মহিলা পরিষদের উদ্যোগে অনলাইনে জাতীয় পরিষদ সভা অনুষ্ঠিত

আপডেট: এপ্রিল ১, ২০২১
0

কোভিড-১৯ এর চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করি, নারী আন্দোলনকে অগ্রসর করি’- এই শ্লোগানকে সামনে রেখে আজ ৩১ মার্চ ২০২১ বিকাল ০৩:০০ টায় বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির উদ্যোগে অনলাইনে জাতীয় পরিষদ সভার উদ্বোধনী অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন সংগঠনের সভাপতি ডা. ফওজিয়া মোসলেম। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু। বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ সুইডেন দূতাবাসের চার্জ ডি অ্যাফেয়ার্সের হেড অব ডেভেলপমেন্ট কো-অপারেশন মিস ক্রিস্টিন জোহানসন এবং ইউ এন উইমেনের দেশীয় প্রতিনিধি শোকো ইশিকাওয়া।

উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের শুরুতে জাতীয় সংগীত পরিবেশন করেন সায়কা ইমাম শান্তা ও তার দল। এরপর জাতীয় পতাকা ও সংগঠনের পতাকা প্রদর্শন করা হয়। সভায় সংগঠনের প্রয়াত সভাপতি আয়শা খানমের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বিশেষ শোক প্রস্তাব পাঠ করেন কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভাপতি ডা. মাখদুমা নার্গিস রতœা; এছাড়াও যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক রাখী দাশ পুরকায়স্থ, কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য রাশিদা আক্তার, শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিষয়ক সম্পাদক বুলা ওসমান, গণমাধ্যম সম্পাদক দিল মনোয়ারা মনু মৃত্যুতে তাদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে শোক প্রস্তাব পাঠ করেন ডা. রওশন আরা বেগম। পাশাপাশি সভায় দেশ ও দেশের বাইরে বিশিষ্টজনের (শিক্ষাবিদ, রাজনীতিবিদ, তথ্যপ্রযুক্তিবিদ,সাংবাদিক, মিডিয়া ব্যক্তিত্ব, সংগঠনের সদস্য) মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করা হয়।

স্বাগত বক্তব্যে সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে সকলকে শুভেচ্ছা জানিয়ে বলেন যেকোনো সংকট নারীর জীবনে ভিন্ন অভিঘাত সৃষ্টি করে। করোনা মহামারীর সময়ে পুরুষের পাশাপাশি অনেক নারী কাজ হারিয়েছে, ঘরে থেকে অনেক নারী ও শিশু সহিংসতার শিকার হয়েছে। শিক্ষাসহ প্রায় সকলদিকের নেতিবাচক প্রভাব যে নারী ও কন্যার উপর পরিলক্ষিত হয়েছে সেটি উল্লেখ করে তিনি নারী ও কন্যার শিশুর সুরক্ষার জন্য বিশেষ গুরুত্ব দেয়ার কথা বলেন। এসময় তিনি করোনাকালীন সময়ে নারী ও কন্যার স্বাস্থ্যগত ও আইনী সেবা দেয়ার জন্য সংগঠনের গৃহীত পদক্ষেপের তথা তুলে ধরেন। এসময় তিনি আরো বলেন নানা অগ্রগতি হলেও জেন্ডার সমতা এখনো চ্যালেঞ্জের মুখে আছে। ৫০ বছরে দীর্ঘ সংগ্রামের ফলে, সরকারি-বেসরকারি প্রচেষ্টার ফলে, নারীদের অবদানে দেশের অনেক উন্নতি হয়েছে তবে জেন্ডার সমতা নিশ্চিত করতে হলে মৌলিক কতগুলো চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে। পাশাপাশি তিনি অর্জনসমূহকে টিকিয়ে রাখার জন্য স্থানীয় থেকে বৈশ্বিক পর্যায় এবং সরকার থেকে বৃহত্তর সমাজকে উদ্যোগ গ্রহণ করার জন্য আহ্বান জানিয়ে বক্তব্য শেষ করেন।

বিশেষ অতিথির বক্তব্যে ইউ এন উইমেনের দেশীয় প্রতিনিধি শোকো ইশিকাওয়া অভিনন্দন জানিয়ে বলেন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের জাতীয় পরিষদ সভা অত্যন্ত গুরত্বপূর্ণ সময়ে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে যখন সম্প্রতি মেক্সিকোতে জেনারেশন ইকুয়ালিটি ফোরাম অনুষ্ঠিত হলো অনলাইনে। এই ফোরামের মাধ্যমে বিভিন্ন সদস্য রাষ্ট্রের প্রতিনিধি,নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি, তরুণ প্রজন্ম সকলে একই প্ল্যাটফর্মে যুক্ত হতে পেরেছিলেন

। এসময় তিনি বেইজিং সম্মেলনের প্রেক্ষাপট তুলে ধরে বলেন ২৬ বছর আগে নারী ও কন্যার অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বেইজিং প্ল্যাটফরম ফর একশন গৃহীত হয়। বেইজিং সম্মেলনের লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়নে প্রতিটি দেশ কাজ করে যাচ্ছে এবং এর পর্যালোচনায় এসে দেখা যাচ্ছে নারীর জীবনে অনেক অগ্রগতি হলেও কোভিড পরিস্থিতি সমস্ত অগ্রগতিকে স্থবির করে দিয়েছে। নারীর প্রতি সহিংসতা বেড়েছে, শ্রমশক্তিতে নারীর অংশগ্রহণ কমেছে। নারীর প্রতি সমাজের প্রচলিত বৈষম্যমূলক দৃষ্টিভঙ্গি এখনো প্রচলিত আছে। সম্প্রতি অনলাইনে অনুষ্ঠিত কমিশন অন দ্য স্ট্যটাস অফ উইমেন এর ৬৫ তম অধিবেশনে মহিলা পরিষদের পক্ষ থেকে অধিক সংখ্যক তরুণ প্রজন্মের অংশগ্রহণের বিষয়টি উল্লেখ করে তিনি বলেন ইকোসকের স্ট্যটাসভূক্ত সংগঠন মহিলা পরিষদের অধিক সংখ্যক তরুণ প্রজন্মের অংশগ্রহণ নারীর মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের জন্য এবং নারীবাদ চর্চার জন্য বেশ ইতিবাচক বার্তা বহন করে। তরূণদের এই অংশগ্রহণ নারী আন্দোলনকে আরো শক্তিশালী করবে ।

তিনি আরো বলেন নারীর প্রতি চলমান সহিংসতা প্রতিরোধে, চলমান বৈষম্যমূলক দৃষ্টিভঙ্গি দূর করে জেন্ডার সমতা প্রতিষ্ঠায় ইউএন এবং ইউএন উইমেন বাংলাদেশ সহ অন্যান্য দেশে কাজ করছে। বাংলাদেশ সরকার এবং মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় এলক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে, সম্পদের বরাদ্দ রেখেছে। তবে বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনা করে সম্পদের পুণ:বন্টন নিশ্চিত করতে এবং নীতিমালা সমূহ বাস্তবায়নে গুরুত্ব দেয়ার জন্য তিনি গুরুত্বরোপ করেন।

বিশেষ অতিথির বক্তব্যে বাংলাদেশ সুইডেন দূতাবাসের চার্জ ডি অ্যাফেয়ার্সের হেড অব ডেভেলপমেন্ট কো-অপারেশন মিস ক্রিস্টিন জোহানসন জাতীয় পরিষদ সভা আয়োজনের জন্য সংগঠনকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানান। এসময় তিনি জাতীয় পরিষদ সভার শ্লোগান তুলে ধরে বলেন গণতান্ত্রিককতা চর্চার প্রেক্ষাপট পরিবর্তন হচ্ছে প্রতিনিয়ত। এই পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে নারী ও কন্যার মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় ক্ষেত্রে। নারীর মানবাধিকার কে সুরক্ষা করতে হবে, মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আমাদের আরো কাজ করতে হবে।

কোভিড মহামারীর কারণে নারী ও কন্যাদের অধিকার বঞ্চিত হতে দেখা যাচ্ছে। জেন্ডার ভিত্তিক সহিংসতাসহ যৌন সহিংসতার বিষয়টি এক্ষেত্রে নতুন উদ্বেগের সৃষ্টি করছে। সম্ভবত এটাই জেন্ডার সমতা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বাধা হিসেবে কাজ করছে। তিনি আরো বলেন বাল্যবিবাহের হার কমে গেলেও কোভিড মহামারীর কারণে সম্প্রতি বাল্যবিবাহের হার বৃৃদ্ধি পেয়েছে ্ বাল্যবিবাহ একই সাথে কন্যাদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যকে ঝুঁকির মুখে ফেলে দিয়েছে। বাল্যবিবাহ রোধের পাশাপাশি অন্যান্য দিকের পরিবর্তনে যেমন সবার জন্য সমান ন্যায়বিচার প্রাপ্তির সুযোগ নিশ্চিত করা, কাজে সমান সুযোগ সৃষ্টি করা এবং সকল বৈষম্যমূলক রীতিনীতির চর্চা বন্ধে আরো কাজ করার আহবান জানান। তিনি আরো বলেন নারীর মানবাধিকার, জেন্ডার সমতা প্রতিষ্ঠায় সুইডেন সরকার কাজ করে যাচ্ছে।

সভাপতির বক্তব্যে সংগঠনের সভাপতি ডা. ফওজিয়া মোসলেম বলেন ৫০ বছরে নারীর অবস্থায় অনেক পরিবর্তন হয়েছে। নারীর যে প্রচলিত ইমেজ তা থেকে নারীকে এখনও বের করতে পারিনি। তার ইমেজ হবে সে পরিবারের-সমাজে একজন দায়িত্ববান ব্যক্তিত্ব, এটি প্রতিষ্ঠা করতে হবে। নারীদের মাঝে জাগরণ হয়েছে একে আত্মপরিচয়ের দিকে এগিয়ে নিতে হবে। বিভিন্ন পেশার নারীরা তাদের যোগ্যতার পরিচয় দিয়েছে। নারীরা যত নেতৃত্বের দিকে এগিয়ে যাবে, তত সমাজে তাদের গ্রহণযোগ্যতা বাড়বে। সাম্প্রতিক সময়ে নারীর অগ্রগতি হয়েছে, তবে নারীর প্রতি সহিংসতা বৃদ্ধি আমাদের উদ্বিগ্ন করে।এর জন্য বিচারহীনতার সংস্কৃতি, সুষ্ঠু জবাবদিহিতার অভাব, দূনীতি এবং সাম্প্রদায়িক সহিংসতা সমস্ত কিছুর নেতিবাচক প্রভাব দেখা যাচ্ছে নারীদের উপর। এখন চ্যালেঞ্জ কেবল নারীর মানবাধিকার নিয়ে নয় বরং মানবতা প্রতিষ্ঠার দিকে। এই চ্যালেঞ্জ দূর করতে সকলকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার আহ্বান জানান।

উদ্বোধনী অনুষ্ঠান শেষে ১ম কর্ম অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। অধিবেশনে সাংগঠনিক শোক প্রস্তাব (২০১৯-২০২০) পাঠ করেন সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য এবং ঢাকা মহানগর কমিটির সাধারণ সম্পাদক রেহানা ইউনূস। কেন্দ্রীয় কমিটির কার্য বিবরণী পেশ করেন সংগঠনের সহ-সাধারণ সম্পাদক অ্যাড. মাসুদা রেহানা বেগম; সাধারণ সম্পাদকের সংক্ষিপ্ত প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু; কেন্দ্রীয় কমিটি আয় ব্যয়ের হিসাব উপস্থাপন করেন অর্থ সম্পাদক দিল আফরোজ বেগম।

১ম কর্ম অধিবেশন শেষে ২য় কর্ম অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। ২য় অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভাপতি রেখা চৌধুরী।উক্ত অধিবেশনে ৩ট কমিশনের মাধ্যমে বিষয়ভিত্তিক আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। ১ম কমিশনে কোভিড অভিঘাত মোকাবেলায়ঃ সংগঠনের বাস্তব কাজের ধারা ও সংগঠকের দক্ষতা বিষয়ে আলোচনা করেন সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সীমা মোসলেম; মডারেটর ছিলেন সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভাপতি ফেরদৌস আরা মাহমুদা হেলেন; সহযোগিতায় ছিলেন কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হোমায়রা খানম এবং সিনিয়র প্রশিক্ষণ ও গবেষণা কর্মকর্তা শাহজাদী শামীমা আফজালী; র‌্যাপোর্টিয়ার ছিলেন সংগঠনের রংপুর জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক রুম্মানা জামান। ২য় কমিশনে নারী ও কন্যার প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধ আন্দোলনঃ পর্যালোচনা ও করনীয় বিষয়ে আলোচনা করেন সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটির সহ সাধারণ সম্পাদক অ্যাড. মাসুদা রেহানা বেগম।

মডারেটর ছিলেন সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভাপতি লক্ষী চক্রবর্তী; সহযোগিতায় ছিলেন প্রশিক্ষণ ও গবেষণা কর্মকর্তা সালেহা বানু এবং লাইব্রেরিয়ান ও ডকুমেন্টালিস্ট জিনাত আরা; র‌্যাপোর্টিয়ার ছিলেন সংগঠনের দিনাজপুর জেলা শাখার প্রশিক্ষণ, গবেষণা ও পাঠাগার উপপরিষদ সম্পাদকরুবি আফরোজ। ৩নং কমিশনে নারী নেতৃত্বের পূর্ণ বিকাশঃ সমতাপূর্ণ সমাজ ও রাষ্ট্র নির্মাণ বিষয়ে আলোচনা করেন সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু; মডারেটর ছিলেন সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভাপতি ডা. মাখদুমা নার্গিস; সহযোগিতায় ছিলেন সংগঠনের সিনিয়র আইনজীবি দীপ্তি রাণী শিকদার ও গবেষণা কর্মকর্তা আফরুজা আরমান; র‌্যাপোর্টিয়ার ছিলেন সংগঠনের ব্রাক্ষণবাড়িয়া জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক সাথী চৌধুরী

আলোচনা শেষে দলীয় কাজ অনুষ্ঠিত হয়। দলীয়কাজে কেন্দ্রীয় ও জেলার শাখার সদস্যবৃন্দ অংশগ্রহণ করেন।
সভার সঞ্চালনায় ছিলেন সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক উম্মে সালমা বেগম। অনলাইন সভায় মোট উপস্থিত ছিলেন ৩৫০ জন।