রাসায়নিক গুদাম সরাতে ব্যর্থতার পেছনে দায়ীদের চিহ্নিত করা প্রয়োজনঃ বি.আই.পি.

আপডেট: এপ্রিল ২৪, ২০২১
0
file photo

পুরান ঢাকার আরমানিটোলার অগ্নিকান্ডে প্রাণহানি ও ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির ঘটনায় গভীর দুঃখ প্রকাশ করছে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স (বি.আই.পি.)। পাশাপাশি এই ঘটনাকে দূর্ঘটনা না বলে ব্যবসায়ী, বাড়ির মালিকসহ সংশ্লিষ্টদের অতি মুনাফা লাভের প্রবণতা এবং সরকারের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানসমূহের দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতার সম্মিলিত দায়ের ফলাফল বলে মনে করে বি.আই.পি.।

পুরাতন ঢাকা বোমার উপর বসবাস করছে, এই চরম সত্যটি বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স সহ দেশের দায়িত্বশীল সকল মহল থেকে বারংবার বলা সত্ত্বেও পুরান ঢাকা থেকে রাসায়নিক গুদাম নিমতলী ট্র্যাজেডির ১১ বছর পরেও সরেনি। মানুষের জীবন ও সম্পদকে সর্বাগ্রে গুরুত্ব দেয়া হলে বর্তমানে এই পরিস্থিতি হবার কথা ছিল না । মন্ত্রণালয় ও বিভিন্ন সংস্থাসমূহের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন না হওয়ার পেছনে প্রভাবশালী মহল ও রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার যে দায় আছে তাকে উপেক্ষা করে জনস্বার্থ ও মানুষের জান-মাল রক্ষায় সরকারের বলিষ্ট পদক্ষেপ গ্রহণ না করলে এরূপ ঘটনার পুনরাবৃত্তি কেউ রোধ করতে পারবেনা।

রাসায়নিক গুদাম যে কত ভয়ংকর হতে পারে, ২০২০ সালে লেবাননের বৈরুতের বিস্ফোরণ তার জ্বাজ্জল্যমান উদাহরণ। পুরান ঢাকাসহ আশপাশের এলাকায় যেসব বিপজ্জনক রাসায়নিক পদার্থের মজুদ আছে, তা যেকোন ভয়াবহ বিস্ফোরণ ঘটানোর শঙ্কা তৈরী করে রেখেছে সার্বক্ষণিকভাবে। এই বাস্তবতায় নিমতলী, চুড়িহাট্টার অগ্নিকাণ্ডের পর সরকার ঘোষিত নির্দেশনা কেন বাস্তবায়িত হল না এবং রাসায়নিক কারখানাসমূহ সরানোর উদ্যোগসমূহ কেন বাস্তবায়ন করা যায়নি সেটা অনুসন্ধান করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন এবং এক্ষেত্রে দোষী ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান করা প্রয়োজন।

আমরা অবগত আছি যে, নিমতলী ও চূড়িহাট্টা অগ্নিকাণ্ডের পর রাসায়নিক গুদমের ট্রেড লাইসেন্স প্রদান বন্ধ করেছে সিটি কর্পোরেশন যেটা সাধুবাদযোগ্য। কিন্তু পুরান ঢাকায় রাসায়নিক গুদাম ও কারখানাসমূহের নজরদারি কার্যক্রম চালানো সিটি কর্পোরশন এবং ওয়ার্ড কাউন্সিল অফিস, কারখানা অধিদফতর, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, বিস্ফোরক অধিদপ্তর, ফায়ার সার্ভিসসহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানসমূহের দায়িত্ব থাকা সত্ত্বেও তা পালনে সক্ষম হয়নি সংশ্লিষ্ট সংস্থাসমূহ।

পুরান ঢাকার রাসায়নিক গুদাম ও কারখানা সমূহগুলোর অধিকাংশই ইমারত নির্মাণ বিধিমালা ও আদর্শগত মান অনুসরণ করে নির্মিত হয়নি। পাশাপাশি পুরান ঢাকায় বর্তমান পরিকল্পনা অনুসারে মিশ্র ব্যবহারের মানদণ্ড অনুসারে একই ভবনে আবাসন ও বিপদজনক মিশ্র ব্যবহারের কোন অনুমোদন না থাকা স্বত্বেও এ ধরনের বিপদজনক সহবাস দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে। মাস্টার প্ল্যানে নির্দেশিত ভূমি ব্যবহার পরিকল্পনার ব্যত্যয় করে এসব ভবনে অতি মুনাফার জন্য রাসায়নিক দ্রব্যের গুদাম তৈরী করা হয়েছে। দেশের রাজধানীর মূল কেন্দ্রে থেকে এইধরনের বিপদজনক ব্যবসা কিভাবে দিনের পর দিন চলতে দিচ্ছি, সেটা আমাদের আধুনিক ও বসবাসযোগ্য শহর গড়বার অঙ্গীকারকে মারাত্মক প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে।

কেরানীগঞ্জে বিসিক শিল্পনগরীর পাশে বহুতল ভবন নির্মাণের মাধ্যমে রাসায়নিক গুদাম সরানোর যে প্রস্তাবনা ছিল, ব্যবসায়ীদের চাপের মুখে সে সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসে প্লট ভিত্তিক শিল্প এলাকা তৈরি করে রাসায়নিক গুদাম স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত নেয়াটা আমাদের রাসায়নিক গুদাম স্থানান্তরের কাজকে বিলম্বিত করছে। আমাদের দেশে ভূমি স্বল্পতার বাস্তবতায় সকলকে প্লট বরাদ্দ দেবার সংস্কৃতি বন্ধ না করলে এ ধরনের বিপর্যয় আরো দেখতে হবে সামনে।
পুরান ঢাকার অনেক বাড়ির মালিক অধিক মুনাফা লাভের আশায় অনুমোদনহীনভাবে রাসায়নিক গুদাম ও কারখানাকে ভাড়া দিয়ে আসছেন, অথচ তাদের অনেকেই এখন এলাকা পরিবর্তন করে পরিকল্পিত এলাকায় ঝুঁকিমুক্ত ভবনে বসবাস করছেন। এই ভবন মালিকদের অচিরেই আইনের আওতায় না আনা হলে এই সংস্কৃতি চলতেই থাকবে। পাশাপাশি অনুমোদনহীন ও অবৈধভাবে আবাসিক ভবনে বিপদজনক রাসায়নিক গুদামজাতকারী ব্যবসায়ীদের আইনের আওতায় আনা উচিত। সর্বোপরি, সরকারি সংস্থা ও দপ্তরসমূহের সংশ্লিষ্ট দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের কর্তব্য পালনে গাফিলতি থাকলে সে ব্যাপারে তদন্ত সাপেক্ষে আশু ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত।

বর্তমান বাস্তবতায় কেমিক্যাল শিল্প পার্ক বাস্তবায়ন সময় সাপেক্ষ ব্যাপার বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। ফলে অন্তর্বর্তীকালীন সমাধান হিসেবে পুরাতন ঢাকায় যত্রতত্র ছড়িয়ে থাকা রাসায়নিক গুদামগুলোকে শৃঙ্খলায় আনবার জন্য অধিক বিপদজনক রাসায়নিক গুদামসমূহকে অনতিবিলম্বে সরকারি-বেসরকারি শিল্প এলাকায় স্থানান্তর করবার উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন। পাশাপাশি তুলনামূলক কম বিপদজনক রাসায়নিক গুদামকে পুরান ঢাকার সু্নির্দিষ্ট কিছু ভবনের মধ্যে স্থানান্তর করে আশু ঝূঁকি কমানো যায় কিনা সে বিষয়েও পরিকল্পনাগত বিশ্লেষণ করা একান্ত প্রয়োজন।

মানুষের জীবন বিনিময় কিংবা প্রতিস্থাপনযোগ্য নয়। ফলে মানুষের জীবনকে ঝূঁকিতে ফেলে রাসায়নিক গুদাম কিংবা কারখানা আর চলতে দেয়া যায় না। এ ব্যাপারে বলিষ্ঠ পদক্ষেপ নেয়া সরকারেরই দায়িত্ব, এ ব্যাপারে সরকারকে ব্যবসায়ী কিংবা প্রভাবশালী কোন মহলের সাথে কোন ধরনের আপোষ না করে বলিষ্ঠ ও কার্যকর পদক্ষেপ নেবার জোর দাবী জানাচ্ছে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানা