পুরো সমাজেই নির্যাতনের শিকার: নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠায় বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে মুক্ত হতে হবে— জাতীয় মানবাধিকার কমিশন চেয়ারম্যান

আপডেট: জুন ৭, ২০২৩
0

জাতীয় মানবাধিকার কমিশন বাংলাদেশ এর মাননীয় চেয়ারম্যান ড. কামাল উদ্দিন আহমেদ বলেছেন, নারীবিদ্বেষী দৃষ্টিভঙ্গির বহি:প্রকাশ আমরা পুরো সমাজেই দেখে থাকি। পুরো সমাজেই নারীরা নির্যাতনের শিকার হচ্ছে । নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠায় বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে মুক্ত হতে হবে। মহিলা পরিষদের উদ্যোগে আয়োজিত এক মত বিনিময় সভায় তিনি এ কথা বলেন।

আজ ৭ জুন ২০২৩ (বুধবার) বিকাল সাড়ে ৩টায় মোজাফ্ফর আহমেদ চৌধুরী মিলনায়তন, সমাজবিজ্ঞান অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকাতে নারী-বিদ্বেষী দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন: বিশ^বিদ্যালয়ে যৌন হয়রানি, নিপীড়ন ও উত্ত্যক্তকরণ প্রতিরোধে করণীয় বিষয়ে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের সাথে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের উদ্যোগে মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়।

মতবিনিময় সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন জাতীয় মানবাধিকার কমিশন চেয়ারম্যান ড. কামাল উদ্দিন আহমেদ। সভাপতিত্ব করেন সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি ডা. ফওজিয়া মোসলেম; স্বাগত বক্তব্য রাখেন সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু। সংগঠনের পক্ষে লিখিত বক্তব্য উপস্থাপন করেন লিগ্যাল এইড সম্পাদক রেখা সাহা। সভায় মুক্ত আলোচনায় অন্যান্যদের মধ্যে আরো বক্তব্য রাখেন বিভিন্ন বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষকবৃন্দ।

প্রধান অতিথির বক্তব্যে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন বাংলাদেশ এর মাননীয় চেয়ারম্যান ড. কামাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, নারীবিদ্বেষী দৃষ্টিভঙ্গির বহি:প্রকাশ আমরা পুরো সমাজেই দেখে থাকি। নারীর ক্ষমতায়ন কতটুকু হয়েছে তা এখন দেখার সময় এসেছে। এখানে কাঠামোগত কিছু বাধা আছে যা আমরা অতিক্রম করতে পারছিনা। তিনি এসময় পরিস্থিতির উত্তরণে এবং সুন্দর সমাজ প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে করণীয় সম্পর্কে বলেন বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে মুক্ত হতে হবে; নারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বারোপ করতে হবে, আইনের শাসন থাকতে হবে এবং নেতৃত্ব পর্যায়ের ব্যক্তিত্বদের মধ্যে নিজস্ব দায়বদ্ধতা থাকতে হবে। তিনি বলেন,বিশ^বিদ্যালয়ের যৌন হয়রানির ঘটনায় অবশ্যই ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

সভাপতিত্ব করেন সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি ডা. ফওজিয়া মোসলেম

লিখিত বক্তব্যে বলা হয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যৌন সহিংসতার ক্ষেত্রে শুধু শিক্ষার্থীরা নন বরং যারা সমাজ গড়ার কারিগর, নতুন প্রজন্ম গড়ার কারিগর, সেই শিক্ষক সমাজের কিছু সংখ্যক শিক্ষকও এই অপরাধের সাথে যুক্ত। শুধু নারী শিক্ষার্থীরা নন, নারী শিক্ষকরাও যৌন নিপীড়ন, যৌন হয়রানির শিকার হন।

স্বাগত বক্তব্য রাখেন সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু।

সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সংঘটিত ঘটনার উল্লেখ করে এসময় বলা হয় অন্যায়-অনাচার-নির্যাতনের ঘটনার বিচার না হওয়ার সংস্কৃতি ক্রমেই আধিপত্য বিস্তার করছে এবং আরো বর্বরতর ঘটনার জন্ম দিচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের নারী শিক্ষার্থী, নারী শিক্ষকসহ সকল স্তরের, সকল পেশার, সকল বয়সের নারীরা নিপীড়ন-নির্যাতন-অন্যায়-অনাচারের প্রধানতম শিকার। যা অত্যন্ত উদ্বেগজনক বলে মনে করে মহিলা পরিষদ। যৌন নিপীড়ন প্রতিরোধ ও প্রতিকারের কাজে নারী আন্দোলনের অভিজ্ঞতা ও বিভিন্ন পর্যায়ের মানুষের মতামতের ভিত্তিতে সংগঠনের পক্ষে কয়েকটি সুপারিশ উপস্থাপন করা হয় (

১. সন্তানের বেড়ে উঠা এবং সামাজিকীকরণের ক্ষেত্রে পরিবারের সদস্যদের যথাযথ ভুমিকা সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টির জন্য প্রচার-প্রচারণার উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
২. উত্ত্যক্তকরণ ও যৌন হয়রানির ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে ছেলে-মেয়েদের সচেতন করতে হবে।
৩. উত্ত্যক্তকরণ, যৌন হয়রানি যে শাস্তিযোগ্য অপরাধ- সেটা ব্যাপকভাবে প্রচার করতে হবে।
৪. সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও কর্মপ্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানি ও নিপীড়ন রোধে মহামান্য হাইকোর্ট বিভাগের নির্দেশনা অনুসারে অভিযোগ কমিটি গঠন, কার্যক্রম পরিচালনা এবং কমিটির কাজ মনিটরিং এর ব্যবস্থা করতে হবে।
৫. হাইকোর্ট বিভাগের নির্দেশনার আলোকে সকল বিশ্ববিদ্যালয়ে উত্ত্যক্তকরণ, যৌন হয়রানি ও নিপীড়ন রোধে নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে এবং নীতিমালার যথাযথ প্রয়োগ করতে হবে।
৬. নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০ এর বাতিলকৃত ধারা ১০(২) পুনর্বহাল করতে হবে
৭. সকল বিশ্ববিদ্যালয়ে জেন্ডার নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে এবং এই নীতিমালা সম্পর্কে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের ওরিয়েন্টেশন দিতে হবে।
৮. প্রতিরোধ ও প্রতিকারের ব্যবস্থা অন্তর্ভুক্ত করে উত্ত্যক্তকরণ, যৌন হয়রানি ও নিপীড়ন রোধে পৃথক আইন পাশসহ আইনের বাস্তবায়ন করতে হবে।
৯. বিশ্ববিদ্যালয়ে উত্ত্যক্তকরণ, যৌন হয়রানি ও নিপীড়ন প্রতিরোধে সমন্বিত, অন্তর্ভুক্তিমুলক, সুনির্দিষ্ট কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে।
১০. বিশ্ববিদ্যালয়ে যৌন হয়রানির ঘটনার দ্রুত তদন্ত ও প্রতিকার নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে।
১১. সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নারীর প্রতি সংবেদনশীল পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে।
১২. গণমাধ্যমে নারীদের ইতিবাচকভাবে উপস্থাপন করতে হবে।
১৩. গণমাধ্যমে উত্ত্যক্তকরণ তথা যৌন হয়রানির বিরুদ্ধে ইতিবাচক প্রচারণার উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
১৪. বিভিন্ন সামাজিক প্রতিষ্ঠান এবং সরকারকে যৌথভাবে যৌন হয়রানির ঘটনা প্রতিরোধে সক্রিয় হতে হবে।
১৫. শিক্ষা ব্যবস্থাকে জেন্ডার সংবেদনশীল করার লক্ষ্যে শিক্ষা কারিকুলামে জেন্ডার সমতা, মানবাধিকার, নারীর অধিকার-এর বিষয় যুক্ত করতে হবে।
১৬. সমাজের প্রচলিত, গৎবাঁধা নারী-বিদ্বেষী দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের জন্য ব্যাপক প্রচার-প্রচারণার মাধ্যমে জনসচেতনতা তৈরি করতে হবে।
১৭. সকল ধরনের বৈষম্য দূরীকরণসহ নারী-পুরুষের সমতাপূর্ণ সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার আন্দোলন শক্তিশালী করতে হবে।

জাহাঙ্গীর নগর বিশ^বিদ্যালয়ের যৌন হয়রানি ও নিপীড়ন নিরোধ কমিটির সভাপতি অধ্যাপক ড. জেবুননেসা বলেন,
জাহাঙ্গীর বিশ^বিদ্যালয় কমিটি গঠনের পর যৌন হয়রানির ঘটনার নিষ্পত্তিতে দ্রুত পদক্ষেপ নেয়া হয়। তিনি আরো বলেন, অপরাধীকে কঠোর শাস্তি প্রদান নিশ্চিতের ব্যাপারে কমিটির সদস্যদের ও রাজনীতি সহ অন্যান্য প্রভাবমুক্ত হতে হবে।

সভায় ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক জোবাইদা নাসরীন; ড.ইয়াসমিন হক, প্রাক্তন সভাপতি, যৌন নিপীড়ন প্রতিরোধ কমিটি, সিলেট শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ^বিদ্যালয়; খন্দকার ফারজানা রহমান, সহকারী অধ্যাপক অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়; প্রফেসর ড. মাহবুবা কানিজ কেয়া, চেয়ারপারসন মনোবিজ্ঞান বিজ্ঞান, রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয়; ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ড. সাদেকা হালিম; ড. শরীফা সুলতানা,চেয়ারপারসন,ড্যাফোডিল বিশ^বিদ্যালয়; ড. সিউতি সবুর, সহযোগী অধ্যাপক, ব্র্যাক বিশ^বিদ্যালয় এবং ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সভাপতি নিজাম উদ্দিন ভূইয়া বলেন, মানুষ হিসেবে আমরা একটা ক্ষমতার ভারসাম্যহীনতার মধ্যে আছি। যার প্রভাব বিশ^বিদ্যালয়ের কতিপয় শিক্ষকের মধ্যেও লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বিচারহীনতার সংস্কৃতিও একটা বড় কারণ।

শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যৌন নিপীড়নের প্রতিরোধে বিরুদ্ধে পৃথক আইন করতে হবে, শিক্ষক সমিতিকে জোরালো পদক্ষেপ নিতে হবে, কি কারণে এসব ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত হয়না তা দেখতে হবে। রাজনীতির কুপ্রভাব থেকে বিশ^বিদ্যালয়কে মুক্ত করতে হবে।
ঘটনার তদন্তের পর রিপোর্ট প্রেরণ করা হলে তা সিন্ডিকেটে উত্থাপন করার ক্ষেত্রে ভিসি মহোদয়ের সদিচ্ছার অভাব লক্ষ্য করা গেছে। এভাবে অপরাধী ছাত্ররা পাশ করে বের হয়ে যায়। তদন্ত কমিটির কাছে গেলেও অর্ন্তমুখী ও বহিমুর্খী নানা চাপের কারণে ভুক্তভোগী সুষ্ঠু বিচার পায়নি। কমিটির উদ্যোগে যৌন নিপীড়ন প্রতিরোধ বিষয়ে বিশ^বিদ্যালয় থেকে ছাত্রছাত্রীদের জন্য ওরিয়েন্টেশন দিতে হবে, কারিকুলামে জেন্ডার বেইসড ভায়োলেন্স বিষয়টি অর্ন্তভূক্ত করতে হবে এবং যেকোন প্রভাব মুক্ত হয়ে প্রতিটি ঘটনার সুষ্ঠু বিচার নিশ্চিত করতে হবে। নারী বান্ধববিশ^বিদ্যালয় তৈরি হতে হলে নারীবাদী নেতৃত্বের প্রয়োজন।২০০৯ এর রায়টি আইন হিসেবে বাস্তবায়িত হতে হবে। বিশ^বিদ্যালয়ের পাশাপাশি বিভিন্ন সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানেও নারীদের প্রতি যৌন নিপীড়নের ঘটনা ঘটছে। এগুলির প্রতিরোধে আমাদের সোচ্চার হতে হবে। বক্তারা রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয়ে একই বিভাগের শিক্ষক কর্তৃক একজন নারী শিক্ষকের প্রতি যৌন নিপীড়নের ঘটনার নিন্দা করেন এবং এঘটনার দ্রুত প্রতিকার দাবি করেন।

সভাপতির বক্তব্যে সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি ডা. ফওজিয়া মোসলেম বলেন, শিক্ষাঙ্গনে যৌন নিপীড়ন প্রতিরোধের ঘটনায় অভিযোগ কমিটি হলেই আমাদের সব কাজ শেষ নয়। সংগঠন তার দায়িত্ব পালন করছে, কিন্তু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকদের ও দায় আছে। শুধুমাত্র আইন দিয়ে সব সমস্যার সমাধান হয় না, এই আইনকে ধারণ করার মত মানসিকতা আমাদের থাকতে হবে, নিজেদের মানসিকতার পরিবর্তন করতে হবে।

উক্ত মতবিনিময় সভায় সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটির নেতৃবৃন্দ

স্বাগত বক্তব্যে সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু বলেন,নানা অগ্রগতি বাংলাদেশ কে এগিয়ে নিচ্ছে ঠিকই কিন্ত ঘরে বাইরে নারীর প্রতি বহুমাত্রিক সহিংসতার ঘটছে শুধুমাত্র নারী হওয়ার জন্য। রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয়ে সংগঠিত ঘটনার মধ্য দিয়ে অভিযুক্ত শিক্ষকের নারী বিদ্বেষী আচরণের প্রতিফলন ঘটেছে , যা ওই শিক্ষকের শিক্ষা ও সামাজিক অবস্থা কোন কিছুর সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। এমতাবস্থায় ভারসাম্যপূর্ণ সমাজ গঠনের জন্য সঠিক শিক্ষা প্রয়োজন, সহিংসতা প্রতিরোধে জিরো টলারেন্স নীতি প্রয়োজন। সংগঠনের দীর্ঘদিনের কর্মসূচির মধ্য দিয়ে হাইকোর্টের একটা রায় ।

মুক্ত আলোচনায় অংশ নেন ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের আইইআর বিভাগের শিক্ষার্থী রিফাত হোসেন দিগন্ত ও সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী সজীব হাওলাদার;

উক্ত মতবিনিময় সভায় সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটির নেতৃবৃন্দ, ঢাকাস্থ কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য, সামাজিক প্রতিরোধ কমিটির সদস্য সংগঠনের মধ্যে শক্তি ফাউন্ডেশন, গণসাক্ষরতা অভিযান, ওয়াইডব্লিউসিএ; এসপিএম-টিএইসপি, ঢাকা; নারী ঐক্য পরিষদ, আইন ও শালিস কেন্দ্র; আওয়াজ ফাউন্ডেশন প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সাংবাদিকসহ প্রায় শতাধিক জন উপস্থিত ছিলেন।

অনুষ্ঠান সঞ্চালনায় ছিলেন সংগঠনের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক অ্যাড. মাসুদা রেহানা বেগম।