মিয়াঁ মুসলিমদের জন্য সবজি ,তরিতরকারির দাম বেড়েছে —–মন্তব্য আসাম মূখ্যমন্ত্রীর

আপডেট: জুলাই ১৭, ২০২৩
0

ভারতের উত্তরপূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য আসামে আরো একবার চরম সাম্প্রদায়িক মন্তব্য করে তরিতরকারি বা ফলমূলের মূল্যবৃদ্ধির জন্য ‘মিয়াঁ মুসলিমদের’ দায়ী করেছেন মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মা।

রাজধানী গুয়াহাটিতে সব্জির দাম কেন আকাশ ছুঁয়েছে, সাংবাদিকদের এই প্রশ্নের জবাবে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘কারা এই তরিতরকারির দাম বাড়িয়েছে, সেটা তো দেখুন! এরা সবাই হলো মিঁয়া সব্জিওয়ালা, যারা এত বেশি বেশি দাম নিচ্ছে।’

আসামের বাংলা ভাষাভাষী মুসলিম সম্প্রদায়কে বোঝাতেই এই ‘মিঁয়া’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়।

যদিও ‘মিঁয়া’ শব্দটি বেশ অবমাননামূচক অর্থেই প্রয়োগ করা হয়ে থাকে, তবে রাজ্যের বাঙালি মুসলিমরা ইদানীং নিজেদের পরিচয় ব্যক্ত করতে তাদের প্রতিবাদের ভাষা হিসেবেই এই শব্দটিকে গ্রহণ করে নিয়েছেন।

গত কয়েক বছরের মধ্যে এ কারণেই আসামের বাঙালি মুসলিমরা ‘মিঁয়াকাব্য’ নাম দিয়ে সাহিত্যচর্চা শুরু করেছেন, এমনকি তাদের নিজস্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য তুলে ধরতে একটি ‘মিঁয়া মিউজিয়াম’ খোলারও চেষ্টা হয়েছে।

কিন্তু আসামে ক্ষমতাসীন বিজেপি সরকার যে এই ‘মিঁয়া’দের আসামের অংশ হিসেবে মনে করে না, মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মা সেটা বারবারেই বুঝিয়ে দিয়েছেন।

তরিতরকারির দাম নিয়ে তার সাম্প্রতিক মন্তব্য এই তালিকাতেই সর্বশেষ সংযোজন। বিবিসি হিন্দি বিভাগই মুখ্যমন্ত্রীর এই বিতর্কিত মন্তব্য সর্বপ্রথম রিপোর্ট করেছে।

মুখ্যমন্ত্রী ওই দিন আরো দাবি করেছেন, গুয়াহাটিতে সব্জিওলারা ‘মিঁয়া’ বলেই তারা অসমিয়াঁদের থেকে এত বেশি দাম নিচ্ছেন, অসমিয়াঁরাও যদি সব্জি বেঁচতেন, তাহলে কখনোই এত দাম নিতেন না।

ঠিক কী বলেছেন হিমন্ত?
দিন কয়েক আগে অল ইন্ডিয়া ইউনাইটেড ডেমোক্র্যাটিক ফ্রন্টের নেতা ও ধুবড়ি থেকে নির্বাচিত লোকসভা এমপি বদরুদ্দিন আজমল বলেছিলেন, ‘মিঁয়া সম্প্রদায়কে ছাড়া আসাম অসম্পূর্ণ।’

সংবাদমাধ্যমের কাছে ওই প্রসঙ্গ টেনে এনে আসামের মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘এই ধরনের মন্তব্য করে বদরুদ্দিন আজমল আসলে অসমিয়া সম্প্রদায়কেই অপমান করেছেন।’

বস্তুত মিঁয়া মুসলিমদের তিনি যে আসামের অংশই মনে করেন না, সেটা বোঝাতে হিমন্ত বিশ্বশর্মা কোনো রাখঢাকই করেননি।

এরপরই যখন তার কাছে তরিতরকারির অগ্নিমূল্য নিয়ে জানতে চাওয়া হয়, তিনি সরাসরি তার দায় চাপিয়ে দেন ‘মিঁয়া’ সব্জিওলাদের ওপর। বলেন, এই মিঁয়া মুসলিমরাই বেশি বেশি দাম নিচ্ছেন।

মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘গ্রামের দিকে তরিতরকারির দাম বেশ কম। অথচ গুয়াহাটিতে এই মিঁয়ারা অসমিয়াদের থেকে চড়া দাম হাঁকছেন। আজ যদি অসমিয়ারা সব্জি বেঁচতেন, তাহলে সহ-নাগরিক অসমিয়াদের থেকে কখনোই বেশি দাম নিতেন না।’

গুয়াহাটি শহরে বিভিন্ন ফ্লাইওভারের নিচে অস্থায়ী সব দোকান থেকে মিঁয়ারা যে সব্জি ও ফলমূল বেঁচেন, তিনি নিজে তদারকি করে সেগুলো উচ্ছেদের ব্যবস্থা করবেন বলেও জানান হিমন্ত বিশ্বশর্মা।

তিনি বলেন, ‘এতে করে আমাদের ‘অসমিদেয়া ছেলে’দের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হবে।’

গত মাসে বকরি ঈদের সময় গুয়াহাটিতে গণপরিবহন ব্যবস্থা যে ভেঙে পড়েছিল, তার জন্যও তিনি মুসলিম গাড়ি-চালকদের দায়ী করেন।

তিনি বলেন, ‘আমরা সবাই দেখেছি ঈদের সময় গুয়াহাটিতে বাস চলাচল কিভাবে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। রাস্তায় ভিড়ভাট্টাও একদম ছিল না।’

এর কারণ হিসেবে তিনি বলেন, আশি শতাংশ বাস-চালক ও সত্তর শতাংশ উবার-ওলার মতো ক্যাব ড্রাইভাররা সবাই ‘মিঁয়া’ বলেই ওই অবস্থা হয়েছিল।

মুখ্যমন্ত্রী বুঝিয়ে দেন, সরকার চায়, ‘অসমিয়া যুবক’রাই এই ধরনের কাজে আরো বেশি করে এগিয়ে আসুক, যেন মুসলিমদের ধর্মীয় উৎসবের সময় রাজধানী আবার অচল না-হয়ে পড়ে।

ওয়াইসি, আজমলের প্রতিবাদ
হিমন্ত বিশ্বশর্মার ওই বিতর্কিত মন্তব্যের তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছেন দেশের শীর্ষস্থানীয় মুসলিম রাজনীতিবিদরা। তারা অভিযোগ করছেন, মুখ্যমন্ত্রী আসলে আসামে বিভাজনের রাজনীতি করছেন।

হায়দ্রাবাদের এমপি তথা এআইএমআইএম নেতা আসাদউদ্দিন ওয়াইসি টুইট করেছেন, ‘ভারতে একদল লোক আছেন, যারা তাদের বাড়িতে মোষ দুধ না-দিলে বা মুরগি ডিম না-পাড়লেও মিঁয়াদের দায়ী করে থাকেন।’

সেই সাথেই মিশরে বা সংযুক্ত আরব আমিরাতে প্রধানমন্ত্রী মোদির সাম্প্রতিক সফরের দিকে ইঙ্গিত করে তিনি পরামর্শ দিয়েছেন, ‘আজকাল তো মোদিজির সাথে বিদেশী মুসলিমদের খুব দোস্তি, তো ওদেরকেই বলুন না টমেটো, আলু, পালংশাক পাঠাতে!’

এআইইউডিএফ নেতা বদরুদ্দিন আজমল আবার প্রশ্ন তুলেছেন, ‘মুখ্যমন্ত্রী গুয়াহাটিকে মিঁয়া-মুক্ত করার কথা বলছেন, ওখানে তাদের শাকসব্জি বেঁচতে দেবেন না বলে ঘোষণা করছেন। একটি রাজ্য সরকারের প্রধান কিভাবে এ ধরনের কথা বলতে পারেন?’

মুখ্যমন্ত্রীর এই ‘বিভেদমূলক বক্তব্যে’র কারণে যদি ‘অসমিয়া ভাই’ আর মুসলিমদের মধ্যে ‘কোনো ঘটনা ঘটে যায়’, তাহলে হিমন্ত বিশ্বশর্মাই সরাসরি তার জন্য দায়ী থাকবেন বলেও হুঁশিয়ারি দেন আজমল।

শাকসব্জির দাম মিঁয়ারা বাড়াননি বলেও দাবি করেন তিনি। একইসাথে বলেন, ‘অসমিয়া যুবকরা এই পেশায় আসুক, এটা তো খুব ভালো প্রস্তাব।’

বদরুদ্দিন আজমল মন্তব্য করেন, ‘কিন্তু তারা কি চাষবাস করতে পারবে? যে ধরনের কঠিন পরিশ্রম এতে লাগে, আমার তো মনে হয় না অসমিয়ারা তা পারবে বলে!’

বরপেটার কংগ্রেস এমপি আবদুল খালেক এ প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘আসামে সাম্প্রতিক ও জাতিগত দাঙ্গা বাঁধানোর জন্য মুখ্যমন্ত্রী নিজেই ক্রমাগত উসকানি দিয়ে চলেছেন!’

মিঁয়া মুসলিমদের বিরুদ্ধে হিমন্ত বিশ্বশর্মার এ ধরনের প্রকাশ্য আক্রমণ অবশ্য কোনো নতুন ঘটনা নয়।

গত বছর রাজ্যের গোয়ালপাড়া জেলায় মিঁয়াদের একটি নিজস্ব সংগ্রহশালা উদ্বোধনের দু’দিনের ভেতরেই আসাম সরকার সেটি সিল করে দেয় এবং তার প্রধান উদ্যোক্তা, অল আসাম মিঁয়া পরিষদের প্রেসিডেন্ট মোহর আলিকে গ্রেফতার করে।

হিমন্ত বিশ্বশর্মা তখন বলেছিলেন, ‘চাষের লাঙলকে কিভাবে মিঁয়ারা নিজেদের আইডেন্টিটি হিসেবে দাবি করতে পারে? এক লুঙ্গি ছাড়া আর কোনওটাই তাদের নিজেদের জিনিস নয়!’

সূত্র : বিবিসি