বৃহত্তর ঐক্য ও আন্দোলনের আহবান: সরকার কেন ভারত থেকে রামপাল প্রকল্পের জন্য নিম্নমানের কয়লা আনছে জাতি জানতে চায় — সুলতানা কামাল

আপডেট: জুলাই ৫, ২০২১
0

সুলতানা কামাল বলেছেন , যেখানে সারা বিশ্বে কয়লা ভিত্তিক প্রকল্প বন্ধ করা হচ্ছে সেখানে রামপাল প্রকল্পের জন্য সরকার কেন ভারতের নিম্নমানের কয়লা আনছে? তিনি বলেন সরকার কেন সুন্দরবন নিয়ে অসত্য তথ্য ও বক্তব্য দিয়ে জাতীকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছে তা জাতী জানতে চায়। বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) ও সুন্দরবন রক্ষা জাতীয় কমিটির যৌথ উদ্যোগে আজ ৫ জুলাই সোমবার সকাল ১১টায় “রামপালমূখী ভারতীয় কয়লা, বিপদাপন্ন সুন্দরবন ও ইউনেস্কো বিশ্বঐতিহ্য কমিটির আসন্ন সভা” শীর্ষক এক সংবাদ সম্মেলনে সভাপতির বক্তেব্য সুলতানা কামাল এসব কথা বলেন।

বাপা ও সুন্দরবন রক্ষা জাতীয় কমিটির সভাপতি, সুলতানা কামাল এর সভাপতিত্বে এবং সাধারণ সম্পাদক শরীফ জামিলের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে সম্মানিত আলোচক হিসেবে অংশ গ্রহণ করেন, বাপা’র সহ-সভাপতি রাশেদা কে. চৌধুরী, মানবাধিকার কর্মী খুশী কবির, বাপা’র নির্বাহী সহ-সভাপতি এবং সুন্দরবন রক্ষা জাতীয় কমিটির সদস্য সচিব ডাঃ মোঃ আব্দুল মতিন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক এম.এম. আকাশ, বেলা’র প্রধান নির্বাহী, সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, বেন-এর অন্যতম সংগঠক ও যুক্তরাষ্ট্রের লক হেভেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক ড. মোঃ খালেকুজ্জামান, , তেল-গ্যাস, খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির অন্যতম সংগঠক রুহিন হোসেন প্রিন্স এবং কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র বিষয়ে আন্তর্জাতিকভাবে প্রতিষ্ঠিত বিশেষজ্ঞ ও প্রকৌশলী ড. রনজিত সাহু প্রমূখ। এছাড়া ভার্চুয়াল সংবাদ সন্মেলনে উপস্থিত থেকে বক্তব্য রাখেন, বিআইপি’র সাবেক সভাপতি, অধ্যাপক গোলাম রহমান, আর্থজাস্টিসের জ্যেষ্ঠ বিজ্ঞানী জেসিকা লরেন্স, বাপা’র মোংলা আঞ্চলিক শাখার আহবায়ক, নূর আলেম শেখ প্রমূখ।

সভাপতির বক্তব্যে সুলতানা কামাল বলেন, যেখানে সারা বিশ্বে কয়লা ভিত্তিক প্রকল্প বন্ধ করা হচ্ছে সেখানে রামপাল প্রকল্পের জন্য সরকার কেন ভারতের নিম্নমানের কয়লা আনছে? তিনি বলেন সরকার কেন সুন্দরবন নিয়ে অসত্য তথ্য ও বক্তব্য দিয়ে জাতীকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছে তা জাতী জানতে চায়।

রাশেদা কে. চৌধুরী বলেন, বাপা কখনও উন্নয়ন বিরোধী নয়, কিন্তু বাপা কলয়াভিত্তিক প্রকল্পের বিরোধী। সরকার কেন বুঝতে চায়না যে, দেশের সাধারণ মানুষ কয়লা ভিত্তিক প্রকল্প চায়না। ঐতিহ্য রক্ষার ক্ষেত্রে সরকারের অনিহা লক্ষ্য করা যায়। বৈজ্ঞানিক গবেষণা ছাড়া কোনো প্রকল্প গ্রহণ করা যুক্তিযুক্ত হবেনা বলে তিনি মনে করেন।

খুশী কবির বলেন, এতো প্রশ্নবিদ্ধ একটি প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়নের পূর্বে সরকারকে অবশ্যই সচেতেন হওয়া দরকার। আমরা জানতে চাই, যেখানে সারা বিশ্ব কয়লা ভিত্তিক প্রকল্প বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সেখানে সরকার কেনো কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প তৈরী করছে। তিনি বলেন, আমাদেরকে এ বিষয়ে সরকার সঠিকভাবে তথ্য সরবরাহ করছে না, যা দেওয়া হচ্ছে তাও অসংলগ্ন এবং বিচ্ছিন্ন। সরকারের মধ্যে জবাবদিহীতার অভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে বলে তিনি মনে করেন। সরকার দেশের ফুসফুস খ্যাত সুন্দরবন কে কেনো ধ্বংসের পাঁয়তারা করছে তা আমরা এদেশের নাগরিক হিসেবে জানতে চাই। মুষ্টিমেয় লোকের ব্যবসায়িক স্বার্থ রক্ষার জন্য এ প্রকল্প বাস্তবায়নের জোর তাগাদা চলছে বলেও তিনি মন্তব্য করেন।

ডাঃ মোঃ আব্দুল মতিন রামপালের স্থানীয় আন্দোলনকারীদের সাথে সারাদেশের মানুষকে সম্পৃক্ত করার আহবান জানান। তিনি বাপা এবং পরিবেশপ্রেমী অন্যান্য সংগঠনকে সাথে নিয়ে সারা দেশে বৃহত্তর ঐক্য ও আন্দোলনের আহবান জানান।

অধ্যাপক এম.এম. আকাশ বলেন, ইউনেস্কো ২০১৯ সালে বলেছে যে ইআইএ ছাড়া কোন কয়লা ভিত্তিক প্রকল্প সুন্দরবনে করা যাবে না কিন্তু সরকার কোন রকম যুক্তি তর্কের ধার ধারছে না। বৈষ্যিক দিক বিবেচনা করে এ প্রকল্প দ্রুত বাতিল করা প্রয়োজন বলে তিনি মনে করেন। তিনি যে প্রকল্প টিকবেনা তা করার কোন যুক্তি নেই বলে মনে করেন।

সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ইআইএ মূলত একটি গ্রীনওয়াশ। দেশে বিদ্যুতের ওভার ক্যাপাসিটি হওয়ার পরেও কেনো রামপালের মতো দুষনকারী কয়লা ভিত্তিক প্রকল্প প্রয়োজন তার প্রশ্ন তুলেন। তিনি দেশের ১৪৫০০ কোটি টাকা অলস বসে থাকা বিদ্যুৎকেন্দ্র গুলোতে দেবার জন্য কেন মানুষ সরকারকে ট্যাক্স দিবে তা জানতে চান। সরকার মূলত রাজনৈতিক ইগো থেকেই এইসব প্রকল্প করছে বলে তিনি মন্তব্য করেন। তিনি নবায়নযোগ্য জ্বালানী প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়নসহ সকল জীবাশ্ম জ্বালানী বন্ধের আহবান জানান।

অধ্যাপক ড. খালেকুজ্জামান বলেন, সিইজিআইএসের তৈরি ইআইএ রিপোর্টটি একটি বিদ্রূপ ছাড়া কিছুই নয় । সমীক্ষা বলছে যে এই ইআইএ রিপোর্টটি সমস্ত আন্তর্জাতিক মান লঙ্ঘন করে। কয়লা সত্যি একটি নোংরা জ্বালানী, এটি নিয়ে কোন প্রশ্নই আসে না। সুন্দরবনে যা ঘটছে তা একটি ট্র্যাজেডি। ভারতে নিকটতম বিদ্যুৎকেন্দ্র সুন্দরবন থেকে ৪০ কিমি দূরে তবে বাংলাদেশের রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের দূরত্ব সুন্দরবন থেকে মাত্র ১৪ কিলোমিটার । বাংলাদেশের অন্যান্য বিদ্যুৎকেন্দ্র যেমন মাতারবাড়ি, পায়রা, তালতলী, কলাপাড়া সবই পরিবেশগতভাবে সংবেদনশীল অঞ্চলে অবস্থিত। সরকারের প্রস্তাবিত কয়লা-বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলি বাংলাদেশের জন্য গভীর সমস্যা । এটা লজ্জার বিষয় যে বাংলাদেশ সরকার কয়লা-বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে তাদের মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে না । বিকল্প শক্তি নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের ভাবার এখন সময় এসেছে।

রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, দেশের ৯৯ ভাগ মানুষ সুন্দরবনে কয়লা ভিত্তিক প্রকল্প বন্ধের পক্ষে আছে বলে তিনি মনে করেন। ভারতীয় কয়লার মধ্য দিয়ে সুন্দরবন ধ্বংস হবে বলে তিনি মন্তব্য করেন। তিনি সরকারের বন্ধ ঘোষিত ১০টি প্রকল্পের সাথে রামপাল ও বাশখালী প্রকল্পও বাতিলের দাবী জানান। ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে এ প্রকল্পসহ সকল কয়লা ভিত্তিক তাপ বিদ্যুৎ প্রকল্প বন্ধ করা হবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

প্রকৌশলী ড. রনজিত সাহু বলেন, রামপাল কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রকে ২০১৩ সালে যে অনুমতি দেয়া হয়, তাই ছিল একটি ভুল সিদ্ধান্ত। কয়লা একটি পরিস্কার জ্বালানী এটি ভুল কথা। প্রচলিত যে ধরনেরই প্রযুক্তি ব্যবহার করা হউক না কেনো, কয়লা জ্বালানী পরিবেশ দূষন করবেই। এটাই বাস্তবতা। পরিবেশ ছাড়পত্রে সরকার বলেছে উন্নত মানের কয়লা ইন্দোনেশিয়া, অষ্ট্রেলিয়া কিংবা দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে আনা হবে। ভারতীয় কয়লা ব্যবহারের কথা উল্লেখ না থাকলেও এখন নিম্নমানের কয়লা সেখান থেকেই আনা হচ্ছে। ভারতীয় যে কয়লা আনা হচ্ছে তাতে অন্তত ৩০ ভাগ ছাই থাকার কথা উল্লেখ করে তিনি যে কয়লা আনা হচ্ছে তা পুড়ানো হলে তার তিনভাগের একভাগ সরাসরি বর্জ্যে পরিনত হবে। রামপাল কতৃপক্ষ দাবী করছে যে এখন ৪৫ হাজার টন নিম্নমানের কয়লা আ্না হচ্ছে কয়লা রাখার উঠান তৈরি করার জন্য। তার মানে পরিবেশ ছাড়পত্র বাংলাদেশের মানুষের সাথে মিথ্যাচার করেছে।

আল্ট্রা সুপার ক্রিটিকাল প্রযুক্তি একটি দূষণ কমায় না উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমাদের জানতে হবে যে, আলট্রা সুপার ক্রিটিকাল প্রযুক্তি মানে হচ্ছে, অধিক চাপে এবং তাপে কয়লা পুড়ানো হবে তাতে কয়লা ব্যাবহার কিছুটা কমবে এবং বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে, কিন্তু দুষনের সাথে এর কোনো সম্পর্ক নেই। এই প্রযুক্তির নাম ব্যবহার করে যে ধারনা দেওয়া হয়েছে সেটা মিথ্যা। এমনকি এই প্রযুক্তি ব্যবস্থাপনা অনেক ব্যয়বহুল এবং সময়ের সাথে সাথে এর কার্যকারিতা কমতে থাকে। এরজন্য অতিরিক্ত ব্যয় করতে হবে। না করা হলে দুষন আরো ব্রদ্ধি পাবে।

সংবাদ সম্মেলনের শুরুতে প্রাথমিক বক্তব্যে বাপার সাধারণ সম্পাদক শরীফ জামিল জাতিসঙ্ঘের বিশ্ব ঐতিহ্য কমিটির আসন্ন সভায় ২০১৭ ও ২০১৯ সালের সভায় গৃহীত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সমগ্র দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের একটি স্বাধীন, বিজ্ঞানভিত্তিক এবং অংশগ্রহণমূলক কৌশলগত পরিবেশ সমীক্ষা (এস ই এ) না করা পর্যন্ত যেকোন ভারী শিল্প নির্মাণ কাজ বন্ধ রাখার সুপারিশ পুনর্বহাল রাখার আহ্বান জানান। যদিও বাংলাদেশ সরকার তা মেনেছে বলে প্রতীয়মান হয়নি বলে তিনি স্যাটেলাইট ছবির মাধ্যমে তার প্রমাণ উপস্থাপন করেন। ভারতীয় কয়লার ব্যাবহার ও এস ই এ মূল্যায়নের জন্য ২০২১ সালের শেষে অথবা ২০২২ সালের শুরুতে একটি রিয়েক্টিভ মনিটরিং মিশন অনুমোদনের জন্যও আসন্ন বিশ্ব ঐতিহ্য কমিটির সভার প্রতি তিনি আহ্বান জানান।

আজকের সংবাদ সম্মেলন থেকে অবিলম্বে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ সকল কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বাতিল ও সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে কয়লা সহ সকল প্রকার বিপদজনক পণ্য পরিবহন বন্ধ করার দাবী জানানো হয়।