ বাড়াতে শাহাবুদ্দিন সাহেবকে আবার ডেকে এনে প্রধানমন্ত্রী বানিয়েছিলেন। ২০০১ সালের ইলেকশন শাহাবুদ্দিন সাহেব সে সময়ের সরকারের ইচ্ছেয় নির্বাচন করেননি। এর ফল হল, বিএনপিও চার দল দুই তৃতীয়াংশ মেজরিটি নিয়ে ক্ষমতায় ফিরে এলো। ত্বত্ত্বাবধায়ক ব্যাবস্থা লীগের জন্য বুমেরাং হয়ে গেল। যে ব্যাবস্থা আজীবন বহালের দাবিতে সারাটা দেশ জ্বালিয়ে দিয়েছিল, সেই ব্যাবস্থা হত্যার জন্যই উপায় খুজতে শুরু করে বর্তমান তথাকথিত সরকার। যার ফল ভোগ করছে আজকের বাংলাদেশ।

আওয়ামীলীগ যাকে বন্ধু বানায় তাকে যেমন খায়, যাকে শত্রু ভাবে তাকেও খায়। এরপর এরা নিজেরা নিজেদের খেতে শুরু করে। এদেশে এমন বিচারপতিও দেখেছি যিনি কেবল একটা প্রমোশনের লোভে ফাসির আদেশ দিয়ে দেন। কে কিভাবে কিসের মহড়া দেবেন সেসবও আগেভাগে ঠিক করে রাখেন। কে খাড়াবেন, কে টেনে ধরবেন !! ছি : এরা নাকি সংবিধানের রক্ষক !! ফাসি টাসি দিয়ে প্রধান বিচারপতি হয়ে আবার নাকি লাথি খেয়ে দেশ ছেড়েছেন এমন অভিযোগও আছে সাম্প্রতিক অতীতের ইতিহাসে।

একটা বিষয় পক্ষে গেলে সাথে আছি, বিপক্ষে গেলেই জ্বালাও পোড়াও শুর করে দেয়া ডাবল স্ট্যান্ডার্ডের দল আওয়ামীলীগের আসল রুপ চিনে রাখা জরুরী। ইতিহাস নিয়ে তারা কি বলছে বা কি ভাবছে সেটা জরুরী নয়, বরং ইতিহাসের সত্যাসত্য ধরে রাখার জন্যই ইতিহাস জানা জরুরী। এতে সাপ মরবে, লাঠিও ভাংবে না।


লেখক: নির্বাহী সম্পাদক দেশ জনতা ডটকম