ফারাক্কার পানি নিয়ে আমাদের ফাঁকি দেয়া হচ্ছে , কোন নদ-নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা পাইনি—মীর্জা ফখরুল

আপডেট: মে ৬, ২০২৩
0

ডেস্ক রিপোর্ট :
বৈশ্বির্ক জলবায়ু পরিবর্তনে বিরুপ প্রভাব থেকে বাংলাদেশের পরিবেশ রক্ষায় সরকারের কোনো পরিকল্পনা নেই বলে অভিযোগ করেছেন মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
বিএনপির শাসনমালে পথিলিত ব্যাগ নিষিদ্ধ, খাল খনন কর্মসূচি চালু, ত্রি-স্টোক বেবী ট্যাক্সি চলাচল নিষিদ্ধসহ পরিবেশ রক্ষায় বিভিন্ন পদক্ষেপ তুলে ধরে শুক্রবার জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক এক সেমিনারে বিএনপি মহাসচিব এই অভিযোগ করেন।

তিনি বলেন, ‘‘ এখন এগু্লোর(পরিবেশ দুষণ রোধ) ওপরে কোনো গুরুত্ব না দেয়ার ফলে ঢাকা দেশের অন্যতম না বোধহয় সবচেয়ে ‍দুষিত নগরীতের পরিণত হয়েছে। এছাড়া সরকারের কোনো লক্ষ্য নেই। এই বিষয়গুলোকে এডড্রেস করার জন্য, জনগনকে ভবিষ্যতের সুন্দর করার জন্য, জনগনের অন্তত বেঁচে থাকার জীবন-জীবিকার পথগুলোকে সুগম করার জন্য সেখানে তাদের খুব বেশি একটা তাদের আগ্রহ নেই।”
‘‘ কারণ তাদেরকে তো জনগনের কাছে কোনো জবাবদিহিতা করতে হয় না, তারা নির্বাচিত নয়, জোর করে ক্ষমতা দখল করে বসে আছে। লক্ষ্য একটাই যে, আমাকে যে করেই হোক ক্ষমতায় টিকে থাকতে হবে। এই কারণে পরিবেশ রক্ষায় তাদের কোনো পরিকল্পনা নেই।”
বাংলাদেশের নদনদীগুলোর বর্তমান অবস্থা তুলে ধরেন বিএনপি মহাসচিব।

তিনি বলেন, ‘‘ এখন যখন আমি বাংলাদেশের যেসব জায়গায় যাই নদী আর বেশি দেখতে পাই না। দূরে যাওয়ার দরকার নেই… ঢাকার পাশেই বুড়িগঙ্গা… আগে কেমন ছিলো, আর আজকে সেই বুড়িগঙ্গায় কি দেখছি, শীতালক্ষায় কি দেখছি। আজকে আমাদের মানুষের অবহেলায়, সরকারের অব্যবস্থাপনায়, তাদের পরিকল্পনার অভাবে সেগুলোকে নিয়ে আমরা বেঁচে আছি, আমাদের জীবন-জীবিকার সঙ্গে তাদের সম্পর্ক অবিবেচ্ছদ সেগু্লোকে আমরা নিজেরাই হত্যা করছি, ধবংস করে নিচ্ছি।”
‘‘ সরকার উন্নয়নে ঢাক-ঢোল বাজায় সর্বক্ষন। কিন্তু নদীকে রক্ষায় নদীকে সঠিকভাবে পরিশুদ্ধ রাখার তাদের(সরকার) কোনো পরিকল্পনা এখনো পর্যন্ত চোখে পড়ে না। বুড়িগঙ্গা নদীর পাশ দিয়ে যান দেখবেন এতো দুর্গন্ধ।”
বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘‘ সাভার-ধামরাইতে ছোট ছোট যে নদীগুলো ছিলো সেগু্লো প্রায় মরে গেছে। আপনারা দেখেছেন যে, তুরাগ নদীর পাশে সরকারের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সযোগিতায় ও তাদের সমর্থনের ফলোশ্রুতিতে বিভিন্ন ক্লাব গড়ে উঠেছে। সেই ক্লাবগুলো একেবারেই নদীর ওপরে নদী ভরাট করে গড়ে উঠে্ছে।”
‘‘ পানি কমে যাচ্ছে, নদী দখল করা হচ্ছে-এটার বিষয়ে যা কিছু খবর নেবেন-এই সরকারের সঙ্গে যারা জড়িত তারাই এই কাজগুলো করছে। অথচ তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থাই নেয়া হচ্ছে না।”
‘পরিবেশ রক্ষায় দরকার জনমুখী সরকার’
মির্জা ফখরুল বলেন, ‘‘ জলবায় পরিবর্তন এখন একটা বৈর্শ্বিক চ্যালেঞ্জ, এই প্যানেট বড়রকমেরে হুমকির মুখে পড়েছে। আমরা তো আদার ব্যাপারী জাহাজের খবর দরকার নাই। আমরা বাংলাদেশের মানুষ আমরা বেঁচে থাকবো কি থাকব না, সুস্থ-সুন্দরভাবে আমরা এখানে বাঁচতে পারব কিনা সেটা আমাদের কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আজকে বাংলাদেশের মানুষকে যদি টিকে থাকতে হয়, ভবিষ্যতকে যদি সুন্দর করতে হয়, ভবিষ্যতকে যদি সত্যিকার অর্থেই জনগনমুখী করতে হয় তাহলে গণতন্ত্রের কোনো বিকল্প নেই। আজকে গণতন্ত্র নেই বলেই কোনো জবাবদিহিতা নেই।”
‘‘ মেজর হাফিজ সাহেব(সাবেক পানি সম্পদ মন্ত্রী হাফিজ উদ্দিন আহমেদ) যেটা বলেছেন যে, তিনি দিল্লীতে গিয়ে যখন উনি সেই নদী কমিশনে নেগোসিয়েশন করছিলেন-এই শক্তি তার ছিলো। হি প্রেজেন্টেড এ ইলেক্টেড গভমেন্ট… একটা নির্বাচিত সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে তিনি বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন এবং বাংলাদেশকে ভালোবাসতেন বলে, জাতীয়তাবাদ বিশ্বাস করেন বলেই বাংলাদেশ একটা স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র…. ওই সাহস নিয়ে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। আমাদের ফারাক্কা বাঁধে কত বড় ক্ষতি হয়েছে সেটা আমরা জানি, তিস্তার পানি দিচ্ছে যার ফলে ওই অঞ্চল(উত্তরাঞ্চল) পুরোপুরি মরুভূমিতে পরিণত হয়ে যাচ্ছে। অথচ এখনই এই সরকার সেইভা্বে কথা বলে নাই, সেভাবে কথা বলেই না।”
টিপাইমুখে বাঁধ নির্মাণের বিরুদ্ধে বিএনপির ভুমিকা তুলে করে তিনি বলেন, ‘‘ টিপাইমুখ বাঁধ নিয়ে যখন নির্মাণ করতে যায় তখনই আপত্তি করেছিলেন বিএনপি সরকার, একই সঙ্গে বিএনপি আপত্তি করেছে, বিএনপি আন্দোলন গড়ে তু্লেছিলো।যার জন্যে আমাদের ইলিয়াস আলীকে সম্ভবত অনেক মনে করেন সেই কারণে তাকে গুম হতে হয়েছে।”

‘‘ এটা বড় লড়াই, বড় সংগ্রাম। এই সংগ্রামে আমাদেরকে জিততে হবে আমাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য, আমাদের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বকে টিকিয়ে রাখার জন্য, আমাদের গণতন্ত্রকে টিকিয়ে রাখার জন্য আমাদেরকে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ফিরে আসতেই হবে। সেই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ফিরে আসতে পারলেই আমরা প্রকৃতিকে রক্ষা করার চেষ্টা করতে পারব, উদ্যোগ নিতে পারব। আমরা আমাদের যে সমস্যাগুলো আছে সেই চ্যালেঞ্জগুলোকে বুক ফুলিয়ে মোকাবিলা করতে সক্ষম হবো। জাতিসংঘে তুলে ধরতে পারব, বিশ্ব পরিমন্ডলে এটার একটা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার সুযোগ সৃষ্টি হবে।”
ঢাকার রমনায় ইঞ্জিনিয়ার্স ইন্সটিটিউশনের সেমিনার কক্ষে বিএনপির উদ্যোগে ‘জলবায়ু পরিবর্তন ঃ বাংলাদেশ ও নদী’ শীর্ষক এই সেমিনার হয়। এতে মূল প্রবন্ধ পাঠ করেন হাসনা জসীমমউদ্দিন মওদুদ। চার পৃষ্ঠার প্রবন্ধে তিনি বাংলাদেশের নদ-নদীর পানি প্রবাহ, ভারতের উজানে বাঁধ নির্মাণে এর ক্ষতিকারক দিক, প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে তার তুলে ধরেন।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ব বিভাগের সাবেক অধ্যাপক খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘‘ আপনারা দেখেছেন যে, মানুষের হস্তক্ষেপের কারণে আমাদের বাংলাদেশের নদীগুলো কি পরিমান গতি হারিয়েছে এব্ং কি পরিমান চরিত্রগতভাবে পরিবর্তন হয়েছে। একটা উদাহরণ প্রবন্ধে উল্লেখ করা হয়েছে সেটা ফারাক্কা চুক্তি। আওয়ামী লীগ সরকার যখন দ্বিতীয় যে চুক্তি করেছিলো সেটাতে গ্যারান্টি ক্লজ নাই। ফারাক্কা পয়েন্টে একটা গ্যারেন্টি ক্লজ থাকতে হবে। রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান সাহেব যখন চুক্তি করেছিলেন সেখানে ফারাক্কার পয়েন্টে গ্যারেন্টি ক্লজ ছিলো।”

‘‘ আওয়ামী লীগ আমলের চুক্তিতে আমাদেরকে ফাঁকি দিয়ে ফারাক্কা পয়েন্টে গ্যারেন্টি ক্লজ রাখেনি।এখানে যা পানি ভাগাভাগি হবে সেটার একটা সমঝোতা এবং সেখানে আমাদেরকে ফাঁকি দেয়া হলো… বলা হলো যে, ৩৩ হাজার কিউসেক পানি থাকবে। এখন কিন্তু অনেক সময়ে সেখানে ১২ হাজার কিউসেক পানিও থাকে না। কেননা ফারাক্বা পয়েন্টে গ্যারেন্টি নাই। তারা(ভারত) উপরি অঞ্চলে বেশির ভাগ পানি ব্যবহার করে ফেলছে ফারাক্কার সেই পয়েন্টে পানি আর আসছে না। অতএব বাংলাদেশ পানির ন্যায্য ভাগ পাচ্ছে না। তার প্রতিক্রিয়া কি আপনারা বাংলাদেশের পরিবেশ-জলবায়ু পরিবর্তনে তা দেখছেন।”
তিনি বলেন, ‘‘ তিস্তাসহ ৫৪ নদীর উপরিভাবে পানি প্রত্যাহার করে নিয়ে যাচ্ছে তারা। ফলে আমাদের নদীতে পানি কম আসছে, আমাদের নদীগুলো শুকিয়ে যাচ্ছে। নদীর পানির মাধ্যমে যে পলি আমাদের দে্শে আসতো সেই পলি কমে যাওয়ায় পর্যায়ক্রমে কৃষি ও কৃষকের ক্ষতি হচ্ছে।”

‘‘ বাংলাদেশ নদী মাতৃক দেশ, কৃষি নির্ভর দেশ। এ্খানে আমরা অপরিকল্পিতভাবে বিভিন্ন শিল্প কলকারখান, আমাদের পরিবহন, ব্রিজ ইত্যাদি নির্মাণ করছি শুধু লোক দেখানোর জন্য অথবা কোনো দেশের ইঙ্গিতে ভয়ে তাদেরকে খুশি করার জন্য করছি। এতে আমরা বিশাল ক্ষতির সম্মুখিন হচ্ছে এটা কিন্তু আমাদের সকলকে আরো বেশি গভীর অনুভবন করতে হবে। আমরা যদি জাতীয়তাবাদী চেতনার স্বার্থে কথা্ বলি তাহলে আমরা যে পার্শ্ববর্তী দেশ দ্বারা ডিপরাইভ হচ্ছি এটা জনগনকে অনুধাবন করতে হবে।
নদী দখল রোধ করতে দীর্ঘ-মধ্যম এবং বর্তমান অবস্থায় করনীয় পরিকল্পনা নিয়ে এগুতে হবে বলে মন্তব্য করেন খন্দকার মোশাররফ।
সাবেক পানি সম্পদ মন্ত্রী হাফিজ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘‘ আমাদের নদ-নদীর পানির ন্যায্য হিতসা থেকে বঞ্চিত হচ্ছি। এই থেকে উত্তরণে বাংলাদেশের জনগনকে সোচ্চার হতে হবে। সরকারকে মেরুদন্ড সোজা করে দাঁড়াতে হবে, সরকারের মেরুদন্ড সোজা থাকতে হবে।বলতে হবে আমার দেশের নদ-নদীর পানির ন্যায্য হিতসা আমরা চাই।”

‘‘ যৌথ নদী কমিশনের মিটিং বছরে চার বার হতে হবে, সেখানে আমাদের ন্যায্য হিতসার গ্যারেন্টি করে দিতে হবে… প্রত্যেকটা চুক্তির গ্যারেন্টি ক্লজ থাকতে হবে, আরবিটেশন ক্লজ থাকতে হবে। ইউএন কনভেনশন অব ১৯৯৭ ক্লজ আমাদেরকে রেটিফাইড করতে হবে। ভারত এটার চরম বিরোধী। আমরা এই পথ অবলম্বন করে আমাদেরকে নদীর পানির ন্যায্য হিতসা নিশ্চিত করার সুযোগ আমাদেরকে নিতে হবে।”
নদ-নদীর পানি ন্যায্য বন্টনে ভারত সরকারের একতরফা ভুমিকার কঠোর সমালোচনা করেন সাবেক পানি মন্ত্রী।
চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভ ইন্টারন্যাশনাল ফাইনেন্সের নির্বাহী প্রধান জলবায়ু বিশেষজ্ঞ এম জাকির হোসেন খান বলেন, ‘‘ বিএনপি একটি বড় রাজনৈতিক দল হিসেবে নদীর বিষয়ে শক্তিশালী অবস্থান নেয়া উচিত… সে যত বড় শক্তিশালী হোক, যত ক্ষমতাশালী হোক আপনারা নদী দখলের ব্যাপারে নদী দুষণের ব্যাপারে আপনাদের অবস্থান পরিস্কার করা উচিত।”
‘‘কারণ নদী দখলকারী, নদী দুষণকারী মানবতার শত্রু, প্রকৃতির শত্রু্। আজকে বাংলাদেশ বাঁচবে যদি নদী বাঁচে। যারা নদীকে মেরে ফেলছে তারা বাংলাদেশের মানুষকে মেরে ফেলার অবদান রাখছে।”
বিএনপির মহাসচিবের সভাপতিত্বে ও দলের বন ও পরিবেশ বিষয়ক সহ বিষয়ক সম্পাদক মোস্তাফিজুর রহমান বাবুল ও কাজী রওনাকুল ইসলাম টিপুর যৌথ সঞ্চালনায় সেমিনারে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব খায়রুল কবির খোকন, মিডিয়া সেলের আহ্বায়ক জহির উদ্দিন স্বপন এবং সেভ দ্য সুন্দর ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান শেখ ফরিদুল ইসলাম বক্তব্য রাখেন।