সাফারি পার্কে বাঘের মৃত্যুর গোপন সংবাদ প্রকাশ পার্কে জেব্রাগুলোকে হত্যার অভিযোগ করলেন স্থানীয় এমপি

আপডেট: জানুয়ারি ৩১, ২০২২
0

গাজীপুর সংবাদদাতাঃ গাজীপুরের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্কে চলতি মাসে শুধু ১১টি জেব্রা নয়, আরো একটি বাঘের মৃত্যু হয়েছে। এ প্রাণীগুলো স্বাভাবিকভাবে মারা যায় নি, এগুলোকে হত্যা করা হয়েছে। প্রাণীগুলোর মৃত্যুতে কর্তৃপক্ষের চরম গাফিলতি রয়েছে। নিজেদের অবহেলা ও পার্কে কর্তব্যরত কর্মকর্তা কর্মচারী ও ঠিকাদারদের মধ্যকার মতবিরোধ থাকায় দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা একে অপরকে ফাঁসাতে বাঘসহ জেব্রাগুলোকে হত্যা করেছে বলে অভিযোগ করেছেন গাজীপুর-৩ আসনের সংসদ সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মুহাম্মদ ইকবাল হোসেন সবুজ।

রবিবার দুপুরে সাফারি পার্ক পরিদর্শনে এসে জেব্রা মৃত্যুর ঘটনায় গঠিত বন পরিবেশ ও জলবায়ু মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটির সদস্যদের সঙ্গে পার্কের ঐরাবতী বিশ্রামাগারে মতবিনিময়কালে এমন দাবী করেন সংসদ সদস্য ইকবাল হোসেন সবুজ।

ক্যাপশনঃ
গাজীপুর ঃ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারী পার্কে সংসদ সদস্যের বক্তব্য প্রদান ও জেব্রার বিচরণ চিত্র।

পার্ক সূত্রে জানাগেছে, ২০১৩ সালে গাজীপুরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্ক প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এপার্কে আনা হয় বিভিন্ন দেশ থেকে বাঘ, সাদা বাঘ, সিংহ, জিরাফ, জেব্রা, হরিণ, ক্যাঙ্গারু, কালো ভাল্লুক, সাম্বার, গয়াল, হাতিসহ অনেক প্রাণি। তবে গত কয়েক বছরে বাঘ, জিরাফ, ক্যাঙ্গারু জেব্রাসহ বিভিন্ন প্রাণীর মৃত্যু হয়েছে। এরমধ্যে কিছু সময়ে বিভিন্ন কারণে হলেও বেশি ভাগ সময়েই দায়িত্ব প্রাপ্তদের কর্তব্যে অবহেলায় এমন প্রাণি মৃত্যুর ঘটনা ঘটে থাকে বলে পার্কের আশপাশের স্থানীয় মানুষ ও দর্শনার্থীদের ধারণা।

সূত্র জানায়, গাজীপুরের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্কে ৩১টি জেব্রা ছিল। এরমধ্যে ৬টি জেব্রা হঠাৎ করে ২ জানুয়ারি মারা যায়। এ ঘটনার পর সকল কর্মচারি-কর্মকতার্কে ডেকে বিষয়টি কাউকে না জানানোর জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়। পরবর্তীতে ২৯ জানুয়ারির মধ্যে আরো ৫টি জেব্রা পর্যায়ক্রমে মারা যায়। এনিয়ে চলতি মাসে ১১টি জেব্রার মৃত্যু হয়। পার্কে বর্তমানে ২০টি জেব্রা রয়েছে। ওই ১১টি জেব্রার মৃত্যুর খবর নিতে এসে একটি বাঘের মৃত্যুর খবর বেরিয়ে পড়ে। বাঘটি গত ১২ জানুয়ারি মারা যায়। পার্কে ১০টি বাঘের মধ্যে একটি পুরুষ বাঘ মারা যাওয়ায় এখন মোট বাঘের সংখ্যা ৯টি।

সংসদ সদস্য ইকবাল হোসেন সবুজ বলেন, চলতি জানুয়ারি মাসে সাফারি পার্কে জেব্রাগুলো মারা যায়নি, এগুলোকে মেরে ফেলা হয়েছে। এ মাসেই আরো একটি বাঘের মৃত্যু হয়েছে। এটা কেউ জানে না। এতো মূলবান প্রাণীগুলো মারা যাচ্ছে অথচ পার্ক কর্তৃপক্ষ তা গোপন করে যাচ্ছে।

তিনি তদন্ত কমিটির সদস্যদের কাছে বলেন, যাদের তত্ত্বাবধানে জেব্রা মারা গেছে তাদেরকে স্বপদে বহাল রেখে সুষ্ঠু তদন্ত সম্ভব নয়। এতে পার্কের অন্যান্য কর্মচারীরা মুখ খুলতে সাহস পাবে না। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্কের সীমানা প্রাচীরের ভেতর থেকে হাতির খাবার পাচার করা হয়ে থাকে। বিশেষ সোর্সের মাধ্যমে বাঘ মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। তিনি পার্কের প্রকল্প পরিচালক জাহিদুল কবির ও ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা তবিবুর রহমানকে তাদের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়ার জন্য তদন্ত কমিটির সদস্যদেরকে বলেন। তিনি দোষী ব্যক্তিদের দৃষ্টান্ত মূলক শাস্তির নিশ্চিত করার জন্য সরকারের কাছে দাবী করে বলেন, এটি একটি হত্যার ঘটনা এবং ক্রিমিনাল অফেন্স। এজন্য সাংসদ বাদী হয়ে থানায় মামলা করবেন বলে জানান।

পার্কের প্রকল্প পরিচালক জাহিদুল কবির জানান, গত ১২ জানুয়ারি পার্কে একটি পুরুষ বাঘ হঠাৎ অসুস্থ্য হয়ে মারা গেছে। ওই বাঘের নমুনা সংগ্রহ করে ইতোমধ্যে ল্যাব পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়েছে। কিন্তু এখনো প্রতিবেদন পাওয়া যায়নি। তাই কাউকে জানানো হয়নি। পার্কে ১০টি বাঘের মধ্যে একটি পুরুষ বাঘ মারা যাওয়ায় এখন মোট বাঘের সংখ্যা ৯টি। চলতি মাসেই ১১টি জেব্রা পর্যায়ক্রমে মারা যায়। জেব্রার মৃত্যুপ্রতিরোধে জরুরী চিকিৎসা এবং এ ধরনের অসুস্থতার কারণ উদঘাটনে ইতোপূর্বে গঠিত মেডিকেল বোর্ডের সদস্যরা গত ২৫ ও ২৯ জানুয়ারি সাফারি পার্কে পৃথক সভায় মিলিত হয়। বিশেষজ্ঞ টিমের দেওয়া ১০দফা সুপারিশ অনুযায়ী পদক্ষেপ গ্রহন করেছে সাফারী পার্ক কর্তৃপক্ষ। এখানে কারো কোন অবহেলা বা গাফিলতি নেই।

পার্কের প্রকল্প পরিচালক জাহিদুল কবির আরো জানান, জেব্রা মৃত্যুর কারণ বিশেষজ্ঞরা এখনো সুনির্দিষ্ট করতে পারে নি। মৃত্যুর ব্যাপারে বিভিন্ন ধারণা আছে। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে টেস্টে নিউমোনিয়ার সিমটম আসছে, চার ধরনের ব্যাকটেরিয়া পাওয়া গেছে, সবুজ ঘাস (ভুট্টা গাছ) নাইট্রোজেন কি পরিমাণে বা সহনীয় পর্যায়ে ছিলো কিনা তা বোঝা যাচ্ছে না। তাই এ মুহুর্তে মৃত্যুর সুনির্দিষ্ট কারণ বলা যাচ্ছে না।

তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব সঞ্জয় কুমার ভৌমিক বলেন, জেব্রার মৃত্যুরোধে মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী সাফারি পার্ক কতর্ৃপক্ষ দেশের বাহিরের অভিজ্ঞ চিকিৎসকদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে। সেখানে মৃত জেব্রাগুলোর নমুনা পাঠানো হয়েছে। এছাড়াও দক্ষিণ আফ্রিকার খামার মালিকের সঙ্গে কথা বলা হয়েছে। রোগের বিস্তারিত লক্ষণ, বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার ফলাফল ইমেইলের মাধ্যমে দক্ষিণ আফ্রিকায় পাঠানো হয়েছে। এছাড়াও তদন্ত কমিটি কাজ করছে, ঘটনাস্থল পরিদর্শন করা হয়েছে। বিভিন্ন তথ্য উপাত্ত মিলিয়েই রিপোর্ট পেশ করা হবে। তদন্ত শেষ হওয়ার আগে এবিষয়ে কিছু বলা যাবে না। তবে কর্মকর্তাদের পদ থেকে সরিয়ে দেয়ার বিষয়ে আমার কিছু বলার নেই। এটি প্রশাসনের ব্যাপার।

এর আগে জেব্রার মৃত্যুর কারণ উদঘাটনে পরিবেশ বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের গঠিত পঁাচ সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটির আহবায়ক ওই মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব সঞ্জয় কুমার, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান ড. মোহাম্মদ মনিরুল হাসান খানসহ কমিটির সদস্যরা রবিবার দুপুরে সাফারী পার্ক পরিদর্শণে এসে তদন্ত কাজ শুরু করেন।

প্রসঙ্গতঃ, গাজীপুরের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্কে গত কয়েক বছর যাবত বিশেষ করে করোনা সময়ে জেব্রার অধিকতর প্রজনন ঘটে। যেভাবে জেব্রার সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছিল তাতে কর্তৃপক্ষ অনেক আশাবাদী ছিলেন। দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে আমদানি করা জেব্রা নানা সময়ে বংশ বিস্তারের পর পার্কটিতে এর সংখ্যা প্রায় তিনগুণ বৃদ্ধি পেয়ে ৩১টিতে দঁাড়ায়। এরমধ্যে ১১টি জেব্রা গত ২ জানুয়ারি থেকে ২৯ জানুয়ারি পর্যন্ত সময়ের ব্যবধানে মারা যায়। মারা যাওয়া জেব্রাগুলোর মধ্যে বেশির ভাগই মাদী জেব্রা। এ পার্কে জন্ম নেয়া জেব্রাগুলোর মৃত্যু বেশি হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা জেব্রা মৃত্যুর ঘটনায় জানান, গত ২ জানুয়ারি হতে ২৪ জানুয়ারি পর্যন্ত তিন সপ্তাহের ব্যবধানে মৃত ৯টি জেব্রার মৃত্যু হয়। এরমধ্যে ৪টি জেব্রা নিজেদের মধ্যে মারামারি করে ইনজুরির কারণে এবং অপর ৫টি জেব্রা অতিরিক্ত কঁাচা ঘাস ছাড়াও স্ট্রেপ্টোকক্কাস, ই-কোলাই, ক্লস্টোডিয়াম, সালমোনিলা ও পাস্টুরেলা নামক ব্যাক্টেরিয়া সংক্রমণের (ইনফেকশনাল ডিজিজে) কারণে মারা গেছে। সর্বশেষ শনিবার আরো দুইটি জেব্রার মৃত্যু হয়। এ দুইটির মৃত্যুর কারণ চিহ্নিত করার জন্য কাজ করছে বিশেষজ্ঞ দল। বর্তমানে পার্কটিতে ২০টি জেব্রা রয়েছে।