আনোয়ার আলদিন:
ছন্নছাড়া মেঘমালার বিদায়।প্রকৃতিতে এখন স্নিগ্ধতার পরশ।বাতাসে হিম হিম গন্ধ। শিশির ভেজা ঘাসের ডগায় মুক্তোর দানা।সন্ধ্যা-সকাল কুয়াশার চাদর মুড়ে দিচ্ছে চারপাশ। ভোরের কাঁচা রোদ, মৃদু হিমস্পর্শ প্রাণে শিহরণ তুলছে। হেমন্ত এসেছে।
কার্তিক হলো দুই ঋতুর মোহনা।এক্ষণে রূপলাবণ্যে ভরপুর প্রকৃতিকে আমরা নতুন করে আবিষ্কার করি। এক অদ্ভুত আচ্ছন্নতা ঘিরে রাখে। দিনের সূর্য ঢেলে দিচ্ছে মায়াবি রোদ। রাতের আকাশের বুকভরা রূপালি তারা খচিত শুভ্রতা। চাঁদের ধবধবে দুধ সাদা জোছনা। পূর্ণিমা চাদ হয়ে ওঠে শিশির ধোয়া রূপার থালা।ধবল জোছনা তার ঢালিছে চাঁদ ।
হেমন্তের কবি জীবনানন্দ দাশ ‘বনলতা সেন ’কবিতায় হেমন্তের চিত্র এঁকেছেন।‘ সমস্ত দিনের শেষে শিশিরের শব্দের মতো সন্ধ্যা নামে/ডানার রৌদ্রের গন্ধ মুছে ফেলে চিল/ পৃথিবীর সব রং মুছে গেলে পান্ডুলিপি করে আয়োজন / তখন গল্পের তরে জোনাকির রং ঝিলিমিল/ সব পাখি ঘরে আসে সব নদী ফুরায় এ জীবনের সব লেন দেন/ থাকে শুধু অন্ধকার মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন’।
ধূসর বিবর্ণে ভরা ঋতু-হেমন্ত। এই ঋতু সুফলা নয়। মৌসুমী কোন শস্য বা আনাজ আমরা এই ঋতুতে পাইনা। বর্ষা ও শরতের কখনো অনাবৃষ্টি আবার কখনো অতিবৃষ্টির কারণে এই ঋতু বরাবরই নিষ্ফলা থাকে। কৃষক পল্লীতে তাই চলে মঙ্গা। তাদের জমানো ধানচাল আর শস্যদানায় টান পড়ে।শাক-সবজি ফলমূলেরও আকাল। দাম তাই আকাশচুম্বি। এসব কারণে মানুষের দিন এই কার্তিকে অভাব আর অনটনে চলে। কবির কথায় ‘পুলকে আর বিষাদে ভরা থাকে’ এই ঋতু।
খালবিল থেকে সবে মাত্র বর্ষা আর শরতের বৃস্টির জলধারা শুকাতে থাকে।আকাশে মাঝে মাঝে ঘুরে বেড়ায় নীলাভ শুভ্র মেঘের ভেলা। কাঁশবনের শন শন শব্দ আর পাখ পাখালির কিচির মিচিরে জনপদ মুখর থাকে । বর্ষার পরে এই সময়ে বৃক্ষরাজি থাকে সবুজে ভরা।বিল জুড়ে সাদা-লাল শাপলা আর পদ্ম ফুলের সমারোহ।পরাণে তীব্র শীস দেয় কোন্ এক আকুলতা। গ্রামাঞ্চলে শুরু হয় মাছ ধরার উৎসব। মাছ ভাতে বাঙালি হেমন্তকালে জাল, বর্শা, পলো, লুই নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। গ্রামের গেরস্থ কর্তা ঘরে ফেরে ডুলাভর্তি মাছ নিয়ে।মঙ্গাকবলিত ঘরে স্বস্তি আসে, তাদের রসনাও তৃপ্ত হয়। এই হেমন্তের দুই রূপ। প্রথম মাসটির এক রূপ।
পরেরটির অন্য। প্রথম মাসটির দুর্নাম করে বলা হয় ‘মরা কার্তিক’। আর অগ্রাহায়ন নবান্নের মাস।আবহাওয়া বলে দিচ্ছে শীত আসছে।অগ্রহায়ণে ধান কাটার সঙ্গে জেঁকে বসতে শুরু করবে শীত। হেমন্তকে সবচেয়ে চেনা যায় ভোরের শিশিরে। খুব ভোরে শীতল বাতাসে। সবুজ পাতার গায়ে জমে থাকা শিশিরবিন্দু অপার্থিব দৃশ্যমালা রচনা করে। —‘শুয়েছে ভোরের রোদ ধানের উপর মাথা রেখে/ অলস গেঁয়োর মতো এইখানে-কার্তিকের ক্ষেতে;/ মাঠের ঘাসের গন্ধ বুকে তার/ চোখে তার শিশিরের ঘ্রাণ/ তাহার আস্বাদ পেয়ে পেকে ওঠে ধান…
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক