পেন্টাগনের নথি ফাঁস : কিভাবে সম্ভব হলো?

আপডেট: এপ্রিল ১৪, ২০২৩
0

আমেরিকার প্রতিরক্ষা বিভাগের সদরদফতর পেন্টাগনের গোপন তথ্য ফাঁস করার অভিযোগে যুক্তরাষ্ট্রের এয়ার ন্যাশনাল গার্ডের একুশ বছর বয়সী এক সদস্যকে আটক করা হয়েছে। জ্যাক টেইক্সেইরার বিরুদ্ধে অভিযোগ হলো তিনি অনলাইন গেমের একটি চ্যাটরুমে গোপন ফাইলগুলো শেয়ার করেছিলেন।
টেইক্সেইরার ম্যাসাচুসেটসের বাসভবন ঘেরাও করে তাকে আটক করতে গেছে ভিডিও ফুটেজে। তিনি যেসব গোয়েন্দা প্রতিবেদন ফাঁস করেছেন, সেগুলো ইউক্রেন যুদ্ধ এবং মিত্রদের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নজরদারির বিষয়ে।

ওই যুবককে আটকের ভিডিওতে দেখা গেছে, বোস্টন থেকে প্রায় এক ঘণ্টার দূরত্বে একটি শহরে বাড়ির পেছনে তিনি হাঁটছিলেন। এফবিআই কর্মকর্তাদের দেখে দু’হাত তোলেন তিনি। পরে কর্মকর্তারা হ্যান্ডকাফ পরিয়ে তাকে নিয়ে যান।
এ সময় ওই এলাকার রাস্তাঘাট বন্ধ করে দিয়েছিল পুলিশ কর্মকর্তারা। স্থানীয় বাসিন্দাদের একজন ডিক ট্রেসি বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে বলেছেন, ছয় থেকে সাতজন সেনা সদস্যকে সশস্ত্র অবস্থায় হাঁটতে দেখেছেন তিনি।

তিনি বলেন, ‘এটা খুব শান্ত একটি এলাকা।’ ধারণা করা হচ্ছে, শুক্রবারই মিস্টার টেইক্সেইরাকে আদালতে দেখা যাবে। তিনি ম্যাসাচুসেটস এয়ার ন্যাশনাল গার্ডের গোয়েন্দা ইউনিটের একজন সদস্য।

সিবিএস নিউজের তথ্য অনুযায়ী তিনি ২০১৯ সালে চাকরিতে যোগ দেন। তার অফিশিয়াল পদবি হলো, সাইবার ট্রান্সপোর্ট সিস্টেম জার্নিম্যান এবং তিনি জুনিয়র পর্যায়ের কর্মকর্তা।

বৃহস্পতিবার তাকে আটকের পর যুক্তরাষ্ট্রের অ্যাটর্নি জেনারেল মেরিক গারল্যান্ড বলেছেন, ‘কোনো দুর্ঘটনা ছাড়াই সন্দেহভাজন ব্যক্তিকে নিরাপত্তা হেফাজতে নেয়া হয়েছে।’

তবে তিনি এ বিষয়ে বিস্তারিত আর কিছু বলেননি। আলাদা সংবাদ সম্মেলনে ডিফেন্স বিভাগের মুখপাত্র ব্রিগেডিয়ার জেনারেল প্যাট রাইডার বলেছেন, “এই পেন্টাগনের নথি ফাঁসের ঘটনা একটি ‘ইচ্ছাকৃত অপরাধমূলক কাজ।'”

কিন্তু একজন তরুণ এয়ারম্যান কিভাবে এ ধরনের গোয়েন্দা প্রতিবেদনে প্রবেশাধিকার পেল এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনীতে এর সদস্যরা অল্প বয়স থেকেই অনেক দায়িত্বের জন্য বিশ্বস্ত হয়ে থাকেন।

তিনি বলেন, ‘একজন প্লাটুন সার্জেন্ট এর কথাই ধরুন। যুদ্ধের সময় একটি দলকে সামনে এগিয়ে যাওয়ার কাজ এসব ব্যক্তির ওপর দেয়া হয় দায়িত্বশীলতা ও বিশ্বাস থেকে।’

টেইেক্সইরার সাথে স্কুলে গিয়েছেন ২২ বছর বয়সী এডি সৌজা। রয়টার্সকে তিনি বলেছেন. তার সাবেক সহপাঠীর খবর শুনে তিনি অবাক হয়েছেন।
তিনি বলেন, ‘সে অত্যন্ত ভালো ছেলে। কোনো সমস্যা করত না। একেবারেই শান্ত একজন মানুষ। মনে হচ্ছে এটি একটি স্টুপিড বাচ্চার ভুল কাজ।’

নথি ফাঁস যেভাবে হয়েছিল
কয়েক মাস আগেই কমপক্ষে ৫০ থেকে শুরু করে এক শ’র বেশি গোপনীয় প্রতিবেদন ডিসকর্ড নামক সামাজিক মাধ্যমে দেয়া হয়। এটি গেমারদের কাছে খুবই জনপ্রিয় মাধ্যম।

বিবিসি কিছু ডকুমেন্ট পরীক্ষা করেছে। সেখানে ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে গোয়েন্দা প্রতিবেদন ছাড়াও অন্য কিছু দেশ সম্পর্কে স্পর্শকাতর তথ্য ছিল।

যুক্তরাষ্ট্র কংগ্রেসের হাউজ ইন্টেলিজেন্স কমিটির চেয়ারম্যান রিপাবলিকান কংগ্রেসম্যান মাইক টার্নার বলেছেন, তার কমিটি এটি খতিয়ে দেখবে যে কেন এটি ঘটল এবং কেন কয়েক সপ্তাহ এটি কারো নজরে এলো না। একই সাথে এ ধরণের ঘটনার পুনরাবৃত্তি কিভাবে রোধ করা যায় সেটিও তারা দেখবেন।

নথিগুলো যে চ্যাটরুমে ফাঁস হয়েছে তার একজন সদস্যের সাক্ষাৎকার বুধবার ওয়াশিংটন পোস্ট প্রকাশ করে।

তিনি ফাঁসকারীকে একজন তরুণ এবং ক্যারিশম্যাটিক ও বন্দুক নিয়ে উচ্ছ্বসিত বলে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, বিশ বছর বয়সী ব্যক্তি সামরিক ঘাঁটিতে কাজ করেন।

ওই পোস্টে বলা হয়, ওই ব্যক্তি ডিসকর্ড চ্যাটরুমের দলনেতা। দু’ডজন সদস্যের দলটি মেমে, অফেন্সিভ জোকস ও চ্যাট ছাড়াও দলবদ্ধ ভাবে প্রার্থনা করে ও সিনেমা দেখে।

এ দলটিতে রাশিয়া, ইউক্রেন ছাড়াও ইউরোপ, এশিয়া ও দক্ষিণ আমেরিকার লোকজন আছে।

শুরুতে ফাঁস হওয়া নথিগুলো একটি ছোটো চ্যাটরুমে দেয়া হয়। তবে মার্চের শুরুতে এগুলো ডিসকর্ড সার্ভারগুলোতে চলে আসে । যার মধ্যে একটি গেমের জন্য আরেকটি একজন ফিলিপিনো ইউটিউবার এর।

সেখান থেকেই এগুলো চলে যায় টেলিগ্রাম চ্যাটরুমসহ নানা জায়গায়, যার মধ্যে কিছু রাশিয়াপন্থী চ্যানেলও ছিল। কিছু ক্ষেত্রে তাদের ইউক্রেনে হতাহতের সংখ্যা বৃদ্ধি সম্পর্কে সতর্ক করা হয়েছিল।

দি এয়ার ন্যাশনাল গার্ড হলো যুক্তরাষ্ট্র বিমান বাহিনীর সংরক্ষিত ফোর্স। আয়ারল্যান্ড সফরে থাকা মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে সেখানেই বিষয়টি জানানো হয়।

ফাঁস নথিতে কী ছিল
নথিতে দেখা যায়, যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বাস করে যে জাতিসঙ্ঘ মহাসচিব ইউক্রেন যুদ্ধের জন্য রাশিয়াকে জবাবদিহির বিষয়টিতে ততটা গুরুত্ব দেননি।

এসব ডকুমেন্টের কয়েকটির ওপর ‘টপ সিক্রেট’ লেখা ছিল। যার কিছুতে ইউক্রেন যুদ্ধের বিস্তারিত চিত্র এবং কিছু চীন ও তার মিত্রদের বিষয়ে তথ্য ছিল।

নথি অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্র মনে করে, জাতিসঙ্ঘ মহাসচিব রাশিয়ার স্বার্থও কিছুটা দেখার চেষ্টা করেছেন। কিছু ডকুমেন্টে মহাসচিব ও তার ডেপুটির মধ্যকার যোগাযোগের বর্ণনা আছে।

কৃষ্ণসাগর দিয়ে শস্য রপ্তানি বিষয়ে জাতিসঙ্ঘের মধ্যস্থতায় যে চুক্তি হয়েছে তা নিয়ে নথি আছে ফাঁস হওয়া নথির মধ্যে।

যেখানে বলা হয়, জাতিসঙ্ঘ মহাসচিব চুক্তি সংরক্ষণে খুব আগ্রহী এবং তিনি রাশিয়ার দাবির প্রতি নমনীয়, যা রাশিয়াকে জবাবদিহির আওতায় আনার বৃহত্তর স্বার্থের পরিপন্থী।

ফাঁস হওয়া নথিতে দেখা যায়, ইউক্রেনে নিজেদের কত লোক মারা গেছে তা নিয়ে নিজেদের মধ্যে বিবাদে জড়িয়েছেন রাশিয়ানরা। তাদের প্রধান গোয়েন্দা সংস্থা এফএসবি দেশের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়কে দায়ী করেছিলো ক্ষতি কম করে দেখানোর জন্য।

২৩ মার্চের একটি নথিতে দেখা যায়, পশ্চিমা স্পেশাল ফোর্স ইউক্রেনের ভেতরে থেকে কাজ করছে। এর মধ্যে যুক্তরাজ্যেরই বড় কন্টিনজেন্ট আছে যার সদস্য প্রায় ৫০ জন।

সেখানে লাটভিয়ার ১৭, ফ্রান্সের ১৫, যুক্তরাষ্ট্রের ১৪ ও নেদারল্যান্ডের একজন আছে।

এছারা মিসর গোপনে রাশিয়াকে রকেট সরবরাহ করতে চেয়েছে- এমন তথ্যও ফাঁস হওয়া নথিতে আছে বলে জানিয়েছে ওয়াশিংটন পোস্ট।
সূত্র : বিবিসি