ফ্যাসিবাদী সরকারের পদত্যাগ, কেয়ারটেকার সরকারসহ ৭ দফা দাবিতে ছাত্রশিবিরের সংবাদ সম্মেলন

আপডেট: অক্টোবর ৮, ২০২৩
0

ফ্যাসিবাদী আওয়ামী সরকারের পদত্যাগ, কেয়ারটেকার সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন এবং নিরাপদ ক্যাম্পাস নিশ্চিতকরণসহ ৭ দফা দাবিতে রাজধানীতে সংবাদ সম্মেলন করেছে বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির।

আজ রোববার (৮ অক্টোবর) রাজধানীর এক মিলনায়তনে এ সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। এতে লিখিত বক্তব্যের মাধ্যমে দাবিসমূহ তুলে ধরেন ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় সভাপতি রাজিবুর রহমান। এ সময় সেক্রেটারি জেনারেল মঞ্জুরুল ইসলামসহ কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।

কেন্দ্রীয় সভাপতি বলেন, “সাম্প্রতিক সময়ে দেশ ও জাতি একটি চরম সংকটময় পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। জীবন, সম্পদ ও মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা নেই। সাধারণ মানুষের ভোটাধিকার হরণ করে রাজনৈতিক অধিকার সংকুচিত করা হয়েছে। মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে খর্ব করে দেশে ফ্যাসিবাদ কায়েম করেছে। সেইসাথে ভোটারবিহীন সরকারের আশীর্বাদপুষ্ট সুবিধাভোগী, দুর্নীতিগ্রস্ত নিয়ন্ত্রণহীন সিন্ডিকেট কর্তৃক সৃষ্ট দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রাকে করে তুলেছে অত্যন্ত দুর্বিষহ।

এ পরিস্থিতিতে গণমানুষের অধিকার আদায়ে সচেষ্ট জনগোষ্ঠীর ওপর ক্ষমতাসীনরা একের পর এক জুলুম-নির্যাতনের খড়্গ চালিয়ে যাচ্ছে। মিডিয়ার ওপর একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে উন্নয়নের ফাঁপা বুলি প্রচার করছে। যারাই অধিকার আদায়ের পক্ষে কথা বলছে, সরকারের অনিয়ম, দুর্নীতি, লুটপাটের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলছে, তাদেরকে হামলা-মামলা দিয়ে কারাগারে অন্তরিন করেছে। এর মাধ্যমে ক্ষমতাসীন দল চিরদিনের জন্য নিজেদের ক্ষমতাকে স্থায়ী ও পাকাপোক্ত করার ছক কষছে।”

তিনি বলেন, “২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর আওয়ামী লীগ কেয়ারটেকার সরকার পদ্ধতি বাতিল ও নির্বাচন কমিশনকে দলীয়করণের মাধ্যমে ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করার কূটকৌশল গ্রহণ করে। তারই ধারাবাহিকতায় ২০১৪ সালের ভোটারশূন্য নির্বাচন ও ২০১৮ সালের রাতের ভোটের নির্বাচনসহ সিটি কর্পোরেশন, উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ের পক্ষপাতদুষ্ট নির্বাচনের মাধ্যমে দেশের অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনী ব্যবস্থাকে ভেঙে ফেলেছে।

দেশের শাসন ও বিচার বিভাগকে চরম দলীয়করণ করে নিজেদের ক্ষমতাকে স্থায়ী করার মাধ্যমে গণতন্ত্রকে সমূলে ধ্বংস করেছে। জাতির বিবেক সাংবাদিক, মানবাধিকার কর্মী, আলেম-ওলামাদের সত্যের পক্ষে কথা বলার কারণে নির্যাতন ও নিষ্পেষণ করে ন্যূনতম সমালোচনার জায়গাটুকুও সংকীর্ণ করে ফেলেছে। মানুষের বাক্স্বাধীনতাসহ মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করে সংবিধানকে লঙ্ঘন করেছে বারংবার। ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে দেশের অর্থনীতিকে, ব্যাংকিং ব্যবস্থাকে করে ফেলা হয়েছে পঙ্গু। দুর্নীতি, অর্থপাচার, সিন্ডিকেটসহ নানা অনিয়মের জাঁতাকলে পিষ্ট করে রাখা হয়েছে দেশের সর্বস্তরের মানুষকে। নৈতিকতা ও আদর্শিক মূল্যবোধশূন্য শিক্ষানীতি প্রণয়নের মাধ্যমে জাতিকে ধ্বংস করার পাঁয়তারা চলছে।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে সত্য ও ন্যায়পন্থি ছাত্রসংগঠনগুলোর জন্য এক প্রকার অঘোষিত কারফিউ জারি করে রেখেছে ফ্যাসিবাদী সরকার। ছাত্রলীগ নামক পেটোয়া বাহিনীকে ব্যবহার করে বিরোধী ছাত্রসংগঠনের নেতা-কর্মী থেকে শুরু করে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর অমানবিক নির্যাতন করেছে। হুমকি-ধামকি ও ভয়ভীতি প্রদর্শন করে ছাত্রসমাজকে সুষ্ঠু রাজনৈতিক গতিধারা থেকে দূরে রাখার চেষ্টা করেছে।

যেখানে ২০০৯ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত ছাত্রলীগের নির্যাতনের শিকার হয়ে কয়েক হাজার শিক্ষার্থীর শিক্ষাজীবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ছাত্রলীগ নামক আওয়ামী পেটোয়া বাহিনী বিগত ১৫ বছরে দেশের গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে শতাধিক হত্যাকাণ্ড, ধর্ষণ, যৌননিপীড়ন, মাদক বাণিজ্য, টেন্ডারবাজি, ছিনতাই, সিট বাণিজ্য, শিক্ষক, কর্মকর্তা ও সাংবাদিক লাঞ্ছনার মতো সহস্রাধিক ঘটনা ঘটিয়েছে।

বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির দেশের অন্যতম বৃহৎ ছাত্রসংগঠন। আওয়ামী সরকারের অগণতান্ত্রিক কার্যক্রমের প্রতিবাদ করায় তাদের চক্ষুশূলে পরিণত হয়েছে ছাত্রশিবির। রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করে ক্ষমতাসীন দল চিরুনী অভিযানের নামে নেতাকর্মীদের গণগ্রেফতার, সীমাহীন অপপ্রচার, গোপন বৈঠক ও নাশকতার নামে মিথ্যা মামলা সাজিয়ে দেশ ও জাতির সামনে সংগঠনটিকে প্রশ্নবিদ্ধ করার অপচেষ্টা করেছে। নির্যাতনের স্টিমরোলার চালানো হয়েছে নেতাকর্মীদের ওপর। তারই ধারাবাহিকতায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সেক্রেটারি শহীদ শরীফুজ্জামান নোমানী থেকে শুরু করে বিগত ১৫ বছরে ছাত্রশিবিরের ১০৩ জন নেতাকর্মীকে শহীদ করা হয়েছে।

ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রনেতা ওয়ালীউল্লাহ, আল-মুকাদ্দাসসহ ৫ জনকে পরিকল্পিতভাবে গুম করা হয়েছে, সাবেক-বর্তমান শত শত নেতাকর্মীকে পঙ্গু করে দেওয়া হয়েছে। সেইসাথে বিগত ১৫ বছরে ১০,৩৫৮টি রাজনৈতিক মিথ্যা মামলায় লক্ষাধিক নেতাকর্মীকে আসামি করা হয়েছে। সেইসাথে ২৮,৭২৩ জনকে বিভিন্ন সময়ে কারাগারে অন্তরিন হতে হয়েছে।”

তিনি আরো বলেন, “শত বাধাবিপত্তি সত্ত্বেও বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির তাঁর নিজস্ব সাংগঠনিক কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে। তরুণ ছাত্রসমাজের মাঝে ইসলামী আদর্শ ও মূল্যবোধ ছড়িয়ে দিয়ে একদল সৎ, দক্ষ ও দেশপ্রেমিক নাগরিক তৈরির প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। তবে চলমান রাজনৈতিক বাস্তবতা ইসলামী ছাত্রশিবিরকে উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। ক্ষমতাসীন সরকারের দুঃশাসন বর্তমানে সকল সীমা অতিক্রম করেছে। আওয়ামী সরকার একদলীয় বাকশালী কায়দায় মানুষের কণ্ঠ রুদ্ধ করে দেশকে খাদের কিনারায় পৌঁছে দিয়েছে।

আওয়ামী লীগ সরকারের পতন বর্তমানে গণদাবিতে পরিণত হয়েছে। আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে ঐক্যবদ্ধভাবে উদ্যোগ গ্রহণ এখন অপরিহার্য। দেশের চলমান পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির ৭ দফা দাবি উপস্থাপন করছে।

আমাদের দাবিসমূহ :

১. ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগ সরকারের পদত্যাগ ও সাধারণ মানুষের ভোটাধিকার ফিরিয়ে দিতে নির্দলীয় নিরপেক্ষ কেয়ারটেকার সরকারের অধীনে আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজন করতে হবে।

২. আমীরে জামায়াত ডা. শফিকুর রহমান, বিএনপির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া, জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল মিঞা গোলাম পরোয়ার, ইসলামী ছাত্রশিবিরের সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি রফিকুল ইসলাম খান, সেলিম উদ্দীন, মানবাধিকার কর্মী আদিলুর রহমানসহ সকল আলেম-ওলামা, ছাত্রনেতা ও বিরোধী দলীয় নেতা-কর্মীকে নিঃশর্ত মুক্তি দিতে হবে। ছাত্রশিবিরের গুম হওয়া ৫ জন নেতাকর্মীসহ সারাদেশে গুম হওয়া সকলকে ফিরিয়ে দিতে হবে। এ ছাড়া বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে সকল রাজনৈতিক মামলা প্রত্যাহার করতে হবে।

৩. ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় কার্যালয় ও সারা দেশের অফিসসমূহ দ্রুত সময়ের মধ্যে খুলে দিতে হবে। সেইসাথে ছাত্রসংগঠন হিসেবে সকল রাজনৈতিক ও ছাত্রবান্ধব কর্মসূচি নির্বিঘ্নে পালনের সুযোগ দিতে হবে।

৪. দেশের ক্যাম্পাসগুলোতে সকল ছাত্রসংগঠনের সহ-অবস্থান নিশ্চিত করা ও ছাত্রসংসদ নির্বাচন আয়োজনের মাধ্যমে ছাত্ররাজনীতির সুস্থ ধারা চালু করতে হবে। একই সঙ্গে ক্যাম্পাসে অবস্থানরত সকল শিক্ষার্থীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করার মধ্য দিয়ে ক্যাম্পাসসমূহকে নিরাপদ করতে হবে।

৫. জাতীয় শিক্ষাক্রম রূপরেখা-২০২১ বাতিল করে নৈতিকতাসমৃদ্ধ, কারিগরি ও বাস্তবমুখী শিক্ষানীতি প্রণয়ন করতে হবে, যেখানে সকল পর্যায়ে ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক থাকবে। সেইসাথে মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থাকে সংস্কার ও উন্নত করে আরও যুগোপযোগী করতে হবে।

৬. শিক্ষার সকল পর্যায়ে অর্থাৎ প্রাথমিক থেকে স্নাতক পর্যন্ত অবৈতনিক শিক্ষাব্যবস্থা চালু করতে হবে। সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠী বিশেষ করে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী ও রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর শিশুদের অবৈতনিক শিক্ষাদান নিশ্চিত করতে হবে। সেইসাথে কাগজ-কলমসহ সকল প্রকার শিক্ষা উপকরণের মূল্য হ্রাস করতে হবে।

৭. দেশের মোট বাজেটের ২৫ ভাগ শিক্ষা খাতে বরাদ্দ দিতে হবে এবং শিক্ষা বাজেটের এক-চতুর্থাংশ গবেষণায় ব্যয় নিশ্চিত করতে হবে। সেইসাথে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে সরকারি ভ্যাট হ্রাস করতে হবে।

উপরোক্ত সাত দফা দাবি শুধু ছাত্রশিবিরের নয়, এ দাবি গোটা ছাত্রসমাজের। এই দাবি না মানলে বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির ছাত্রসমাজকে সাথে নিয়ে তীব্র গণআন্দোলনের মাধ্যমে দাবিসমূহ আদায়ে ভূমিকা পালন করবে, ইনশাআল্লাহ। ছাত্রসমাজ ঐক্যবদ্ধ হলে জালিমের পতন অনিবার্য। এ ফ্যাসিবাদ পতন আন্দোলনে সকল ছাত্রসংগঠনকে আমরা ঐক্যবদ্ধভাবে রাজপথে ভূমিকা পালনের জন্য আহ্বান জানাচ্ছি। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, সুশীল সমাজ, সাংবাদিকমহল, পেশাজীবী শ্রেণিসহ সকল শ্রেণির মানুষকে দাবি আদায়ে রাজপথে নামার আহ্বান জানাই।”

সংবাদ সম্মেলন শেষে উপস্থিত সাংবাদিকদের ধন্যবাদ জানান কেন্দ্রীয় সভাপতি।