বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর শামসুর রাহমান, রাহাত খান, নির্মলেন্দুগুণরাই শুধু লিখেছিলেন

আপডেট: আগস্ট ৩০, ২০২৩
0

সোহেল সানী:

১৯৭৭ সালের অমর ২১ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধুর স্মরণে “এ লাশ আমরা রাখবো কোথায়” শীর্ষক একটি সংকলন প্রকাশিত হয়। যা ছিলো, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর প্রথম সাংস্কৃতিক প্রতিবাদ। সামরিক সরকারের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে এ দুঃসাহসিক কর্মসম্পাদনের খেসারত কবি শামসুর রাহমান, কবি নির্মলেন্দুগুণ, সাংবাদিক ও কথা সাহিত্যিক রাহাত খানসহ সংকলন সংশ্লিষ্ট সকলকেই কোনো না কোনোভাবে দিতে হয়েছিলো। সংকলনটির মূল প্রবন্ধটি লিখেছিলেন, ‘স্বাধীনতা তুমি’ খ্যাত দেশবরেণ্য কবি শামসুর রাহমান। কবি প্রবন্ধের শিরোনাম করেছিলেন ‘এ লাশ রাখবো কোথায়’। আর সেই শিরোনামটাকেই বেছে নেয়া হয় সংকলনটির শিরোনাম হিসেবে।

সংকলনটিতে প্রথিতযশা সাংবাদিক ও কথা সাহিত্যিক রাহাত খান লিখেছিলেন, দুঃসাহসিক একটি প্রবন্ধ। দৈনিক ইত্তেফাকে ‘সুহৃদ’ ও ‘চতুরঙ্গ’ কলাম লিখে বিপুল জনপ্রিয় হয়ে ওঠা রাহাত খান প্রবন্ধটিতে লিখেন, “যীশু খৃস্টের আত্মাহুতি, মহাত্মা গান্ধীর আত্মদান এবং মার্টিন লুথার কিংয়ের আত্মাহুতির মতো বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ড বাঙালি জাতিকে নতুন সংকল্পে স্থির করেছে, নবতর শপথে অটল ও দৃঢ় করেছে। ইতিহাসে তার স্থান সেইসব বিরল সংখ্যক মহাপুরুষের পর্যায়ে, যারা জাতির জনকের অভিধায় ভূষিত। আমাদের অনেকের সৌভাগ্য, এইকালে জন্ম নিতে পেরেছিলাম।” মাত্র ৩৩ বছর বয়সে ১৯৭৩ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার অর্জনকারী রাহাত খান লিখেন, “বঙ্গবন্ধুর নৃশংস হত্যাকাণ্ডে বাংলাদেশের মানুষ স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলো। যেমন এজিদের হাতে ইমাম হোসেনের শাহাদাৎবরণ চোখের জলে নিরব বেদনায় মেনে নিয়েছিলো, সারা মুসলিম জাহান।

ষাটের দশকের রাহাত খান গদ্য রচনায় হয়ে ওঠেন পারদর্শী। অনবদ্য ও অনন্য সাধারণ তাঁর ভাষাশৈলী এবং গল্প বলার বৈশিষ্ট্য তাকে কথা সাহিত্যিকের মসনদে আসীন করে। উপন্যাসিকও তিনি। ১৯৬৯ সালে রাহাত খান অধ্যাপনা ছেড়ে দৈনিক ইত্তেফাকের সহকারী সম্পাদক হিসাবে সাংবাদিকতা শুরু করেন। ১৯৯৬ সালে ইত্তেফাকের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক এবং একসময় সম্পাদকও হোন। ১৯৯৬ সালে রাষ্ট্রীয় পুরস্কার একুশে পদকলাভকারী রাহাত খানের গল্পগ্রন্থগুলো হলো, অনিশ্চিত লোকালয়, ভালোমন্দের টাকা, অন্তহীন যাত্রা ইত্যাদি। উপন্যাস, অমলধবল চাকরি, এক প্রিয়দর্শিনী, ছায়া দম্পতি, হে অনন্তের পাখি, সংঘর্ষ, হে শূন্যতা, মধ্য মাঠের খেলোয়াড়, হে মাতবঙ্গ, দুখিনি কমলা, হে মহা শূন্যতা, কিশোর উপন্যাস দিলুর গল্প ইত্যাদি।

১৯৪০ সালের ১৯ ডিসেম্বর রাহাত খান বর্তমান কিশোরগঞ্জ জেলার, তাড়াইল উপজেলার জাওয়ার গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। ২০২০ সালের ২৮ আগস্ট ঢাকার নিউ ইসকাটনের নিজ বাসভবনে তিনি বার্ধক্যজনিত কারণে মারা যান। তার বয়স হয়েছিল ৭৯ বছর। আশির দশকের মধ্যসময়ে আমার সাংবাদিকতায় আমার হাতেখড়ি। ইত্তেফাকের নির্বাহী সম্পাদক থাকাকালে রাহাত খানের সঙ্গে আমাকে পরিচয় করিয়ে দেন ইত্তেফাকের তৎকালীন বার্তা সম্পাদক গোলাম সারওয়ার। সেই থেকে ধীরে ধীরে স্নেহাশিসে জড়িয়ে পড়া। ছাত্রলীগ করতাম বলে বাড়তি একটা কদরও ছিলো তাঁর কাছে। গোলাম সারওয়ার আমার শ্রদ্ধেয় মামা হওয়ার সুবাদে মান্যবর রাহাত খানসহ ইত্তেফাক পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠদের সঙ্গে আমার সম্পর্কটা ‘মামা-ভাগ্নে’ হয়ে উঠেছিলো। সেই বয়োজ্যেষ্ঠ সাংবাদিকরা আজ আর ইত্তেফাক নেই। অনেকেই চলে গেছেন চিরনিদ্রায়। এই মুহূর্তে আমার চোখে জ্বলজ্বল করে ভাসছে চিরকুমার ইত্তেফাকের বিশেষ প্রতিনিধি ও জাতীয় প্রেসক্লাবের এককালীন সভাপতি সুদর্শন শ্রদ্ধেয় হাসান শাহরিয়ারের শ্যামলী মায়া মুখখানি। মান্যবর রাহাদ খানের মতো হাসান শাহরিয়ারও চোখ পড়লেই থমক দাঁড়িয়ে সদা সহাস্যে আদুরে ডাকে যেন প্রাণ উজাড় করে দিতেন। সে যেন এক প্রবল জিজ্ঞাসা- ভাগ্নে কেমন আছো? সত্যিই আমি এ দুটি মানুষের প্রতি এতটাই অনুরক্ত এবং আবেগাপ্লুত যে, শ্রদ্ধেয় মামা, গোলাম সারওয়ার যুগান্তর ও পরবর্তীতে সমকাল প্রতিষ্ঠা করে সম্পাদক হলেও আমি প্রায়শই ইত্তেফাকে ছুটে যেতাম। আজ মামা নেই প্রিয় মানুষ দুটিও নেই। তাদের বিদগ্ধ আত্মার প্রতি আমার নিরন্তর শ্রদ্ধা।

ফিরে আসা যাক মূল প্রসঙ্গে –

বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রকাশ্য প্রতিবাদের ভাষা হারিয়ে মানুষ যখন স্থবির জড় পদার্থ, তখন সেই স্থবিরতা কাটাতে যে ক’জন কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক সচেষ্ট হয়েছিলেন, তার মধ্যে প্রখ্যাত সাংবাদিক ও কথা সাহিত্যিক রাহাত খান অন্যতম।

কবি শামসুর রাহমান “এ লাশ আমরা রাখবো কোথায়” শিরোনামের প্রবন্ধটিতে লিখেন, “জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে মাটির তলায় চাপা দিয়ে রাখা যায়নি। এক অর্থে তিনি সগৌরবে উঠে এসেছেন কবর থেকে, উঠে এসেছেন তাঁর প্রিয় বাংলাদেশে, ফসলের আভায়, কৃষকের হাসিতে, নদীর স্রোতে, মাঝির ভাটিয়ালি গানে, উত্তর বঙ্গের গাড়িয়াল ভাইয়ের ভাওয়াইয়া গানে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সঞ্চারী মিছিলে, সভায়।”

কবি শামসুর রাহমান প্রয়াত হয়েছেন। সংকলনটির অন্যান্য লেখক ও সংশ্লিষ্টরা একে একে প্রায় সবাই চলে গেছেন।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হওয়ার পর অপ্রকাশিত শোক যন্ত্রণা প্রথম প্রকাশ পায় কবি নির্মলেন্দু গুণের “আমি আজ কারো রক্ত চাইতে আসিনি” শীর্ষক এক কবিতায়। এটাই আমাদের সামনে সত্যাসত্য একটি ইতিহাস। অথচ, কী অদ্ভুত! সেই ইতিহাসটিতে নিজের দখলদারিত্বের কীর্তিধ্বজাধারী হতে প্রস্তুত নন, কবি নির্মলেন্দু গুণ। তাঁর সাফ কথা, তিনি নন, বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পর প্রথম কবিতাটি রচনা করেন, বঙ্গবন্ধুর খুব কাছের একজন মানুষ, যাঁকে আমরা কেউ কবি হিসেবে জানি না। হয়তো নিজেও ভাবেননি কোনদিন তিনি কবিতা লিখবেন। কিন্তু ভবিতব্য তাঁর হাত দিয়েই লেখিয়ে নেয়। এক অবিস্মরণীয় ঐ কবি ছিলেন বঙ্গবন্ধুর বাল্যসুহৃদ! নাম তাঁর মৌলভী শেখ হালিম। আরবি ভাষার শিক্ষক। তাঁর কবিতার দুটি লাইন হলো, “হে মহান, যার অস্থি-মজ্জা, চর্বি ও মাংস এই কবরে প্রোথিত।”

কবি নির্মলেন্দু গুণ বলেন, বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পর অনেকদিন চলে গিয়েছিল, দেশের ভিতরে কোথাও প্রকাশ্যে কেউ তাঁর নাম শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার সঙ্গে উচ্চারণ করতে পারছিলাম না। ১৯৭৭- এর ২১ ফেব্রুয়ারি আমি যে কবিতাটি পাঠ করি ” আমি আজ কারো রক্ত চাইতে আসিনি” সেটি আমি লিখেছিলাম বেশ কিছুদিন আগেই। বিভিন্ন অনুষ্ঠানের উদ্যোক্তারা আমাকে তখনও ঐ কবিতাটি পাঠ করার অনুমতি দেননি। তারপর ভাষা আন্দোলনের ভিতর দিয়ে জন্মগ্রহণ করা, জনগণের প্রতিষ্ঠান বাংলা একাডেমিতে একুশের ভোরের কবিতা পাঠের আসরে আমি ঐ কবিতাটি পাঠ করার সিদ্ধান্ত নিই এবং অনুষ্ঠানে সমবেত সকলকে চমকে দিয়ে আমি ঐ কবিতাটি পাঠ করি। কবিতা পাঠান্তে আমার বুকের মধ্যে চেপে- বসা একটি পাথর অপসারিত হয়।”

নির্মলেন্দু গুণের কবিতাটি এরকম- “সমবেত সকলের মতো আমিও গোলাপ ফুল খুব ভালবাসি, রেসকোর্স পার হয়ে যেতে সেইসব গোলাপের একটি গোলাপ

গতকাল আমাকে বলেছে,

আমি যেন কবিতায়

শেখ মুজিবের কথা বলি।

আমি তাঁর কথা বলতে এসেছি।”

কবির কবিতার শেষ দুটি লাইন হলো, আমি আজ কারো রক্ত চাইতে আসিনি,

আমি আমার ভালোবাসার কথা বলতে এসেছিলাম।”

একটি দুঃখবোধ রয়েছে “এ লাশ আমরা রাখবো কোথায়?” শিরোনামের সংকলনটির প্রকাশনাপূর্ব কিছু ঘটনা নিয়ে। এই

সংকলনটির জন্য অনেক গুণীজনের কাছেই লেখা চাওয়া হয়েছিলো। কিন্তু অনেকেই অপারগতা প্রকাশ করেন। যেমন কবি আসাদ চৌধুরী লেখা চাওয়ার প্রতিত্তোরে বলেছিলেন, ‘এখন এসব ঝামেলায় জড়াতে চাই না।’ সেদিন অনেকের কাছেই লেখা চেয়ে বিমুখ হন দৈনিক সংবাদের আবদুল আজিজ। কবি সিরাজুল ফরিদ সংকলন প্রকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করেন।

সংকলনটিতে অনবদ্য ভুমিকায় অবতীর্ণ ছিলেন, কবি শামসুর রাহমান, সাংবাদিক ও সাহিত্যিক রাহাত খান ছাড়াও উল্লেখযোগ্য সংখ্যক কবি সাহিত্যিক। যেমন, মহাদেব সাহা, হায়াৎ মাহমুদ, মাশুক চৌধুরী, আখতার হুসেন, মাহমুদুল হক, মোহাম্মদ রফিক, জাহিদুল হক, জিয়াউদ্দিন আহমেদ, কামাল চৌধুরী, কবি দিলওয়ার, শান্তিময় বিশ্বাস, নূর- উদ্- দীন শেখ, ওয়াহিদ রেজা, ইউসুফ আলী এটম, খালেক বিন জয়েন উদ্দিন, ফজলুল হক সরকার, ভীষ্মদেব চৌধুরী, তুষার কর , ওয়াহিদ রেজা, ফরিদুর রহমান বাবলু ও আলতাফ আলী হাসু।

জাসদ সমর্থক লুৎফর রহমান রিটন সংকলনটিতে শুধু লেখাই দেননি, তিনি লেখার প্রুফও দেখেন। চূড়ান্ত প্রুফ দেখেন দৈনিক সংবাদের আবদুল আজিজ।

সংকলনে দুই বাংলায় স্বনামধন্য লেখক অন্নদাশংকর রায়ের “যতকাল রবে পদ্মা মেঘনা যমুনা বহমান, ততকাল রবে কীর্তি তোমার শেখ মুজিবুর রহমান” শীর্ষক কবিতাটির অংশ বিশেষ প্রকাশিত হয়।

সংকলনটির কভার আঁকেন শিল্পী মানিক দে। কভারে প্রতীক হিসাবে আঁকা হয় বঙ্গবন্ধুর বিখ্যাত মোটা ফ্রেমের চশমা। কভার শিল্পী হাফটোন ব্যবহারের মাধ্যমে দু’টি ইম্প্রেশনের কৌশল করেন চার রং ছাপার জন্য। কভারে উপর থেকে নিচে কোণাকুনি হাফটোনে লেখা “এ লাশ আমরা রাখবো কোথায়”। এসব কাজে নিরলস শ্রম দেন, ভীষ্মদেব চৌধুরী, নূর-উদ্- দীন শেখ, নবেন্দু চৌধুরী।

দৈনিক সংবাদ রাত দু’টার দিকে এই সংকলনটি ছাপা অক্ষরে প্রকাশ করে। জাতির পিতার প্রতি একদিকে ছিলো সম্মান প্রদর্শন, অপরদিকে তাঁর হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে অমোঘ বজ্র ভাষায় তীব্র প্রতিবাদ।

সেদিনের সেই দুঃসাধ্য কাজে বিশিষ্ট ভুমিকা রাখেন, বামপন্থী রাজনীতিক কমিউনিস্ট পার্টির এককালীন সভাপতি মঞ্জুরুল আহসান খান এবং খেলাঘরের সাধারণ সম্পাদক জিয়াউদ্দিন আহমেদ।

সংকলনটি প্রকাশিত হয় ১৯৭৮ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি। বাংলা একাডেমিতে এটি বিলি করা হয়। পাঁচ টাকা দিয়ে সংকলনটি প্রথমে ক্রয় করেন কবি নির্মলেন্দু গুণ। সংকলনের সম্পাদনায় নাম যায় সূর্য তরুণ গোষ্ঠী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। আওয়ামী লীগের তৎকালীন আহবায়ক সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীন দুঃসাহসিক কাজের জন্য ৫০০ টাকা দিয়ে সংকলনটির একটি কপি ক্রয় করেন। পরবর্তীতে কলকাতা থেকে পুনর্মুদ্রিত হয়। বলা বাহুল্য, আজ দেশবিদেশে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কতশত সংকলন, লেখকের নেই অভাব। কত বন্দনা। কতো দৌড়ঝাঁপ। পুরস্কার পাওয়ার লড়াই। কিন্তু সেদিন সেই বিদগ্ধ ব্যক্তিত্বেরই পরিচয় দিয়েছিলেন যারা, তারা চলমান ইতিহাসের পাতায় কই?

লেখকঃ সিনিয়র সাংবাদিক, কলামিস্ট ও ও ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক দেশ জনতা ডটকম ।