‌`মরা মাছেদের আবার মরে যাবার গল্প’

আপডেট: এপ্রিল ৪, ২০২৩
0

ডা জাকারিয়া চৌধুরী :

আমার অফিসে তিনটে ছোট ছোট কাঁচের জার আছে। লবন মেশানো পানিতে সেখানে বসবাস করে গোটা তিরিশেক ছোট মাছ। সেও যেন তেন মাছ না। দেশীয় শিং মাগুর মাছ। এইসব ‘জিয়ল’ আছ কখনোই এক দুই সপ্তাহের বেশি হাড়িতে বা জারে রাখা হয় না। কারন এরা বাচে না। শুরুতে এক সময় বিভিন্ন জাতের নানা পদের নাছ রাখতাম সেসব জার গুলোতে। সীমান্তের ট্রেন্সগুলোয় পাহাড়া দেয় লাল নীল সবুজ মাছেরা………। ভালোবাসার চোরাচালান ছাড়া কিছু নিষিদ্ধ হয়ে যাবে প্রিয়তমা—— শহীদ কাদরীর এই লাইনটা এদের সামনে এগিয়ে গিয়ে আবৃত্তি করবার চেষ্টা করতাম।আগে একই জারে নানান রঙ্গের মাছ রাখতাম। খেয়াল করলাম অক্সিজেন ফ্লো বন্ধ করে দেয়ার পরেও এরা কেমন দিব্বি বেঁচে আছে। যে মাছ পুকুরে বিলে সামান্য অক্সিজেন ঘাটতিতে মারা যায়, সে একই মাছ প্রায় অক্সিজেন বিহীন পরিবেশেও কেমন দিব্বি ভাল আছে। একটা সময় প্রায় সারাটাদিন এরা বিবাদে লিপ্ত থাকত। আমি বহুভাবে এদের বুঝিয়েছি, তোমাদের ছোট সংসারে আভ্যন্তরীণ বিবাদ তোমাদের পরিনতি নরকেরচেও করুন করে তুলতে পারে। তাঁরা আমার কথা বা বানীর মর্ম কথা বুঝেছিল কিনা জানিনা তবে দিন দুয়েক আর নতুন বিবাদের আলামত আমার চোখে পড়েনি। এক সন্ধ্যায়, হঠাৎ করেই যেন পরিবেশ নিস্তব্ধ আর ভারী হয়ে উঠেছিল। তাঁদের কলহ বন্ধ হয়ে যাওয়াতে তাঁদের প্রতি আমার মনোযোগও যেন কমে এসেছিল। মাঝে মাঝে কেবল মনে হয়েছে তাঁরা যেন অজানা কোনো গভীর এবং ধারাবাহিক কোন শোঁক পালনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। পরক্ষনেই মনে হয়েছে সব কিছুতেই আমার চিন্তার জগত বড় বেশি অস্বাভাবিক। ভ্রান্তি আর কল্পনা আমাকে কোথায় কোথায় নিয়ে যায় !!


শিশুকালে বলপয়েন্ট পেনের রিফিল কিনতে পাওয়া যেত। এখনো যায় হয়তো, আমি জানিনা। আমি আদিম মানুষ। বল পয়েন্টের আধুনিকতা আমাকে ধরে রাখতে পারেনি। আমি এখনো ফাউন্টেন পেন দিয়ে কাজ চালাই। কাজ আর কি !! হিজিবিজি হিজিবিজি !!! একদিন বিকেলে মায়ে’র হাত থেকে দু টাকা নিয়ে হাটে গেলাম কলমের রিফিল কিনতে। কলমের রিফিল নিয়ে বাড়ি ফিরছি। পথে উদাম সুমনের সাথে দেখা। সে দিঘীতে অবিরাম ডুবাডুবি করছে। ছোটো বড় সবাইকে ঘাড়ে ধরে ডুবিয়ে দিচ্ছে। পুরো দিঘীতে একটা ভয়ংকর পরিবেশ তৈরী হয়েছে। ছয়-সাত বছর বয়সী সুমনের সাথে ৩০ বছরের যুবকেরাও যুদ্ধ করে পারে না। সে আকাশে, বাতাসে অন্তরীক্ষে লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে উড়ে এসে এমন জোড়ে মানুষের নাকে মুখে কিক মারে যে, কারো নাক ভোতা হয়ে যায়। কারো পিঠের ছামড়া ছিলে ফেলে, মাথার চুল গাছি ধরে তুলে ফেলে…… এক কথায়, কেউ-ই তাকে দেখলে আর সুস্থ স্বাভাবিক আচরন করতে পারত না। যারা এরচেও ভারী বয়সের লোক, এরা সাধারনত কাবুলি আর লুংগি পরে বাজারে যেত। তাদের লুঙ্গি খুলে রাখা, কুকুর দিয়ে কামড়ে ফালি ফালি করে ফেলা ছিল সুমনের নিত্য কাজ। এছাড়া সুমন এলাকায় পা রাখলেই আশপাশের পাড়া গুলোতে যুদ্ধ প্রস্তুতি শুরু হয়ে যেত। আজ বা কাল, পাড়ায় পাড়ায় যুদ্ধ তো হতো-ই। ১২-১৫ সদস্যের এক কুকুর বাহিনী ছিল আমাদের। সুমন বাড়িতে আসলে সেই বাহিনীর নিয়ন্ত্রন চলে যেত সুমনের হাতে। সে যাকে চাইতো, তাকে-ই সাইজ করে ফেলত। ছাড় পেত কেবল টিপরা মেয়েরা। এরা ঘন জংগল থেকে নানান ফলমুল, আনাজ কিংবা কালো মুরগি ঝুড়ি ভর্তি করে ভারত থেকে নেমে আসতো। আমি একা দাঁড়িয়ে থাকতাম এই কালো মেয়েদের দেখার জন্যে। সামান্য এক চিলতে শাড়ি শরীরে এক প্যাঁচে যেভাবেই পড়ুক না কেন, তাদের দেহের রুপ ঠিকই ভেসে উঠত ! আমরা বলতাম- জংলী মেয়েরা বাজারে যায়। বিকেল হবার আগেই এরা ফিরতি পথ পথ ধরত। তারা বহুদুর হেঁটে বহু জংলি পথ পার হয়ে নিজ ঠিকানায় ফিরে যেত। এদেরকে আদর করে একটা পুটি শুটকি দিলে তারা পরদিন নিজ থেকেই দশটা কাঁঠাল দিয়ে যেত !! আমাদের শৈশব এত নাটকের পরেও ভালোবাসা আর শান্তির অপার সত্যতায় ভরা ছিল। কোনো এক বিচিত্র কারনে সুমনকে মানুষ ভালোবাসতো ! যে বা যারা এটা প্রমান করে ফেলতে পারতো, তারা ছিল নিরাপদ।


যা বলছিলাম, একদিন সকালে খেয়াল করলাম, লাল একটা গোল্ড ফিস মরে ভেসে রয়েছে। বিষয় কি ? এটা কি স্বাভাবিক মৃত্যু ? মাথার কাছে গভীর এই ক্ষত কিসের? আমার নানার স্বাভাবিক মৃত্যুর পরেও তাঁর মাথার পেছনে গভীর ক্ষত ছিল। এর পর দিন আরেকটা গোল্ড ফিস খুন হয়ে গেল। গোল্ড ফিসের মেমরি মাত্র ২ সেকেন্ড। এরা তাই খুনি মাছকে দেখলেও তাঁর খুনে স্বভাবকে মনে রাখতে পারেনা। অন্য গোল্ডফিস পুরো নাটকটা দেখলেও সেটা মনে রাখতে পারেনা। ঘটনা প্রত্যক্ষদর্শী হয়েও পরক্ষনেই খুনের বিষয়টা এদেরকে বেমালুম ভুলে যেতে হয়- এদের মেমরির স্থায়িত্বের অভাবে। এদের সাথে একটা কালো চাঁদা ছিল। খুবই সুন্দর। আমি ওটাকে কালো সিংহ বলে ডাকতাম। দুর্ভাগা কালো চাঁদা’টা খুব সম্ভবঃ খুনিকে ঠিক ঠিক চিনেছিল। রাতের আধারে সে জারের ফাইটার ফিসটাকে মেরে ফেলেছিল বলে সন্দেহ করি। কারন তৃতীয় দিন সকালে মরে ভেসে উঠল ডাকসাইটে সেই ফাইটার ফিস। বুঝলাম দু পক্ষের বিবাদে জড়িয়ে পড়েছে তৃতীয় কোন পক্ষ। দ্রুত সকল মাছকে বড় একটা গামলায় অবমুক্ত করে সকল জার, পানি সহ সব কিছু পরিস্কার করিয়ে তিন জারে তিন জাতের মাছকে রাখতে দিলাম। এরা সুখে ছিল সপ্তাহ খানেক। তারপর আবার একটা নির্দিষ্ট জারের মাছ ধরি মানুষ জাতের মাছ আভ্যন্তরীণ বিবাদে জড়িয়ে দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। দুটো বড় মাছ মিলে একটা ছোটো মাছকে সারাক্ষন ধাওয়া দিতে দিতে হয়রান করে ফেলছে। আমি অফিসের কাজ চালায় তুলে সারাটা দিন জারের দিকে তাকিয়ে রইলাম। দিনে দিনে ধাওয়া খাওয়া আতঙ্কিত মাছটা শুকিয়ে গেল, দু একটা করে আঁশ খুলে গেল। একদিন সকালে এসে দেখি এর লাশ পানিতে ভাসছে। অবশেষে তিলে তিলেই সে খুন হল তাহলে। ভাই তাহলে ভাইয়ের হাতেও নিরাপদ থাকতে পারল না ! বিষয়টা তো তা-ই !! নাকি ? পাঠান আর বাঙ্গালীরা ধর্মে মুসলিম হয়েও এক সাথে থাকতে পারবেনা বলেই তো আলাদা হবার কথা উঠেছিল। আলাদা হয়েও লাভ লোকসানের টালির খাতাটা দেখতে ইচ্ছে করে। কতটুকু লাভ হলো ! স্বাধীনতার মুক্তি আসলেই কতটুকু পেলাম- এমন চিন্তা আমার ভাবনায় থাকে। স্বাধীন হবার পরেও কি খুনের ধারাবাহিকতা থেমেছে এদেশে ? না, থামেনি। বেড়েছে। খুনের সংখ্যা যেমন বেড়েছে জ্যামিতিক হারে তেমনি লাশের মিছিল হয়েছে দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর। এখন আর পাঠানদের দোষে কি হবে ? আমাদের এইসব দিনরাত্রির খুন গুলো কি পাঠানেরা এসে করে যাচ্ছে ? নাকি নিজেরাই নিজেদের মেরে ফেলছি !!


যা বলছিলাম কমরেডস, মরা মাছটাকে টিস্যু পেপারে পেচিয়ে হসপিটাল বারান্দার একেবারে পশ্চিমাংশে লুকিয়ে রাখতে বলে দিলাম। যাকে বললাম সে আমার সহকারী। তাঁর কাজ সারাক্ষন আমার দিকে নজর রাখা, খাবার দেয়া, রোগীদের দেখভাল করা। এদেশে এখন হসপিটালে টানা লম্বা বারান্দা রাখার সিস্টেম চালু হয়েছে। একজন মোল্লা দিনে পাঁচবার এই বারান্দায় নামাজ পড়িয়ে যায়। এতে রোগী এবং এদের আত্মীয় স্বজনদের মনে বিশ্বাস জন্মে যে, এখানে কোন জোচ্চুরি হয়না। শিবির পরিচালিত হসপিটাল গুলো এ সিস্টেম চালু করে ব্যাপক মুনাফা করেছিল এক সময়। এখন ওরা নেই, আমরা তো আছি ! আছে তাদের রেখে যাওয়া সিলসিলা ! এ লাইনে এখন এক নাম্বারে আছে আওয়ামীলীগ পরিচালিত হসপিটালগুলো। ওরা সব কিছু-ই বেশি বেশি দেখাতে ভালোবাসে। তাই বেশি আয়োজনে নামাজ হয়। ভাবলাম যে কোন এক ওয়াক্ত নামাজের সময় মাছটাকে মিম্বারের সামনে রেখে দিতে পারলে মনকে শান্তনা দেব এই বলে যে- এর জানাজা হয়েছে। যে মাছ আমাকে এতদিন বিনোদন দিয়েছে তাকে জানাজা পড়িয়ে আনা আমার নৈতিক দায়িত্বের অংশ মনে করেছি।


তারপর ? তারপর শবে পেঁচানো মাছটাকে কম্প্রেসর মেশিনের উপর রেখে সেদিনের মত বিদেয় নেই। পরদিন সকালে এসে দেখি গরমে সেটি ভাজাভাজা মুড়ির মত হয়ে গেছে। একজম ক্রিসপি চিপস। মেয়েটাকে বললাম, দেখুন তো এটি গুড়া গুড়া হয় কিনা। সে হাঁতে নিয়ে চাপ দিতেই পাউডার। বললাম, এগুলোকে গঙ্গা জ্বলে ছিটিয়ে দিন। কথামত সে মাছের গুড়োগুলো একই গোত্রের মাছের জারে ছিটিয়ে দিল। দেখলাম খুব অল্প সময়ের মধ্যেই এর-ই এক সময়ের ভাই বেরাদরেরা প্রোটিনের এই গুড়া গুলো খেয়ে সাবার করে ফেলল। বুঝলাম আজন্মই এরা ভ্রাতৃঘাতী। এদের হাঁতে মরা লাশেরও ক্ষমা নেই। আপনকে খেয়ে ফেলতেও এদের দ্বিধা হয় না। এরা গোল্ড ফিস নয় ! এরা দেশীয় জাতের শিং মাছের পোনা। বিদেশী গোল্ডী কিংবা ফাইটার ফিস হলে না হয় অজাত বলে গাল দেয়া যেত ! নিজেদেরকে কি বলে গাল দেব ? এরা কি এটুকুও জানে না, যেখানেই ভ্রাতৃ ঘাতী রক্তের প্রবাহ ঘটে সেখানে এই বংশের ইতিহাস রচনা হয়ে যায়? এই বংশ ধ্বংস হয়ে যায়। এটি কি আমার কথা? না, এটি ইতিহাসের কথা।

০৩.০৪.২০২৩ ইং

লেখক, রাজনৈতিক, কলামিস্ট, কবি ,চিকিৎসক