বৃটিশ -পাকিস্তানীদের মতোই বিরোধী মত দমনে আ’লীগও ঔপনিবেশিক প্রশাসন ব্যবহার করছে

আপডেট: জুন ১১, ২০২১
0

অ্যাড তৈমূর আলম খন্দকার

স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাস একটি রক্ত রাঙ্গানো ইতিহাস। শুধু স্বাধীনতা যুদ্ধ নয়, বরং পর্যায়ক্রমে অধিকার আদায়ের প্রতিটি ঘটনার সাথে জড়িত রয়েছে বাংলাদেশীদের রক্ত আর রক্ত। মা’য়ের ভাষায় কথা বলার জন্যও এ জাতিকে রক্ত দিতে হয়েছে। বৃটিশ পূর্ব রাজত্বে ছিল জমিদারদের নির্মম নির্যাতন, বৃটিশ দেশ লুটের পাশাপাশি রক্ত পিপাসু হিংস্যাত্বক পশুরমত গণমানুষের রক্ত নিংরে নিয়েছে। পাকিস্তানের ২৪ বৎসর শাসনামলে বাঙ্গালীর বুকের উপরে বন্দুক চালিয়েই তারা দেশ শাসন শোষন উভয়ই করেছে। রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে দেশ স্বাধীন হয়েছে। কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশেও রক্তের হোলী বন্ধ হয় নাই। দেশ শাসনে ঔপনিবেশিক (কলোনী) প্রথার অবসান ঘটলেও রাষ্ট্র পরিচালনায় ঔপনিবেশিক প্রশাসনিক সংস্কৃতির পরিবর্তন ঘটে নাই। শোষন, বঞ্চনামুক্ত একটি রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় বসবাস করার জন্য “স্বাধীনতার” প্রয়োজন হয়। বাঙ্গালীরা বাঙ্গালীদের শাসন করবে বা রাষ্ট্র পরিচালনা করবে এই উদ্দেশ্যোর পাশাপাশি নাগরিকদের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক সামাজিক সাম্য ও সুবিচার নিশ্চিত করাই হলো স্বাধীনতার মূলমন্ত্র (সূত্র: বাংলাদেশের সংবিধানের প্রস্তাবনার ২য় অনুচেছদ)।

স্বাধীনতার জন্য মুক্তিযুদ্ধ পূর্ব স্বাধিকার আন্দোলনের মূল শ্লোগান ছিল “কেউ খাবে তো কেউ খাবে না, তা হবে না, তা হবে না।” এখন বৃটিশ, পাকিস্তানের পরিবর্তে বাঙ্গালীরা হয়েছে বাঙ্গালীদের নির্যাতনের হাতিয়ার। বাংলাদেশ এখন স্পষ্টই দু’ভাবে বিভক্ত। যথাঃ (১) ক্ষমতাবান বনাম (২) ক্ষমতাহীন। আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য ও সুবিচার নিশ্চিত করার জন্য সাংবিধানিক অঙ্গীকারের পরিবর্তে রাষ্ট্রীয় যন্ত্র যেন ক্ষমতাবানদের সেবাদাসে পরিনত হয়েছে। সংবিধানের ২১(২) অনুচ্ছেদে স্পষ্টই বলা হয়েছে যে, “সকল সময়ে জনগণের সেবা করিবার চেষ্টা করা প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিযুক্ত প্রত্যেক ব্যক্তির কর্তব্য।” প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিযুক্ত ব্যক্তিদের সকল ব্যায় বহন করে দেশের সর্বময় জনগণ। অর্থাৎ দেশের মোট জনসংখ্যা ১৮ কোটি, এ ১৮ কোটি জনগণের উর্পাজিত অর্থে লালিত পালিত হচ্ছে এ দেশের প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিযুক্ত প্রত্যেক ব্যক্তি, অর্থাৎ তাদের বেতন ভাতা, গাড়ী, বাড়ী সবকিছুই সর্বময় জনগণের কষ্টার্জিত অর্থের বিনিময়ে। কিন্তু আমাদের দেশের আমলাতন্ত্র অর্থাৎ প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিযুক্ত ব্যক্তিরা কি আপামর জনগণকে সমভাবে সম্মানের চোখে বা এক মর্যাদায় মূল্যায়ন করেন?

আমাদের দেশের যে আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থা তা দুইশতাধিক বৎসরের পূরানো। বৃটিশ যে আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থা সৃষ্টি করেছিল সে আদলেই বাংলাদেশের আমলাতন্ত্র চলছে। “সেবার” চেয়ে “শাসনের” মনোভাব ও মানসিকতা নিয়েই স্বাধীন বাংলাদেশের আমলাদের পথ চলা। বৃটিশরা যখন ভারত উপমহাদেশের শাসনভার গ্রহণ করে তখন বিভিন্ন পদ পদবী সৃষ্টি করে এ দেশবাসীকে শাসন করতো। ঔপনিবেশিক শাসন ব্যবস্থা অর্থাৎ দেশবাসীকে গোলাম বানিয়ে শাসন করার ট্রেনিং এবং বর্তমান ট্রেনিং এ কোন পার্থক্য নাই। এ দেশকে শাসন করার জন্য বৃটিশ যে আইন প্রনয়ন করেছিল সে আইনে এখনও দেশ চলছে। ঞযব ঙভভরপরধষ ঝবপৎবপঃ অপঃ’ ১৯২৩ এর মত অনেক আইন এখনো কার্যকর রয়েছে যা বৃটিশরা তাদের স্বার্থ রক্ষায় প্রনয়ন করেছিল। স্বাধীনতা কামীদের দমন করার জন্য বৃটিশ ১৯০৮ ইং সনে ঊীঢ়ষড়ংরাব ঝঁনংঃধহপব অপঃ নামক আইন প্রনয়ন করে। সে আইন বর্তমানে ব্যবহ্নত হচ্ছে অধিকার আদায়ে আন্দোলনকারীদের উপর। পুলিশ রাষ্ট্রীয় প্রশাসন ব্যবস্থার অন্যতম প্রধান হাতিয়ার। ঞযব চড়ষরপব অপঃ’ ১৮৬১ প্রনয়ন করে বৃটিশরা এদেশে পুলিশী প্রশাসন চালু করে। আইনের শাসন সমভাবে প্রতিষ্ঠার পরিবর্তে জনগণকে শাসন শোষনের মাধ্যমে বৃটিশের হাতকে কি ভাবে শক্তিশালী রাখা যায় সে চিন্তাধারাকে সামনে রেখেই পুলিশ বাহিনী ১৮৬১ ইং সনে অনুষ্ঠানিকভাবে গঠন করা হয় যা বর্তমানে একটি স্বাধীন দেশের ঠেলে সাজানো বাঞ্চনীয়। “পুলিশ হবে জনতার” এ শ্লোগানের বাস্তবায়ন দেখা যায় না।

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার প্রেক্ষাপট পর্যালোচনায় দেখা যায় যে, সম্পদের সুষম বন্টন, ব্যবসা বানিজ্য ও নিয়োগ বা প্রমোশনের ক্ষেত্রে বৈষম্য এবং ১৯৬৯/৭০ সনে পূর্ব-পাকিস্তানের নাগরিকদের ভোটে নির্বাচিতদের ক্ষমতা হস্তান্তরের বিষয়ে পাকিস্তানী সামরিক জান্তা ও ভূট্টোর ছল চাতুরীর কারণেই পশ্চিমাদের থেকে আলাদা হওয়ার জন্য বাঙ্গালীরা মানসিক প্রস্তুত গ্রহণ করে। কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত সম্পদের সুষম বন্টনের জন্য রাষ্ট্রীয় কোন পদক্ষেপ নাই। দেশের ব্যবসা, বানিজ্য, টেন্ডার সরকারী-বেসরকারী খাত সব কিছুই ক্ষমতাসীনদের দখলে। টেন্ডার দখল করতে ক্ষমতাসীনদের মধ্যে গোলাগুলি, ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার। কিছু বহুরূপী মানুষ আছে যারা যে দল যখন ক্ষমতায় তখন সে দলে ভিড়ে গিয়ে নিজেদের ব্যবসা-বানিজ্য টিকিয়ে রাখছে ক্ষমতাসীনদের বখরা দেয়ার মাধ্যমে।

বিরোধীদলের সাথে সম্পর্ক ছিল বা কোন আত্নীয়-স্বজন বিরোধী দলে থাকলেও নিয়োগ বা পদোন্নতি হচ্ছে না, এগুলি স্বাধীন দেশের নাগরিকদের মধ্যে চরম বৈষম্যের আওতায় কি পড়ে না? এ বৈষম্যের মধ্যে ক্ষমতাসীনদের আনুকুল্য পাওয়ার জন্য প্রজাতন্ত্রে নিযুক্ত ব্যক্তিরা সকলেই এখন সরকারী দল হয়ে গেছে। তারা বিরোধী দলের নেতাদের সাথে ভিন্ন টেলিফোনে কথা বলে যে ফোনে আড়িপাতার সম্ভবনা নাই। ভিন্ন মতাবলম্বীরা এখন রাষ্ট্রীয় সেবা থেকে বঞ্চিত, কারণ আমলারা বিরোধী দল দেখলেই নাক ছিটকানো শুরু করে। তারা মনে করে যে, বিরোধী দলের সাথে কথা বললে এ.সি.আর (বাৎরিক গোপনীয় প্রতিবেদন) যদি খারাপ হয়ে যায়, যদি তাদের প্রমোশন না হয় (!) তবে ব্যতিক্রম কিছু রয়েছে যার সংখ্যা মাইক্রোস্ক্রোপে দেখার মত।

একটি সমীক্ষায় দেখা যায় যে, দেশে ৩৯ লাখ ৩৩ হাজার মামলা বিচারাধীন। জাতীয় পত্রিকার ভাষ্যমতে এর কারণ হিসাবে আইনজীবীরা মতামত দিয়ে বলেছেন যে, “মামলার জট কমাতে প্রথমত: দরকার শুশাসন। মামলার উৎপত্তি স্থল কমাতে হবে। মিথ্যা মামলা, রাজনৈতিক ও হয়রানীমূলক মামলার কারণে মামলার জট বাড়ছে। তাই মামলার জট কমাতে সুশাসনের পাশাপাশি সরকারের মহাপরিকল্পনা দরকার। আর যদি মামলার জট কমানো না হয় তা হলে বিচারের প্রতি মানুষের অনীহা জন্মাবে” (সূত্র: জাতীয় দৈনিক, তাং-০৫/৬/২০২১ ইং)। দেশের আইনজীবী সমাজও মনে করে যে, বিরোধী দলের বিরুদ্ধে অধিক পরিমাণে রাজনৈতিক ও হয়রানীমূলক ফৌজদারী মামলা হওয়ার কারণেই অসহনীয় মামলা জট সৃষ্টি হওয়ার মূল কারন।

বৃটিশ যে ভাবে পুলিশী মামলা দিয়ে স্বাধীনতাকামীদের হয়রানী করেছে, পাকিস্তান তার ব্যতিক্রম করে নাই এবং স্বাধীন বাংলাদেশেও যদি বিরোধী দলের উপর অনুরূপ নির্যাতন করা হয় তবে এ স্বাধীনতার স্বাদ দল, মত, নির্বিশেষে সমগ্র দেশবাসী পেলো কোথায়? এবং স্বাধীনতা সার্বিকভাবে মূল্যায়িত না হওয়ার কারণ কি? বিরোধীদের মিথ্যা মামলা নিয়ে নির্যাতনের অর্থই হলো রাষ্ট্রীয় অর্থের অপচয়। প্রশাসন জনগণের অর্থে লালিত পালিত, এ প্রশাসনকে ব্যবহার করা হয় মিথ্যা বানোয়াট মামলা সৃজন করার জন্য।

১৯৯৭ ইং সনে তৎকালিন সরকার ১৯৭৪ ইং সনের বিশেষ ক্ষমতা আইনে আমাকে আটক করে ডিটেনশনে নারায়নগঞ্জ জেলা কারাগারে প্রথমে বন্ধী রাখে। ২ দিন পরে আমাকে ময়মনসিংহ কেন্দ্রীয় কারাগারে রাত্রিতে প্রেরণ করার সময় মাইক্রোবাস ভর্তি পুলিশ ছিল এবং আমাকে হাতে হ্যান্ডকাপ লাগিয়েই মাইক্রোবাসে নিয়ে যাচ্ছিল। গাড়ীতে উঠিয়েই একজন বয়স্ক পুলিশ আমার হ্যান্ডকাপটি আরো টাইট করে দেওয়ায় একজন জুনিয়র পুলিশ বললো যে, আসামীতো গাড়ীর ভিতরেই আছে। হ্যান্ডকাপ এতো টাইট করার দরকার কি? বয়স্ক পুলিশটি বললো “এখন টাইট করে দেই, মন্ত্রী হলে স্যালুট করবো” এ হলো আমাদের দেশের আমলাদের মানসিকতা। যে পন্থায় হউক না কেন নির্যাতন নিপীড়ন করাই যেন পুলিশের নেশা ও পেশা। বিআরটিসি’র চেয়ারম্যান থাকাবস্থায় আমার নিকট একটি ফাইল উপস্থাপন করা হ’ল। সেখানে দেখলাম, সংস্থার জেনারেল ম্যানেজার (কারিগরি) অশোক কুমার সাহা একটি ঘটনার তদন্তকারী কর্মকর্তা হিসাবে তদন্তের সময় বৃদ্ধি করার জন্য আবেদন করেছে। ফাইলটি পর্যালোচনা করে দেখলাম যে, ৯ বৎসর পূর্বে নিম্নপদস্থ একজন কর্মচারীর অপরাধের বিভাগীয় তদন্তের জন্য অনেক তদন্তকারী কর্মকর্তা বদলী হয়েছে, কিন্তু তদন্ত শেষ হয় নাই। এমর্মে আমি অশোক বাবুকে শোকজ করলে তদন্ত প্রতিবেদন আসে। অনেক ঘটনার জন্য তদন্ত কমিটি করা হতো। কমিটি আমাকে জিজ্ঞাসা করতো রিপোর্ট কি ভাবে দিবো? আমি বলতাম যে, আপনারা যা পেয়েছেন সে রিপোর্টই দিবেন। প্রতিউত্তরে উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তারা বলতো যে, স্যার কর্তৃপক্ষের চাহিদা অনুযায়ী রিপোর্ট প্রদান করাই প্রশাসনে একটি অলিখিত নিয়ম চালু রয়েছে। অর্থাৎ সত্য মিথ্যার কোন বালাই নাই। আমলাদের বিবেক বলতে কোন বিষয় কাজ করে না। কর্তার ইচ্ছায়ই কর্ম। এটাই আমলাতন্ত্রের সংস্কৃতি। তবে ব্যতিক্রম কিছু যে নাই তা বলা যাবে না।

২০০১ ইং সনের ১৬ই জুন নারায়নগঞ্জ (চাষাঢ়া) আওয়ামী লীগ অফিসে পৈশাচিক বোমা হামলায় ২২ জন নিহতসহ প্রায় অধশত নারী পুরুষ আহত হয়ে পঙ্গুত্ব বরন করে। উক্ত মামলায় আমাকে প্রধান আসামী করে ২৭ জন বিএনপি সক্রিয় নেতা-কর্মীদের আসামী করা হয়। জামিন নিয়ে প্রথম তদন্তকারী কর্মকর্তা সিআইডি’র সহকারী পুলিশ সুপার আমিনুল ইসলামের সাথে সাক্ষাৎ করি। তিনি বললেন আমিও জানি আপনারা বোমা বিস্ফোরন করেন নাই। কিন্তু সরকার যে ভাবে চাইবে সে ভাবেই চার্জশীট বা ফাইনাল রিপোর্ট প্রদান করা হবে।

সংবিধানের অনুচ্ছেদ ২১(২) মোতাবেক স্বাধীন বাংলাদেশে একটি গণমূখী প্রশাসন চালু থাকার কথা ছিল। কিন্তু দু:ক্ষজনক হলেও সত্য যে, ঔপনিবেশিক আমলাতন্ত্রের এখনো অবসান ঘটে নাই। জনগণের চাহিদা নয় বরং কর্তাদের তৈল মর্দন তথা তাদের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটানোই যেন প্রজাতন্ত্রে কর্মরত ব্যক্তিদের প্রধান দায়িত্ব বলে তারা মনে করে। দেশে যতদিন গণমূখী প্রশাসন তৈরী না হবে ততদিন ধর্ম, বর্ণ, দল, মত নির্বিশেষে গণমানুষ স্বাধীনতার সুফল ভোগ করতে পারবে না, যেমনটি ভোগ করছে দেশের ক্ষমতাবানরা যাদের হাতে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলকাঠি এবং তাদের সহৃদয় অনুশারীরা।

লেখক

রাজনীতিক, কলামিষ্ট ও আইনজীবি (এ্যাপিলেট ডিভিশন)

মোবাঃ ০১৭১১-৫৬১৪৫৬
[email protected]