রাষ্ট্রই দেশের নদ-নদী ধ্বংস করছে : তিস্তা প্রকল্পে অর্থ লুট হচ্ছে -বাপার সভায় বিশেষজ্ঞরা

আপডেট: এপ্রিল ২২, ২০২১
0

বিশ্ব ধরিত্রী দিবস-২০২১ উপলক্ষ্যে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) ও বাংলাদেশ পরিবেশ নেটওয়ার্ক (বেন)-এর যৌথ উদ্যোগে আজ “বাংলাদেশের নদী ব্যবস্থাপনা: কোন পথে সরকার?” বিষয়ক এক বিশেষ ওয়েবিনার ‘জুম’ প্লাটফর্র্মের মাধ্যমে অনুষ্ঠিত হয়।

বাপা’র সহ-সভাপতি ও বেন এর প্রতিষ্ঠাতা ড. নজরুল ইসলাম এর সভাপতিত্বে এবং বাপা’র সাধারণ সম্পাদক, শরীফ জামিল এর সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে মূল বক্তব্য উপস্থাপন করেন ড. মোঃ খালেকুজ্জামান, অধ্যাপক, লকহ্যাভেন বিশ্ববিদ্যালয় পেনসিলভেনিয়া, যুক্তরাষ্ট্র। নির্দ্ধরিত আলোচক হিসেবে উপস্থিত থেকে বক্তব্য রাখেন সুলতানা কামাল, সভাপতি, বাপা, অধ্যাপক এম ফিরোজ আহমেদ, সহ-সভাপতি, বাপা, ডা. মো: আব্দুল মতিন, নির্বাহী সহ-সভাপতি, বাপা, ড. মুজিবুর রহমান হাওলাদার, সাবেক চেয়ারম্যান, জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন, শারমীন মুরশিদ, সদস্য, জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন এবং ফরিদুল ইসলাম ফরিদ, সভাপতি, তিস্তা রক্ষা সংগ্রাম কমিটি। এতে অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য রাখেন সাইফুল পাইকার, বাপা নির্বাহী সদস্য এম এস সিদ্দিকী, জিয়াউর রহমান ও রফিকুল আলম ।

মূল বক্তব্যে ড. মোঃ খালেকুজ্জামান বলেন, দেশের নদ-নদীর সংখ্যার কোন সঠিক হিসাব সরকারের কাছে নাই। তিনি বলেন দেশে যে এতোগুলো পোল্ডার করা হলো তাতে কি বন্যা নিয়ন্ত্রণ হয়েছে? দেশে বিভিন্ন ধরনের বাধ দিয়ে বন্যা নিয়ন্ত্রণের পুরানো ধারনা নীতি নীর্ধারকদের মাথা থেকে এখনও যায়নি। তিনি বলেন বাংলাদেশ এখনও পানির ন্যায্য হিস্যা পাচ্ছে না। তিনি দেশের নদী ব্যবস্থাপনার বিধানগুলোতে অনেক সমস্য আছে উল্লেখ করে বলেন, পানি ব্যবস্থাপনাসহ অন্যান্য বৃহৎ কর্মকান্ডের বেরায় প্রকল্প ক্ষতিগ্রস্থ হলেও সংশ্লিষ্ট কতৃপক্ষের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া বা মামলা করার বিধান রাখা হয় নাই বলে উল্লেখ করে বলেন, যার ফলে প্রকল্পগুলো বারবার ক্ষতির সম্মূখিন হচ্ছে। ভারত ব্রক্ষ্রপুত্র এবং মেঘনা নদী নিয়ে যে প্রকল্প হাতে নিয়েছে তা হবে বাংলার জনগনের জন্য ক্ষতিকর। তিনি সরকারের কাছে প্রশ্ন করেন তিস্তাসহ দেশের অন্যান্য নদীগুলোকে কেন সরু করা হচ্ছে?, চায়না পাওয়ার কোম্পানি কিভাবে নদী বিশেষজ্ঞ বনে গেল?, দেশের সব মেগা প্রকল্পের বিষয়ে দেশের মানুষকে কেন জানানো হয় না বা তাদের মতামত নেয়া হয় ন?। যেহেতু হাইকোর্ট নদীকে জীবন্ত স্বত্ত্বা বলে ঘোষণা করেছেন সেতেু কেন এবং কিভাবে জীবন্ত নদীর হাত পা কেটে পঙ্গু করা হচ্ছে?, তাহ’লে হাইকোর্টের রায়কে কি প্রশ্নবিদ্ধ করা হচ্ছে না?। তিনি তিস্তা প্রকল্পকে বিজ্ঞান ভিত্তিক নয় বলে মন্তব্য করেন। ড. মোঃ খালেকুজ্জামান বিলিয়ন ডলারের চায়না তিস্তা প্রকল্পের ঊওঅ ও ঝওঅ সহ সম্ভাব্যতা জরিপের বিস্তারিত জনসম্মুখে প্রকাশের দাবী করেন।

ড. নজরুল ইসলাম বলেন, দেশে কোন পরিকল্পিত উন্নয়ন হচ্ছে না। সব প্রকল্পই হচ্ছে কেবল অপরিকল্পিত ও লুটেরা প্রকল্প। মুষ্টিমেয় কিছু স্বার্থান্বেষী ব্যক্তি, ব্যবসায়ী, আমলা ও টেকনোক্র্যাটদের কারণে দেশের সাধারণ জনগনের মতামত ও অধিকার উপেক্ষিত হচ্ছে বারবার। তিনি সরকারের প্রতি দেশের সব ধরণের প্রকল্পে স্বচ্ছতা, জনগনের অংশগ্রহণ এবং প্রকল্পের ব্যয় বরাদ্দ বিষয়ে জনগনকে জানানোর দাবী জানান। তিনি কক্সবাজারের কোহেলিয়া, উত্তরবঙ্গের তিস্তা সহ দেশের অন্যান্য নদ-নদী সংশ্লিষ্ট সরকারের সব মেগা প্রকল্পে জনগনের সরাসরি সম্পৃক্ততা ও তাদের মতামত গ্রহণের দাবী জানান।

সুলতানা কামাল বলেন, দেশের সম্পদ বিভিন্ন প্রকল্পের নামে ব্যবহার করা হচ্ছে জনগনের মতামতের কোনরকম তোয়াক্কা না করেই। কিন্তু এটি জনগনের সম্পদ এ সম্পদ ব্যবহারের আগে জনগনের মতামতের প্রয়োজন। সরকার দেশের নদী এবং পরিবেশকে বিভিন্ন প্রকল্পের নামে ধ্বংস করেই চলছে। যা কোন ভাবেই কাম্য নয়। সরকারের এ ধরনের প্রকল্পের মধ্যে সততা নেই বলইে চলে। তিনি নাগরিকবোধ থেকেই আমাদের আরো বেশী শক্তিশালী হয়ে পরিবেশ আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানান।

অধ্যাপক এম ফিরোজ আহমেদ, বলেন দেশের নদ-নদী নিয়ে তথ্যগত অনেক ঘাটতি রয়েছে। বাংলাদেশে কি পরিমাণ পানি আসে এবং যায় তার কোন সঠিক হিসেব নেই। দেশের পলি নিয়ে অনেক রিচার্স হয়েছে অনেক অর্থও ব্যয় হয়েছে কিন্তু যৌক্তিক কোন ব্যখ্যা পাওয়া যায়নি। তিনি আরো বলেন ডিপ চ্যানেল করলে ২-৩ বছরের মধ্যেই তা বন্ধ হয়ে যাবে। দেশের নদী সমস্যা সমাধানে যে পরিমাণ অর্থ ব্যয় হবে তা দেশের ভবিষ্যত প্রজম্মের উপর বিরুপ প্রভাব ফেলবে। বিজ্ঞান ভিত্তিক গবেষণা ছাড়া কোন প্রকল্প গ্রহন করা ঠিক হবে না বলেও তিনি মন্তব্য করেন।

ড. মুজিবুর রহমান হাওলাদার, দেশের নদ-নদী দূষণের মাত্রা চরম পর্যায়ে ঠেকেছে বলেন মনে করেন, নদীর তীরের অবস্থা আরো করুন। তিনি বলেন এ ধরনের অনুষ্ঠানে সরকারের পরিবেশ, নদী ও পানির সংগে সংশ্লিষ্ট কতৃপক্ষের আসা উচিত ছিল। বর্তমানে নদী ব্যবস্থাপনার কোন আইনই কাজে আসছে না, আইনের ব্যক্তয় ঘটিয়ে কোন উন্নয়নই করা যাবে না বলে তিনি মন্তব্য করেন। তিনি এ বিষয়ে গৃহীত মাষ্টার প্লান নিয়ে সরকারের সংশ্লিষ্ট নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে আলোচনার উদ্যোগ নিতে পরামর্শ দেন।

ডা: মো: আব্দুল মতিন বলেন, রাজধানীর নদীগুলোকেই সরকার ঠিক করতে পারছে না তা’হলে সারাদেশের নদীগুলোকে কিভাবে রক্ষা করবে?। সরকার অনেকটা কম্প্রোমাইজ করে চলছে বলেই নদীগুলো উদ্ধার করতে পারছেনা বলে তিনি মন্তব্য করেন। তিনি সবাইকে নদী ও পরিবেশ নিয়ে জোরদার আন্দোলনের আহ্বান জানান।

শারমীন মুরশিদ বলেন, সরকারী সংস্থাসমূহ প্রজেক্ট বাস্তবায়নে কাজ করতে গিয়ে অনেক বেশী দূর্নীতি পরায়ন হচ্ছে। রাষ্ট নিজেই নদী ধ্বংস করছে বলেও তিনি মন্তব্য করেন। সরকার নদী রক্ষার আইন করেছে কিন্তু তার যথাযথ বাস্তবায়ন করছে না। কোভিড সময়ে নদী দখল আরো বেড়েছে বলেও তিনি মন্তব্য করেন।

ফরিদুল ইসলাম ফরিদ বলেন, তিস্তা প্রকল্প নিয়ে কোন সমীক্ষা হয়েছে কি না আমরা স্থানীয় পানি উন্নয়ন বোর্ডের কাছে গিয়ে তার প্রমাণ পাই নি। তিস্তা বাধ প্রকল্পের মাধ্যমে দেশের অনেক টাকা অপচয় হয়েছে বলে তিনি মন্তব্য করেন। এ প্রকল্পের সাথে সংশ্লিষ্ট নেতৃবৃন্দের কিছু স্থানীয় গোন্ডাবাহিনী দিয়ে এলাকায় প্রভাব খাটিয়ে তাদের পক্ষে লোক সংগ্রহের প্রক্রিয়া চালাচ্ছে বলে তিনি মন্তব্য করেন। তিনি আরো বলেন রাজনৈতিক ইচ্ছাই বর্তমানে নদী দখলের মহাপরিকল্পনা চলছে।