প্রযুক্তি সুফল রোধ করছে সাইবার স্ল্যাকিং : ড. মো. নাছিম আখতার

আপডেট: অক্টোবর ১৩, ২০২১
0

করোনাকালীন বাংলাদেশ ক্রান্তিকাল অতিবাহিত করছে। নাগরিক সমাজের সব কাজকর্ম এখন প্রযুক্তির সহায়তায় অনলাইনে চলমান। বর্তমান সময়ে ওয়েবিনার, অনলাইন মিটিং বা অনলাইন ক্লাসে একটু লক্ষ করলেই বোঝা যায়, মাইক্রোফোন ও ক্যামেরা বন্ধ করে অনেক অংশগ্রহণকারী যুক্ত থেকে অন্য কাজে ব্যস্ত থাকে। বাস্তবে যখন অনলাইন ক্লাস নিয়েছি, তখনকার একটি ঘটনার কথা বলছি—ক্লাস চলাকালীন ছাত্রদের কোনো একটি সংযোগ থেকে নাকডাকার শব্দ আসছে। শব্দ শুনে বুঝলাম অন্য প্রান্তের ছাত্র মাইক্রোফোন অন করেই ঘুমিয়ে পড়েছে। উপায়ান্তর না দেখে অন্য ছাত্রকে বললাম ঘুমন্ত ছাত্রকে ফোন করে জাগাও। অনলাইন ক্লাসগুলোতে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা ক্লাসে যুক্ত হয় ঠিকই, কিন্তু মাইক্রোফোন ও ক্যামেরা অফ করে শিক্ষকের কথা না শুনে বিভিন্ন গ্রুপে চ্যাট করে। ফলে শিক্ষাঘণ্টা ব্যয় হলেও এর কার্যকরী সুফল পাওয়া খুবই দুরূহ। আমার পর্যবেক্ষণে কোমলমতি শিক্ষার্থীরা না বুঝেই এমন আত্মঘাতীমূলক কর্মকাণ্ড করে, যার কারণে একটি নির্দিষ্ট সময় পরে তারা হতাশ হয়ে পড়ে। সম্প্রতি একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের অনলাইন ওয়েবিনারে যুক্ত ছিলাম। নির্দিষ্ট একজন ব্যক্তিকে নাম উল্লেখ করে কিছু বলার জন্য আমন্ত্রণ করা হলে অন্যদিক থেকে কোনো সাড়া পাওয়া যাচ্ছিল না; কিন্তু দেখা যাচ্ছে তিনি অনলাইনে যুক্ত আছেন। এ ধরনের পরিস্থিতি ওয়েবিনার বা ভার্চুয়াল মিটিংয়ের ছন্দঃপতন ঘটায়। এ ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত বিষয়গুলোতে সচেতনতা জরুরি। করোনাকালে সশরীরে উপস্থিত থেকে মিটিং করা যাচ্ছে না বলেই ভার্চুয়াল মিটিংয়ের আয়োজন।এই আয়োজনে যদি সবার আন্তরিকতা ও মনোযোগ না থাকে, তাহলে ভার্চুয়াল মিটিংয়ের মূল উদ্দেশ্য ব্যাহত হয়। আবার তথ্য-প্রযুক্তির সহজলভ্যতায় ইলেকট্রনিকস ডিভাইসের মাধ্যমে ইন্টারনেটের সঙ্গে সংযুক্ত থেকে অফিস সময়ে নিজের দাপ্তরিক কাজ বাদ দিয়ে ব্যক্তিগত কোনো কাজেও আমরা ব্যস্ত থাকি। ইন্টারনেটের গতি ও সুবিধা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে স্মার্টফোন হাতের নাগালে থাকায় এ ধরনের কার্যক্রম নিজের অজান্তেই বেড়ে চলেছে। ফলে অফিসে কর্মরত জনগোষ্ঠীর প্রকৃত কর্মঘণ্টা উল্লেখযোগ্য হারে হ্রাস পাচ্ছে। ব্যক্তিগত কাজের মধ্যে রয়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্রাউজিং, নিষিদ্ধ ওয়েবসাইট ব্রাউজিং, অনলাইন শপিং, অনলাইন গেম ইত্যাদি। এ বিষয়গুলো নিয়ে জনগণের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করা এখন সময়ের দাবি।

ওপরে আলোচিত বিষয়গুলো অফিস সময়ের মধ্যে যদি ব্যক্তিগত প্রয়োজনে ঘটে তাহলে এ ধরনের কাজকে বলা হয় সাইবার স্ল্যাকিং (Cyber Slacking)। সাইবার অর্থ ইন্টারনেট ও কম্পিউটার সম্পর্কিত। আর স্ল্যাক অর্থ ধীর। দাপ্তরিক বা নির্দিষ্ট উদ্দেশ্যে কোনো কাজের সময়ে ইন্টারনেট ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহারের কারণে আমাদের দাপ্তরিক বা নির্দিষ্ট কাজের গতি সার্বিকভাবে মন্থর হয়ে পড়ে। একে সাইবার স্ল্যাকিং বলে। আমরা কেউই উপলব্ধি করতে পারি না, এর কারণে কী পরিমাণ কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে।

কয়েক বছর আগের একটি গবেষণায় প্রতীয়মান যুক্তরাজ্যের চার্টার্ড ইনস্টিটিউট অব পারসোনাল ডেভেলপমেন্ট নামের প্রতিষ্ঠানটি প্রতিবছর ২.৫ মিলিয়ন পাউন্ড ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে সেখানে কর্মরত জনবলের ব্যক্তিগত ব্রাউজিংয়ের কারণে। তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, অফিসের কর্মচারীরা ইনস্ট্যান্ট মেসেজ, অনলাইন শপিং, ব্লগিং ইত্যাদির মাধ্যমে সময় নষ্ট করেছেন। একটি প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানের ব্যক্তিগত গবেষণায় প্রতীয়মান, প্রতিষ্ঠানটিতে চাকরিরত ব্যক্তিরা ১.৪৪ ঘণ্টা তাঁদের ব্যক্তিগত প্রয়োজনে ইন্টারনেট ব্রাউজ করছেন। যার নেতিবাচক প্রভাব তাঁদের কর্মজীবনে পরিলক্ষিত হচ্ছে। একটি জরিপের ফল বলছে, কোনো প্রতিষ্ঠানের জনবল সাইবার স্ল্যাকিংয়ে নষ্ট করে কর্মক্ষেত্রের ২০-২৪ শতাংশ সময়। ভারতে পরিচালিত একটি জরিপে দেখা যায়, প্রতি কর্মদিবসে প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ব্যক্তিরা ১.৫৫ ঘণ্টা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে, ১.৪৪ ঘণ্টা বিনোদন মাধ্যমে, ১.৪৬ ঘণ্টা জ্ঞান আদান-প্রদানে, এক ঘণ্টা বিল প্রদানে ব্যয় করছেন। পাশাপাশি আমেরিকার একটি গবেষণাপ্রতিষ্ঠানের গবেষণায় আরো একটি বিষয় উঠে এসেছে, তা হলো এক হাজার জনবলের একটি কম্পানি বছরে ৩৫ মিলিয়ন ডলার ক্ষতির সম্মুখীন হবে, যদি ওই কম্পানির জনবল প্রতিদিন অফিস সময়ের এক ঘণ্টা সাইবার স্ল্যাকিংয়ে ব্যয় করে।

পশ্চিমা বিশ্বের দেশগুলো আমাদের অনেক আগেই ডিজিটাল সিস্টেমের আওতায় এসেছে। তাই সাইবার স্ল্যাকিং রোধে তাদের অনুসৃত পদক্ষেপগুলো অনুসরণ করা বাঞ্ছনীয়। সাইবার স্ল্যাকিং নামক অর্থনীতির গুপ্তঘাতক জাতীয় অগ্রগতির জন্য বড় বাধা। আমাদের দেশের কর্মক্ষেত্রগুলোয় ইন্টারনেটের ব্যবহারে সাইবার স্ল্যাকিং পর্যবেক্ষণের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত। এ ক্ষেত্রে কোনো প্রতিষ্ঠানের ইন্টারনেট সার্ভার রেকর্ড পর্যবেক্ষণ করার ব্যবস্থা থাকতে হবে। কার্যকর মনিটরিং সেল স্থাপিত হলে প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ব্যক্তিরা তাঁদের কর্মঘণ্টার সঠিক ব্যবহার সম্পর্কে সচেতন থাকবেন। দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গড়তে ডিজিটাল ব্যবস্থাপনা যেমন জরুরি, তেমনি সম্পদের সুষম বণ্টন, উৎপাদকের ন্যায্য মূল্যপ্রাপ্তি, সরকারি কাজের জটিলতা নিরসন, আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টিতে ডিজিটাল বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। এর সঠিক সুফল পেতে আমাদের ডিজিটাল সিস্টেমের নেতিবাচক প্রভাবগুলো বিশ্লেষণ করতে হবে। এর জন্য চাই বিষয়গুলো নিয়ে মানসম্মত গবেষণা। গবেষণালব্ধ জ্ঞানের ওপর ভিত্তি করে সমস্যাগুলো সমাধান করতে হবে।

যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে প্রযুক্তির সুফল পেতে হলে জাতিকে অবশ্যই সাইবার স্ল্যাকিংয়ের কুফল সম্পর্কে সচেতন হতে হবে।

লেখক : উপাচার্য, চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়