সুস্বাস্থ্যে সমৃদ্ধ বাংলাদেশের জন্য তামাক আইন শক্তিশালী করা ও তামাক পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি জরুরী

আপডেট: মার্চ ৩০, ২০২৪
0

লেখকঃ ডাঃ নিজাম উদ্দীন আহম্মেদ

বাংলাদেশে প্রায় ৭০ শতাংশ মানুষের মৃত্যু হয়ে থাকে অসংক্রামক রোগের কারনে, বিভিন্ন তথ্য উপাত্ত থেকে দেখা যায় অসংক্রামক রোগীদের বেশিরভাগই তামাক ও তামাকজাত পণ্য ব্যবহারকারী। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশে তামাকজনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে প্রতিবছর ১ লাখ ৬২ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়ে থাকে। একই সাথে তামাক ও তামাকজাত পণ্য ব্যবহারের ফলে দেশে প্রতিবছর প্রায় ৩০ হাজার ৫৬০ কোটি টাকার অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়ে থাকে (চিকিৎসা ব্যয় এবং উৎপাদনশীলতা হারানো সহ)। এই সকল বিষয় বিবেচনা করে ২০১৬ সালে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে তামাকমুক্ত করার ঘোষণা দিয়েছেন; যা বাস্তবায়নে বিদ্যমান তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধন প্রয়োজন এবং একই সাথে সুনির্দিষ্ট কর ও মূল্যবৃদ্ধির মাধ্যমে তামাকের ব্যবহার কমানো জরুরী।  দেশের জনস্বাস্থ্য সুরক্ষা এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে ত্বরান্বিত করতে এই বিষয়গুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে বলে প্রতীয়মান হয়।

ধূমপান ও তামাক নিয়ন্ত্রণে ব্যাপক হারে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করাটা অতীব জরুরী। তবে সিগারেট এখনো নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের তালিকায় রয়েছে তা খুবই দুঃখজনক। ১৯৫৬ সালে প্রণীত ‘অত্যাবশ্যকীয় পণ্য নিয়ন্ত্রণ আইন’ এ সিমেন্ট, সার এবং শিশুর খাদ্যের সঙ্গে সিগারেটকে নিত্য প্রয়োজনীয় তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছিল যেটি এখনও রয়ে গেছে। ধূমপানের প্রতি মানুষের আগ্রহ কমাতে খুব দ্রুত সিগারেটকে অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের তালিকা থেকে বাদ দেয়া প্রয়োজন। পাশাপাশি বিদ্যমান তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনও শক্তিশালী করা জরুরী।

বিশ্বব্যাপী যেসব দেশে তামাকের ব্যবসা ভালো, তাদের মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। প্রতিনিয়ত নতুন নতুন ধূমপায়ী তৈরিতে তামাক কোম্পানিগুলো নানান কৌশল ব্যবহার করে। তাদের পণ্যগুলোকে এমন ভাবে বাজারজাত এবং প্রদর্শন করে থাকে যাতে ক্রেতা সাধারণ সহজেই আকৃষ্ট হয়। সিগারেট কোম্পানিগুলো প্রতিনিয়ত অপ্রাপ্ত বয়স্ক এবং কিশোর-তরুণদের লক্ষ্য করে তাদের কৌশলী বাজারজাতকরণ এবং প্রদর্শনী করে থাকে। একই সাথে তামাকজাত পণ্যের মূল্য যেন ক্রেতার নাগালের মধ্যে থাকে সে বিষয়টি বিবেচনার মধ্যে রাখে। যার ফলে সিগারেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা তুলনামুলকভাবে কমছে না। আবার নিত্যনতুন তামাকপণ্য দিয়ে বাজার সয়লাব করে ফেলছে, এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ই-সিগারেট বা ভ্যাপ। আমাদের দেশের মোট জনগোষ্ঠীর ৪৯ শতাংশই তরুণ, যাদের বয়স ২৪ বছর বা তার নিচে। এই বিশাল তরুণ জনগোষ্ঠীকে যেকোনো উপায়ে তামাকপণ্য ও ইমার্জিং টোব্যাকো প্রোডাক্ট এ আসক্ত করে নিজেদের ব্যবসা সম্প্রসারণ এবং মুনাফা বৃদ্ধি করার চেষ্টা করছে ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানগুলো। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতসহ অনেক দেশ ই-সিগারেট নিষিদ্ধ করা হয়েছে। বাংলাদেশেও ভয়াবহ ই-সিগারেট নিষিদ্ধ করা জরুরী।

গ্লোবাল অ্যাডাল্ট টোব্যাকো সার্ভে ২০১৭’-এর তথ্যমতে বাংলাদেশের ৩৫.৩ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ কোনও না কোনও তামাক পণ্য ব্যবহার করেন। আমরা ১০৯টি দেশের মধ্যে সর্বোচ্চ ধূমপায়ীর দিক থেকে নবম অবস্থানে আছি। এরমধ্যে নারী-শিশুও রয়েছেন। তবে নারী ও শিশুদের মধ্যে পরোক্ষ ধূমপানের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ঘটনা সবচেয়ে বেশি। টোব্যাকো এটলাসের গবেষণায় এসেছে, বাংলাদেশে কর্মক্ষেত্রসহ পাবলিক প্লেস ও পরিবহনে প্রতিবছর পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হয় ৩ কোটি ৮৪ লাখ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ। আবার ‘গ্লোবাল ইয়ুথ টোব্যাকো সার্ভে ২০১৩ অনুযায়ী, দেশের প্রায় ৭ শতাংশ অপ্রাপ্তবয়স্ক শিশু-কিশোর তামাক সেবন করে, যাদের বয়স ১৩ থেকে ১৫ বছরের মধ্যে। তামাকজাত পণ্য ব্যবহারের কারণে ২০১৮ সালে বাংলাদেশে প্রায় ১৫ লক্ষ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ তামাক ব্যবহারজনিত রোগে ভুগছিলেন এবং প্রায় ৬১ হাজার শিশু পরোক্ষ ধূমপানজনিত নানান রোগে আক্রান্ত হয়েছে।

আমরা যদি তামাকের অর্থনৈতিক ক্ষতির দিকে তাকাই তাহলে দেখি, ২০১৮ সালে কেবল তামাক এবং তামাকজাতপণ্য ব্যবহারের কারণে এই বছরে স্বাস্থ্যখাতে মোট ব্যয়ের পরিমাণ ছিলো প্রায় ৮ হাজার ৪ শত কোটি টাকা, যার ৭৬ শতাংশের খরচ মিটিয়েছে তামাকব্যবহারকারীর পরিবার আর ২৪ শতাংশ খরচ এসেছে জনস্বাস্থ্য খাতের বাজেট থেকে, যা ২০১৮-১৯ অর্থবছরে স্বাস্থ্যখাতে সরকারী ব্যয়ের প্রায় ৯ শতাংশ। আবার স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিটের গবেষণার তথ্য মতে, চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে প্রতিবছর নতুন করে অসংখ্য মানুষ দারিদ্র্যতার শিকার হচ্ছেন। সবচেয়ে ভয়াবহ বিষয় হচ্ছে, বাংলাদেশে প্রতি অসংখ্য লোক দারিদ্র্য সীমার নিচে চলে যাচ্ছে শুধু চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে গিয়ে, যার সিংহভাগ হচ্ছে তামাকজনিত অসংক্রামক রোগের জন্য।

তামাক খাত থেকে সরকার প্রতিবছর যে রাজস্ব আহরণ করে, তার তুলনায় তামাকজনিত রোগের চিকিৎসায় সরকারকে অনেক বেশি ব্যয় করতে হচ্ছে। প্রতিবছর প্রায় ৩ লাখ মানুষ পঙ্গুত্ব বরণ করে তামাকের কারণে। সরকার তামাকের জন্য যে বিপুল অর্থ ব্যয় প্রতিবছর করে যাচ্ছে তা অন্যান্য খাতে করলে সাধারণ মানুষের জীবনমানে উন্নতি ঘটত এবং একই সঙ্গে তা অভীষ্ট টেকসই উন্নয়ন লক্ষমাত্রা-এসডিজি অর্জনে অবদান রাখতে পারত। সব বিবেচনায় তামাকের জন্য জাতির যে বিশাল অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে সেই সাথে বাংলাদেশ তার কাঙিক্ষত লক্ষ্য অর্জনে পিছিয়ে যাচ্ছে। দেশের অর্থনৈতিক এবং স্বাস্থ্য খাতে তামাকের এই বিপুল ক্ষতি সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট সবাই ভালভাবেই অবগত। বাংলাদেশে স্বাস্থ্য খাতের পেছনে যে সরকারী বরাদ্দ থাকে, তার বেশিরভাগই চিকিৎসা সেবার পেছনে খরচ করা হয়। অর্থনৈতিকভাবে আমরা নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হলেও কিন্তু এখনও দেশের সাধারণ মানুষের আর্থিক সক্ষমতা চিকিৎসা সেবা প্রাপ্তির ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত নয়।

তামাকপণ্যের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ ও তামাকের ব্যবহার কমিয়ে আনার লক্ষ্যে বাংলাদেশ ২০০৩ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন টোব্যাকো কন্ট্রোল (FCTC) স্বাক্ষর করে। পরবর্তীতে ২০০৫ সালে বাংলাদেশে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন প্রণীত হয় এবং সর্বশেষ ২০১৫ সালে তা সংশোধিত হয়। কিন্তু গত ৯ বছরের বাস্তবতায় এই আইনের সংশোধন আবারও জরুরী হয়েছে। আইনের নানান ফাঁক ব্যবহার করে তামাক ব্যবসায়ীরা নতুন নতুন উপায় বের করছে, যা তামাকের ব্যবহারকে কমাতে পারছে না বরং প্রতিনিয়ত বেড়ে চলছে। এর ফলে প্রধানমন্ত্রীর তামাকমুক্ত বাংলাদেশ ঘোষণা বাস্তবায়নের পথ সুদূর পরাহত হয়ে যাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার পরে তামাক নিয়ন্ত্রণ নিয়ে অনেক কাজ হয়েছে। সরকারি প্রতিষ্ঠান ও উন্নয়ন সংস্থাগুলো ব্যাপক উদ্যমে কাজ করেছে। তবে কয়েক বছর ধরে সংসদীয় ফোরাম তামাক নিয়ন্ত্রণের পক্ষে যেভাবে সরব হয়েছেন তাতে প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত  তামাকমুক্ত বাংলাদেশের আশার আলো দেখা যাচ্ছে। বিশেষজ্ঞ এবং নীতি নির্ধারকদের বক্তব্যে প্রায় উঠে এসেছে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধনে নিন্মোক্ত বিষয়গুলো  গুরুত্ব দেয়া প্রয়োজন। যেমন পাবলিক প্লেসে ধূমপান নিষিদ্ধ করা, বিক্রয়স্থলে তামাক দ্রব্য প্রদর্শন নিষিদ্ধ করা, তামাক কোম্পানির সিএসআর কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা, খুচরা বিক্রি বন্ধ করা, সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কতার উপর জোর দেওয়া এবং ই-সিগারেট বা হিটেড টোব্যাকো প্রোডাক্টস (এইচটিপি) নিষিদ্ধ করার মতো বিষয়গুলো গুরুত্বপূর্ণ ভাবে সামনে এসেছে। তামাক ব্যবহার নিরুৎসাহিত করার সবচেয়ে কার্যকর উপায় হচ্ছে কর বৃদ্ধির মাধ্যমে তামাকপণ্যের মূল্য বাড়ানো এবং তামাক চাষ কমানো।

তাই জনস্বাস্থ্য সুরক্ষা, সুস্থ কর্মক্ষম মানবসম্পদ গঠন এবং জাতীয় অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি অব্যাহত রাখতে তামাক ব্যবহারের নাগাল টানা অতীব জরুরী। আর সবচেয়ে জরুরী তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের যুগোপযোগী সংশোধন, তার সঠিক বাস্তবায়ন এবং একই সাথে উপযুক্ত কর কাঠামো গড়ে তোলা, যা তামাক নিয়ন্ত্রনে গুরুত্বপুর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।

লেখক পরিচিতিঃ
ডাঃ নিজাম উদ্দীন আহম্মেদ
নির্বাহী পরিচালক-স্বাস্থ্য সুরক্ষা ফাউন্ডেশন এবং
চেয়ার-গ্যাভি সিএসও স্টিয়ারিং কমিটি