বাংলাদেশে সাড়ে ৬ কোটি মানুষ দারিদ্রতায় ভুগছেন

আপডেট: জুন ২৩, ২০২১
0

দারিদ্র্য নিরূপণের নতুন এক সূচকে দেশের সাড়ে ছয় কোটি মানুষ দরিদ্র বলে এক জরিপে উঠে এসেছে। বহুমাত্রিক দারিদ্র্যের সূচকে (এমপিআই) দেশে এ পরিমাণ দরিদ্র রয়েছে বলে সরকারি সংস্থা পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগ (জিইডি) ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। প্রতিবেদন অনুসারে, বাংলাদেশের ৩৬ দশমিক ১ শতাংশ মানুষ বহুমাত্রিক দরিদ্র্যের শিকার। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবে দেশে ২০২১ সালে জনসংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৬ কোটি ৯৩ লাখে। এ হিসাবে বহুমাত্রিক দারিদ্র্যের সংখ্যা ৬ কোটি ৫১ লাখে।

লকডাউনে ফুটপাতে ব্যবসা বন্ধ করছে প্রশাসন। নিলক্ষেতের বই ব্যবসায়ীদের ব্যবসা বন্ধ করে দেয় পুলিশ।

আজ বুধবার রাজধানীর শেরেবাংলা নগরে এনইসি সম্মেলন কক্ষে অনুষ্ঠিতব্য সভায় এ প্রতিবেদন প্রকাশ করা হবে। জিইডির সদস্য (সিনিয়র) সচিব ড. শামসুল আলম বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, উন্নয়ন তথা দারিদ্র্যের ধারণাগত পরিবর্তন হয়েছে। শুধু প্রবৃদ্ধিনির্ভর উন্নয়ন হলেই চলবে না। বৈষম্য কমিয়ে এনে সাম্যের ভিত্তিতে উন্নয়ন করতে হলে জীবনযাত্রার অনেক কিছুই বিবেচনায় নিতে হবে। পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান বলেছেন, আগামীতে দারিদ্র্য ও বৈষম্য কমাতে বহুমুখী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।

জিইডির ‘স্ট্রেনদেনিং দ্য সোশ্যাল পলিসিজ ফর চিলড্রেন অন এ মিডল ইনকাম ইকোনমি’ শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় তৈরি করা বহুমাত্রিক দারিদ্র্যের সূচকে (এন-এমপিআই) এবং বহুমাত্রিক শিশু দরিদ্রসূচক (সি-এমপিআই) প্রতিবেদনটি তৈরিতে জাতিসংঘ শিশু তহবিল বা ইউনিসেফ এবং অক্সফোর্ড প্রভার্টি অ্যান্ড হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট ইনস্টিটিউট (ওপিএইচআই) আর্থিক ও কারিগরি সহায়তা দিয়েছে। প্রতিবেদনটি প্রসঙ্গে শামসুল আলম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘কাল (বুধবার) এটি প্রকাশ করা হবে। এরপর বিস্তারিত বলা যাবে।’

জীবনযাত্রার মান, শিক্ষা এবং স্বাস্থ্যের বিষয়টিকে সমান গুরুত্ব দিয়ে আর্থসামাজিক খাতের মোট ১১টি সূচকের মাধ্যমে এমপিআই সূচক তৈরি করা হয়েছে। আর সি-এমপিআই তৈরি করতে এই ১১ সূচকের পাশাপাশি শিশু অধিকার সংক্রান্ত চারটি সূচক ব্যবহার করা হয়েছে। বিভিন্ন সূচকের মাধ্যমে প্রণয়ন করা এমপিআই বা সি-এমপিআইর মান শূন্য থেকে ১ পর্যন্ত হতে পারে। এ সূচকের মান শূন্যের যত কাছাকাছি হবে, বহুমাত্রিক দারিদ্র্য হবে তত কম। আর এর মান ১ এর কাছাকাছি গেলে বহুমাত্রা দারিদ্র্য বেশি হবে।

প্রতিবেদন অনুযায়ী, জাতীয় পর্যায়ে এমপিআই দাঁড়িয়েছে শূন্য দশমিক ১৬৮ পয়েন্টে, যা পল্লী এলাকায় শূন্য দশমিক ১৮৫ ও শহর এলাকায় শূন্য দশমিক ১০৬ পয়েন্ট। শিশুদের বিশেষ অগ্রাধিকার দিয়ে তৈরি করা প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে, ১৭ বছর পর্যন্ত বয়সী শিশু রয়েছে এমন খানার ৫৭ শতাংশই বহুমাত্রিক দারিদ্র্য মোকাবিলা করছে। এ হিসাবে শিশু রয়েছে এমন খানায় দারিদ্র হার ২১ শতাংশীয় পয়েন্ট বেশি।

বিবিএসের খানা আয়-ব্যয় জরিপের মাধ্যমে পাওয়া দারিদ্র্য হারের মতোই বহুমাত্রিক দারিদ্র্যও পল্লী এলাকায় কেন্দ্রীভূত রয়েছে বলে প্রতিবেদনটিতে উঠে এসেছে। এতে বলা হয়েছে, শহর অঞ্চলের ২৩ দশমিক ২ শতাংশ মানুষ বহুমাত্রিক দারিদ্র্যের শিকার। পল্লী অঞ্চলে এর হার প্রায় দ্বিগুণ, ৩৯.৭ শতাংশ।

এ হিসাবে বহুমাত্রিক দারিদ্র্যের শিকার মানুষের ৮৬ দশমিক ১ শতাংশ দরিদ্র মানুষের অবস্থান পল্লী অঞ্চলে। এর ব্যাখ্যায় প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে, পল্লী অঞ্চলে দারিদ্র্যের হার এমনিতেই বেশি। আর মোট জনসংখ্যার ৭৮ দশমিক ৪ শতাংশ বসবাস করেন গ্রামে। এ হিসাবে মোট দরিদ্রের সংখ্যা গ্রামেই বেশি।

প্রবৃদ্ধিনির্ভর উন্নয়ন থেকে বের হতে হবে : বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) মহাপরিচালক (ডিজি) বিনায়ক সেন দেশ রূপান্তরকে বলেন, বিশ্বের বহু দেশে এ সূচকে এখন দারিদ্র্য মাপা হচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশে ভোগ ব্যয় সূচকে সাধারণত দরিদ্র মাপা হচ্ছে। এমপিআই সূচকে বেশ কয়েকটি বিষয়কে মূল্যায়ন করা হয়। এটি একটি আদর্শ অর্থনৈতিক উন্নয়নের মাপকাঠি বলা যেতে পারে। উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, অনেক জেলায় মানুষের আয় বেশি থাকতে পারে। কিন্তু বিদ্যুৎ, সুপেয় পানি, শিক্ষা, চিকিৎসা ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা কম থাকলে তারা এ সূচকে দরিদ্র বলে তুলনামূলক বেশি গণ্য হবে।

তিনি বলেন, জিইডি এই প্রতিবেদনে আগের করা এমপিআই প্রতিবেদনের সঙ্গে তুলনা করেনি। ফলে বোঝা যাচ্ছে না, দেশে বহুমাত্রিক দরিদ্র কমেছে না বেড়েছে।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এ সূচক অনুসারে পদক্ষেপ নেওয়া হলে দেশের মানুষের লিভিং স্ট্যান্ডার্ড বা জীবনমান উন্নয়নে ভূমিকা রাখবে। দেশের মানুষের মধ্যে আয় বৈষম্য কমে আসবে। উন্নয়নের ধারণা সূচকের সঙ্গে এটি অসামঞ্জস্য নয়।

একই ধরনের কথা বলেছেন বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন। গতকাল দেশ রূপান্তরকে তিনি বলেন, শুধু আয়-ব্যয় বা ভোগ ব্যয় সূচক দিয়ে এ দারিদ্র্যের হার মাপা হয়নি। এর সঙ্গে বাসস্থান, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ অন্যান্য বিষয়ও যুক্ত করে হিসাব করা হয়েছে। এমপিআই থেকে বোঝা যায়, মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি দিয়ে দারিদ্র্য মাপলে হবে না। দারিদ্র্যের বহুমুখিতা রয়েছে। এগুলো বিবেচনায় নিলে দারিদ্র্য মানুষের সংখ্যা বাড়বে এটাই বাস্তবসম্মত। তিনি বলেন, এ সূচকে দারিদ্র্য মাপলে দেশে বৈষম্য ও সাম্যের ভিত্তিতে উন্নয়ন নিশ্চিত হবে। তা না হলে প্রবৃদ্ধি বাড়বে, মাথাপিছু আয় বাড়বে কিন্তু বৈষম্য কমবে না। উদারহরণ দিয়ে তিনি আরও বলেন, কারও বাসায় যদি বিদ্যুৎ না থাকে তাহলে কোটি টাকা থাকলেও লাভ নেই। তিনি জীবনধারণের জন্য অনেক সুবিধা থেকে বঞ্চিত হবেন। এ থেকে বলা যায়, জীবনযাপনের জন্য বিভিন্ন সুযোগ থেকে কেউ বঞ্চিত হলেই এ সূচকে তিনি অন্তর্ভুক্ত হবেন। হয়তো আয়ের দিক দিয়ে তিনি এগিয়ে থাকতে পারেন।

বহুমুখী পদক্ষেপ নেওয়া হবে: পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান দেশ রূপান্তরকে বলেন, দেশে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বেড়েছে এটা সত্য। কিন্তু যে হারে বলা হচ্ছে বাস্তবে তার চেয়ে কম হতে পারে। দরিদ্র মানুষের আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নয়নে সরকার সবসময় আন্তরিক। নানামুখী পদক্ষপ নিচ্ছে আর নেবে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, জিইডির নতুন রিপোর্টে দরিদ্রের যে হিসাব দেওয়া হয়েছে, সেটি নিয়ে আলাপ-আলোচনা করতে হবে। তবে সরকার দারিদ্র্যদের অবস্থা পরিবর্তনে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতা ও পরিধি, নগদ সহায়তা, আয়বর্ধক কর্মসূচি ও নানা ধরনের ত্রাণ কার্যক্রম বাড়াবে।

শিশুদের খানায় দরিদ্র বেশি : শিশু রয়েছে এমন খানাগুলোতে সি-এমপিআই দাঁড়িয়েছে শূন্য দশমিক ২২৬ পয়েন্টে যা জাতীয় এমপিআই শূন্য দশমিক ১৬৮ থেকে অনেক বেশি। একইভাবে শিশুদের খানাগুলোতে বহুমাত্রিক দারিদ্র্যের গড় হার ৫৭ শতাংশ, যা জাতীয় গড় হারের চেয়ে ২১ শতাংশীয় পয়েন্ট বেশি। শিশু রয়েছে এমন নারীপ্রধান পরিবারে সি-এমপিআই শূন্য দশমিক ১৯৯ পয়েন্ট, যা পুরুষপ্রধান খানার শূন্য দশমিক ২২৮ পয়েন্ট থেকে অনেক কম।

কম বয়সী শিশুরা সবচেয়ে বেশি দারিদ্র্যের শিকার হচ্ছে বলে প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। এতে বলা হয়েছে, শূন্য থেকে পাঁচ বছর বয়সী শিশুদের সি-এমপিআই শূন্য দশমিক ২৮৫ পয়েন্ট। আর এই বয়সী শিশু রয়েছে এমন পরিবারগুলোর ৬৮ দশমিক ৭ শতাংই দারিদ্র্যের শিকার। অন্যদিকে ১৬-১৭ বছর বয়সী শিশু রয়েছে এমন পরিবারে সি-এমপিআই শূন্য দশমিক ২৮৫ পয়েন্ট। আর এমন পরিবারে দারিদ্র্যের হার ৪৫ দশমিক ৬ শতাংশ।

প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, সিলেট বিভাগের শিশুরাই সবচেয়ে বেশি দারিদ্র্যের শিকার। এ বিভাগের শূন্য থেকে পাঁচ বছর বয়সী শিশুদের ৬৬ দশমিক ৪ শতাংশই দারিদ্র্যের শিকার।নতুন দারিদ্র্য পকেট সিলেট, চট্টগ্রাম ও বরিশাল বিভাগ : প্রকাশের অপেক্ষায় থাকা প্রতিবেদনটির তথ্য অনুযায়ী, সিলেট বিভাগের সর্বোচ্চ ৫০ দশমিক ৭ শতাংশ খানাই বহুমাত্রিক দারিদ্র্যের শিকার। এছাড়া চট্টগ্রাম ও বরিশাল বিভাগকে দারিদ্র্যের নতুন পকেট হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চট্টগ্রাম বিভাগের বান্দরবান জেলা সর্বোচ্চ ৭৫ শতাংশ বহুমাত্রিক দারিদ্র্য নিয়ে তালিকায় শীর্ষে রয়েছে। দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা বরিশাল বিভাগের ভোলায় বহুমাত্রিক দারিদ্র্য হার ৬২ শতাংশ। আর ৬১ শতাংশ দারিদ্র্য নিয়ে তালিকায় তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে সিলেট বিভাগের সুনামগঞ্জ।
এছাড়া বহুমাত্রিক দারিদ্র্যের তালিকায় ওপরের দিকে থাকা জেলার মধ্যে রয়েছে রাঙ্গামাটি ও কক্সবাজার (৫৭ শতাংশ), হবিগঞ্জ (৫৫ শতাংশ), কুড়িগ্রাম (৫৪ শতাংশ), নেত্রকোনা (৫২ শতাংশ) ও খাগড়াছড়ি (৫১ শতাংশ)।