সিটি কর্পোরশেনের কাউন্সিলররা উন্নয়নের জন্য মাত্র ২০% কাজ পায় ,এটা বৈষম্য — মহিলা পরিষদ

আপডেট: জুন ২১, ২০২১
0

বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের উদ্যোগে “শক্তিশালী ঢাকা সিটি কর্পোরেশন: নারী কাউন্সিলরদের ভূমিকা” বিষয়ক অনলাইন মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। আজ ২১ জুন সকাল ১১ টায় বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের উদ্যোগে “শক্তিশালী ঢাকা সিটি কর্পোরেশন: নারী কাউন্সিলরদের ভূমিকা” বিষয়ক মতবিনিময় সভা অনলাইনে অনুষ্ঠিত হয়। সভায় সভাপতিত্ব করেন সংগঠনের সভাপতি ডা. ফওজিয়া মোসলেম।

মতবিনিময় সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সম্মানিত সিটি মেয়র (উত্তর সিটি কর্পোরেশন, ঢাকা), জনাব আতিকুল ইসলাম, বিশেষ অতিথি হিসেব ছিলেন সায়লা ফারজানা, যুগ্মসচিব ( নগর উন্নয়ন-২ অধিশাখা),স্থানীয় সরকার বিভাগ এবং অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচিত কাউন্সিলরগণ। সভায় স্বাগত বক্তব্য রাখেন সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু।

স্বাগত বক্তব্যে সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু বলেন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ একটি গণতান্ত্রিক, মানবিক, সমতাপূর্ণ, অসাম্প্রদায়িক সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনের লক্ষ্যে কাজ করছে এবং নারীর ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে একটা অনুকূল সামাজিক, রাজনৈতিক পরিবেশ সৃষ্টির জন্য ধারাবাহিকভাবে কাজ করে যাচ্ছে। আমরা জানি গণতন্ত্র, সুশাসন, উন্নয়ন নারীর ক্ষমতায়ন এগুলো অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত এবং গণতন্ত্র ও সুশাসন প্রতিষ্ঠায় স্থানীয় সরকার এখানে অন্যতম সহায়ক হিসেবে কাজ করে। ঢাকা মহানগর একটি প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী নগর হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ যা বিভিন্ন গণতান্ত্রিক ও মানবাধিকার আন্দোলনের সূতিকাগার।

এই নগরীতে ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে প্রায় ২ কোটি মানুষের বসবাস। এই নাগরিকদের সকল পরিষেবা দেয়ার দায়িত্ব, রাষ্ট্রীয় নীতিমালার সাথে সঙ্গতি রেখে তাদের প্রাপ্য সকল সুবিধা দেয়ার দায়িত্ব নির্বাচিত জনপ্রতিনিধির মেয়র এবং কাউন্সিলর আছেন তাদের, তাদের এই দায়িত্ব যদি তারা পালন করতে চান তাহলে তাদের ব্যক্তিগত সদিচ্ছা, রাজনৈতিক সদিচ্ছ, প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা এবং দূরদৃষ্টি অত্যন্ত প্রয়োজন। যেকোন স্থানীয় সরকার যদি সঠিকভাবে কাজ করতে চায় তাকে কেন্দ্রীয় সরকারের সাথে সমন্বয় করে রাষ্ট্রীয় অর্থায়নে নিজস্ব পরিকল্পনায়
অবশ্যই স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে হবে। এসডিজির লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়নে, সকল নাগরিককে প্রাপ্য পরিষেবা দিতে স্থানীয় সরকারের নির্বাচিত মেয়রদের ভূমিকা যেমন রয়েছে, পাশাপাশি নির্বাচিত নারী-পুরুষ সকলের সক্রিয় অংশগ্রহণের মাধ্যমে তাদের এই পরিষেবা নিশ্চিত করতে হবে। টেকসই উন্নয়ন লক্ষমাত্রা বাস্তবায়ন করতে কিভাবে সিটি কর্পোরেশনকে শক্তিশালী করা যায়, ঢাকা নগরের উন্নয়নে কিভাবে কাজ করা যায়, নারী কাউন্সিলরদের ক্ষমতায়নে কিভাবে কাজ করা যায় সেবিষয়ে তথ্য আজকের আলোচনার মাধ্যমে উপস্থাপিত হবে এমন প্রত্যাশা তিনি ব্যক্ত করেন।

প্রধান অতিথির বক্তব্যে সম্মানিত সিটি মেয়র (উত্তর সিটি কর্পোরেশন, ঢাকা), আতিকুল ইসলাম বলেন, ঢাকাকে নারীর জন্য বসবাসযোগ্য নগরী হিসেবে গড়ে তোলার জন্য এবং নারী কাউন্সিলরদের ভূমিকা বৃদ্ধি করতে জনপ্রতিনিধিদের দায়িত্ব পালন করতে হবে, জবাবদিহিতা থাকতে হবে। সনাতনী পদ্ধতি থেকে বের হয়ে আসতে হবে, অ্যাপস ব্যবহারের মাধ্যমে এখন সমস্যা সমাধানে সকলকে কাজ করতে হবে, কাজে জবাবদিহিতা থাকতে হবে, শহরের ফুটপাত দখলমুক্ত করতে, পরিবেশ দূষণ রোধে সচেতনতামূলক প্রোগ্রাম করতে হবে। ২০০৯ সালের ৬০ নং ধারা অনুযায়ী নারীরা সিটি কর্পোরেশনে আসেন নির্বাচন করে অথচ গেজেট না থাকায় তাদের দায়িত্ব দেয়া সম্ভব হয়না,এসময় তিনি নারীদের জন্য গৃহীত পদক্ষেপসমূহের কথা তুলে ধরেন। তিনি বলেন এআরবি বোর্ডের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নারীকে দেয়া হয়েছে, নারীদের ক্ষমতায়নের জন্য অফিসচলাকালীন সময়ে নারীদের জন্য ভাতা চালুর করা হয়েছে, পেনশন প্রথা চালু হয়েছে, বীমা দ্বিগুণ করা হয়েছে, ।

নারী কাউন্সিলরদের কাজে যে বৈষম্য করা হয় তা দূর করতে হবে। এখনো নারীরা কথা বলার সুযোগ পায় না, তাদের জন্য সকলকে কাজ করতে হবে। এসময় তিনি ঢাকাকে নারীর জন্য বসবাসযোগ্য নগরী হিসেবে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে জনগণের সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য প্রচারণা চালানোর জন্য মহিলা পরিষদকে সিটি কর্পোরেশনের সাথে কাজ করার আহ্বান জানান। নারী কাউন্সিলরদের কাজ করার ক্ষেত্রে যেসব বৈষম্য রয়েছে তা দূর করার লক্ষ্যে মহিলা পরিষদের নেতৃত্বে সিটি কর্পোরেশনের ৩জন নারী প্রতিনিধি, স্থানীয় সরকার বিভাগের কর্মকর্তাদের নিয়ে একটা ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠনের প্রস্তাব দেন।

বিশেষ অতিথির বক্তব্যে স্থানীয় সরকার বিভাগের যুগ্মসচিব ( নগর উন্নয়ন-২ অধিশাখা) সায়লা ফারজানা বলেন, সরকারকে নানা ধরণের টার্গেট বাস্তবায়নে কাজ করতে হয়, তার মধ্যে নারীর উন্নয়নের জন্য নানামুখী কাজ করতে হয়। নারী কাউন্সিলরদের ভূমিকা বৃদ্ধি করতে হলে তাদের দক্ষতা বৃদ্ধি করতে হবে, তাদের পেছনে রেখে এই টার্গেট বাস্তবায়ন সম্ভব হবে না। ৮ম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায়, সংবিধানে, আইনে সামাজিক উন্নয়নে নারীদের অবদান রাখার সুযোগ দেয়ার কথা বলা হচ্ছে , কিন্তু বাস্তবে তাদের কাজ করার ক্ষেত্রে গ্যাপ রয়েছে যেমন: ক্যাপাসিটির গ্যাপ , তথ্যগত গ্যাপ আছে। নির্বাচনী ইশতেহার থাকা দায়িত্ব গুলোতে গ্যাপ চিহ্নিত করে বাস্তবায়নে সকলকে কাজ করতে হবে। নারী কাউন্সিলরদের নিজ অধিকার, দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে আরো সচেতন হতে হবে, গুণগত পরিববর্তনে গুরুত্ব দিতে হবে। পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা নারীদের ও দূর করতে হবে, নিজের গ্যাপ চিহ্নিত করে প্রয়োজনীয় জায়গায় যেতে হবে। ওয়ার্কিং গ্রুপ করে পুরো আইনটির সংশোধনের জন্য কাজ করতে হবে।

মত-বিনিময় সভায় উপস্থিত ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচিত কাউন্সিলরদের মধ্যে সাথী আক্তার, জাকিয়া, শিখা, কাসেম মোল্লা, হাসিনা বারী বলেন আমরা একটা শুভঙ্করের ফাকির মধ্যে পড়েছি। আইনী বাধার কারণে জনগণের কাছে দেয়া প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে কাজ করা সম্ভব হচ্ছে না। নারী কাউন্সিলরদের উদ্দেশ্যে বলা ‘সংরক্ষিত ’ কথাটি বাদ দিতে হবে। তারা এসময় প্রশ্ন রাখেন নারী কাউন্সিররা নিজ যোগ্যতায় পুরুষদের চেয়ে বেশি ভোটে নির্বাচিত হয়, ৩টি ওয়ার্ডের দায়িত্ব পায় তাহলে কেন তারা সমানভাবে কাজ করতে পারবেন না, অনেক সময় হয়রানি করা হয়, বরাদ্দের ক্ষেত্রে পুরুষদের জন্য ৮০% ও নারীদের জন্য ২০% দেয়া হয় এর ব্যবধান এর কথা গেজেটে কোথাও বলা নেই। এখানে সমানভাবে সেবা প্রদানের সুযোগ দিতে হবে তবে নারী-পুরুষ উভয়ই উপকৃত হবে।

তারা আরো বলেন গেজেট বিধির পরিবর্তন করতে হবে, নারীদের বহুবিবাহ প্রতিরোধে কাজ করতে হবে, নারী-পুরুষদের মধ্যে থাকা বৈষম্য দূর করে সমানভাবে কাজের সুযোগ দিতে হবে। আইন সংশোধন করলে কাজ করা সম্ভব হবে। দাবি আদায়ে আন্দোলন চালিয়ে যেতে মহিলা পরিষদকে সহায়তা করতে হবে। এসময় করোনাকালীন সময়ে নারীর কন্যার প্রতি ইভটিজিং বেড়েছে উল্লেথ করে তারা ইভটিজিং প্রতিরোধে মহিলা পরিষদকে কাজ করার আহ্বান জানান।

মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সহ সভাপতি ও ভারপ্রাপ্ত আন্দোলন সম্পাদক রেখা চৌধুরী। তিনি বলেন জাতিসংঘের বসতি সংক্রান্ত উপাত্তের ভিত্তিতে বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ শহর এই ঢাকা। বর্তমানে ঢাকা শহরে বিভিন্ন শ্রেণী- পেশা, নারী- পুরুষ, শিশু, বৃদ্ধ, ধনী, মধ্যবিত্ত, দরিদ্র, প্রান্তিক, প্রতিবন্ধী, ভাসমান মানুষের বাস।

সিটি কর্পোরেশনের নাগরিক সেবা দানের পরিধিও দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। কিন্তু বিভিন্ন সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সমন্বয়হীনতা,অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতির কারণে এই বিপুল জনসংখ্যা নানা দূর্ভোগ নিয়ে মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে বসবাস করে। দূর্ভোগ মোকাবেলায় সম্প্রতি সিটি কর্পোরেশন কর্তৃক গৃহীত কয়েকটি ইতিবাচক পদক্ষেপসমূহ যেমন: ‘সবার ঢাকা’ নাামক মোবাইল আ্যাপস, মশা নিধন, জলাশয় পুনরুদ্ধার, পশু কোরবানীর জন্য স্থান নির্ধারণ,অবৈধ দখল পুনরুদ্ধার ইত্যাদির উল্লেখ করে বলেন উল্লিখিত কর্মকান্ড বাস্তবায়নে নারী- পুরুষ নির্বিশেষে নির্বাচিত সকল জনপ্রতিনিধির সমান দায়িত্ব রয়েছে। সিটি কর্পোরেশনকে শক্তিশালী ও কার্যকর করে তুলতে হলে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি নারী- পুরুষ নির্বিশেষে সকলকে ঐক্যবদ্ধভাবে এলাকার উন্নয়ন, মানুষের উন্নয়ন ও নিরাপত্তায়, সামাজিক সমস্যা নিরসনে একত্র হয়ে কাজ করতে হবে। পাশাপাশি সিটি কর্পোরেশনকেও গণতন্ত্র ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কর্মক্ষেত্রে নির্বাচিত সকল জনপ্রতিনিধিদের কর্ম বন্টনে এই সমতার দিকে গভীরভাবে নজর দিতে হবে।এসময় তিনি নারী কাউন্সিলর প্রতি বিরাজমান বৈষম্যের উল্লেখ করে তা নিরসনের লক্ষ্যে বেশ কয়েকটি সুপারিশ তুলে ধরেন (সংযুক্তি-১)
সভাপতির বক্তব্যে সংগঠনের সভাপতি ডা. ফওজিয়া মোসলেম বলেন, শক্তিশালী ঢাকা সিটি কোন বাস্তবতায় হচ্ছে সেটি দেখতে হবে। আমাদের সুদূরপ্রসারী কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে, কাজ করার সুযোগ ও স্বাচ্ছন্দ্যে বসবাসের সুযোগ সম্পন্ন ঢাকা গড়ে তুলতে হবে।

পাশাপাশি নারী কাউন্সিলরদের সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য করণীয় সম্পর্কে তিনি বলেন এখানে বিভিন্ন শ্রেণীর নারীরা আছেন, ইনফরমাল সেক্টরে অনেক নারী কাজ করছে, তাদের জন্য কাজ করতে হবে। যারা প্রশাসনে ক্ষমতায় আছেন তাদের জন্য আইনের শাসন নিশ্চিত করতে হবে, ডিজিটাল অ্যাপের সঠিকব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। ঢাকা শহরে বসবাসকারী নারীদের জন্য সেফটিনেটমূলক কি কি কাজ করা যেতে পারে তার একটা তালিকা তৈরি করতে হবে,নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নকে প্রতিষ্ঠা করতে হলে আইন করে প্রাতিষ্ঠানিক রুপ দিতে হবে, গেজেটে নারীদের দায়িত্বের জায়গা সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করতে হবে। মন্ত্রণালয়গুলোকে প্রশিক্ষণের জন্য উদ্যোগ নিতে হবে। সর্বোপরি ঢাকা সিটিকে নারীর জন্য বসবাসযোগ্য নগরী হিসেবে গড়ে তুলতে সকলকে নিজ নিজ জায়গা থেকে দায়বদ্ধতা নিয়ে কাজ করার জন্য এবং নারীকে মানুষ হিসেবে ভাবার শিক্ষা গ্রহণ করতে আহ্বান জানিয়ে তিনি বক্তব্য শেষ করেন।
উক্ত মতবিনিময় সভায় সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটির নেতৃবৃন্দ, ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের কাউন্সিলর, প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সাংবাদিক সহ ৩৫ জন উপস্থিত ছিলেন।
সভা সঞ্চালনা করেন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের এ্যডভোকেসি ও লবি পরিচালক জনা গোস্বামী ।