‌`বেভারলি হিলস ও কুয়াশা ভোরের ‌নি:সঙ্গ মাছরাঙ্গার নিশ্চুপ জীবন’

আপডেট: ডিসেম্বর ২৬, ২০২২
0

ডা .জাকারিয়া চৌধূরী :

একদা যে সুরভী সুদীপের জীবনে প্রেমিকা রুপে ঝড়ের বেগে প্রবেশ করিলেন, তিনি-ই যে পরে সুদীপের স্ত্রী হইবেন তাহা মোটামুটি দুই জনেই জানিতেন। এই জানার ভিত্তি কি ? ভিত্তি ছিল পারস্পরিক বিশ্বাস, আস্থা আর রেসপেক্ট টু ইচ আদার। সময়ের সাথে পাল্লা দিয়া দিনকে দিন তাহারা একে অপরের আপন হইয়া উঠিল। সাথে সবচে বড় ফোঁড়নের কাজ করিল পারস্পরিক বিশ্বাস। স্থান, কাল, জাতকুল লইয়া কেহই ভাববার অবকাশ পায় নাই। তাহারা মনে করিতো, বিংশ শতাব্দীর শেষ বেলায় এইসবের গুরুত্ব আর নাই। আসলেও নাই। জাত অজাতের ছায়া রহিয়া গিয়াছে দুনিয়ার সবচে বড় সভ্য দেশেও।

এই ছায়াছবি দেখিবার কিংবা বুঝিবার মত জ্ঞান তাহাদের বিদ্যা বুদ্ধিতে যুক্ত হইল না। তাহারা বিশ্বাসের আকাশে ডানা মেলিলো স্বাধীন প্রজাপতির মত। যেখানেই যায় যেখানেই খায় যেখানেই বসে, তাহারা এক সাথে বসে, উঠে, যায় আবার ফিরে আসে। তাহারা নি:সঙ্গ মাছরাঙ্গার মত শীতের ভোরে নিশ্চুপ বসিয়া থাকিবার পাত্র পাত্রী নহে। তাহারা জীবনকে উপভোগ করিতে লাগিলো ফুলে ফুলে, মধু আর মাধুরীতে।

বিশ্বাস ভালোবাসাকে জীবন দান করে। আবার এই বিশ্বাসই ভালোবাসাকে নরকে নিক্ষেপ করিতে পারে। বিশ্বাসে ভর করিয়া মানুষ সমুদ্রের অতলে তলাইয়া যাইতেও দ্বিধা করে না, ভয় করেনা। অবিশ্বাসের কারন ঘটায় না। তবে ভুল হইতে পারে। ধরুন আপনি বিশ্বাসের জোরে মহাসমুদ্রে ঝাপ দিলেন। ভাল কথা। কিন্তু সমুদ্রের অতলে যত তলাইবেন, জীবনদায়ী পানি-ই যে আপনার গলার ফাঁস হইতে পারে তাহা কি একবারও কেউ ভাবেন ? বোধ করি, ভাবেন না। ভালোবাসাকে সীমার অতলে লইয়া গেলে তাহার চাপ সহ্য করিবার শক্তিও যে থাকিতে হইবে। তাহা না পারিলে বিচ্ছিন্ন হইয়া যাইবেন- ইহাই বাস্তবতা। ভালোবাসার প্রাথমিক মোহ কাটিলে সংসারে কে বড় কে ছোট বা এই জাতীয় গোড়া প্রশ্ন এক সময় মাথাচাড়া দিয়া উঠে। আগেই বলিয়াছি, এইসব কান্ড চলিয়া গিয়াছে কিন্তু যে ছাপ সমাজে এখনো রাখিয়া গিয়াছে, প্রেমপর্বে তাহা দৃষ্টিগোচরে সচরাচর ধরা দেয় না। ফলত; কাহারো জীবনে আসে বংশীয় গুরুত্বের কথা। সেখানেও কথা শেষ হয় মৌলে। কাহার বংশ বড়, কে কাহার তুলনায় খাটো – এইসব বিচ্ছিরি গাল গল্পে । সংসার জীবনে এমন গপ্প অল্প অল্প করিয়া জমিতে থাকে। শুরুতে এইসব তলানীর বিষ চোখে পরে না। বড় বোতলে কেরাসিন তেল দীর্ঘদিন রাখিলে দেখিবেন, এর বিষ জমেছে, সেও তলানীতে। মানুষ সহসা এই জিনিস প্রত্যক্ষ করে না। তাই দেখা হয়না, জানাও হয়না। অন্ধকারকে যে তেল আলোকিত করে সেই আলোর নিচেও ঘন অন্ধকারের বাস।

এইভাবে খুব ধীরে ধীরে বিষ জমিয়া উঠে। যে স্থানে প্রদীপ জ্বলে সে স্থানের উপরে কালি জমে। কেন, কিভাবে কি হয় তাহা কয়জনে ভাবিয়া লয় বলুন !! আজকের দিনে আপনি যদি শান্তির আশায় কে বড় কে ছোটো তাহার বিতর্ক এড়াইয়া পরাজয় স্বীকার করিয়া লন, তাহাতেও কি কালি জমা থামিয়া যাইবে ? না থামিবে না। বাকি জীবন নিজেকে কেরাসিনের আলোয় খুঁজিয়া পাইবেন না, যদি পাইয়াও যান তবে কুপির সলতে হিসেবে নিজেকে কখনো আবিস্কার করিলেও করিতে পারেন। এর বেশি কিছু নহে। যদি জয়ী হইবার খায়েশ আপনার মজ্জাগত হয় তবে জানিবেন একদা যে প্রেম ঝড়ো বাতাসের মতই জীবনে উদয় হইয়াছিল, বিচ্ছেদের বীজ আপনি তাহারও বহু আগেই রোপন করিয়াছিলেন। এই বীজ হইল অহং এর বীজ। জীবনের প্রথম একুশ বসন্ত পার করিবার পর প্রথম সুদীপ জানিলো, ঢাকার শিশুরা বিশেষতঃ মেয়ে শিশুদের শৈশব নাকি বার্বি ছাড়া কল্পনা-ই করা যাইত না। সুদীপ গ্রাম হইতে আগত। ফলত: লজ্জায় জিগেস করিতে পারিল না, বার্বি জিনিসটা কি ? এরও বহু বছর পরে শুনিল- এটি নিছকই একটি পুতুল মাত্র। প্লাস্টিক বা এই জাতীয় কিছুতে বানানো, খাটো ফ্রক পরানো সামান্য একটা পুতুল। অবাক হইল সুদীপ। একটা পুতুলের জন্যেই এত কিছু !!? সে ভাবিলো- আরে, আমরা খেলা করিয়াছি জীবন্ত পুতুল লইয়া। আমাদের মনোরঞ্জনের জন্যে গরীব আত্মীয় স্বজনদের অসম প্রতিযোগিতা দেখিয়া। সেইসব স্বজনেরা তাহাদের সন্তানদের ঠেলিয়া দিত আমাদের জন্যে, আমাদের সাথে থাকিয়া কিছু আদব লেহাজ, আর ভদ্রপল্লীতে থাকিয়া পড়ালেখা শিখিয়া চলনসই একটা জীবনের প্রত্যাশায়। আমাদের সাথে থাকিলে তাহারা নাকি একদা মানুষ হইয়া উঠিবে। আহা মানুষ !! মানুষ হওয়া কি চাট্রিখানি কথা ! যাহাদের সহিত থাকিয়া তাহারা মানুষ হইবার স্বপ্ন দেখিত, তাহারা কি মানুষ হইয়াছিল ? একটা প্রশ্ন সুদীপের মাথায় পাক খাইতে শুরু করিল। মানুষ জিনিসটা তবে কি ?

সুদীপ খাতা কলম লইয়া বসিল। সে কিছু জিনিসের ব্যাখ্যা খুঁজিবে। এই খাতা সে খুলিলো, তাহার প্রেম শেষ হইবার অন্তত অর্ধযুগ পরে। নিজেরে লইয়া সুদীপের মনে কোনো ক্ষেদ নাই। কিন্তু জানিবার, বুঝিবার ঝোক তাহার আছে। সে লিখিতে শুরু করিল-

কেইস স্টাডি – ১:

আমাদের দুঃসম্পর্কের এক কাকু একদা তাহার তাগড়া নও জোয়ান ছেলে নিয়ে আমাদের বাড়িতে আসিয়া হাজির। সে নাকি ক্লাস নাইন পর্যন্ত পড়িয়া ফেলিয়াছে। তাহার পড়াশোনার খরচ বহনের সাধ্য আর এই পিতার নাই। তাই এইখানে থাকিয়াই বিদ্যার বাকি নহর পান করিবার সাধ তাহার। ভদ্রলোক দুরের আত্মীয় কিন্তু আমার আব্বার সে কাছের মানুষ । বাবা এক বাক্যে রাজি হইলেন। সে খুশি হইল, আমরাও খুশি হইলাম। ভোরে যখন আমরা পন্ডিত মশায়ের বাড়ি যাই তখন সে আব্বার পায়ের তালুতে শক্ত হইয়া জমিয়া থাকা এক প্রকারের মরা চামড়া ব্লেড দিয়া নিপুন হাতে কাটে। আরামে আব্বার চোখ দুইটা নিজেদের কোটর ছাড়িয়া যেন আরও ভিতরে চলিয়া যাইতে চায়। সংসারের রান্নাবান্না হয় পুকুরের পানিতে। সেখানে বাধানো ঘাট নাই , ঘরেও বাড়তি লোক নাই। তাই পানি তুলিবার জন্যে তাকে আম্মার পাশে থাকিতে হয়। সকালে তাহার পন্ডিত মশায়ের বিদ্যা সম্প্রদান মিস হইয়া যায় এই কারনে। একদিন সকালে আবিস্কার করিলাম বাবা তাহাকে বেসুমার কিল ঘুসি মারিতেছে। হেতু কি ? হেতু হইল, সে ‘বই’ বানান করিতে পারে নাই। আর এই হেতু শুনিয়া আমার মন ভাঙ্গিয়া গেল, তাহার উপর হইতে সকল শ্রদ্ধাবোধ দুরীভুত হইতে শুরু করিল। নাইন পাশ দেওয়া ছাত্রের এই কি হাল !! এক সময় আবিস্কার করিলাম,পড়ালেখা ছাড়া সে অন্যান্য অনেক বিষয়ে পটু। চুরি- চামারি, অশ্লীল কথা-কাজ, নারী বিষয়ক শিক্ষা, বাজার হাট, বাজার হইতে টাকা সরাইবার প্রনালী, স্কুলে না গিয়া আলু ক্ষেতে মাথা নিচু করিয়া বসিয়া থাকা, সদ্য জন্ম নেয়া কুকুরের ডাক অবিকল নকল করিতে পারা থেকে শুরু করিয়া এমন কোন সাবসিডিয়ারি বিদ্যা নাই যাহাতে সে কোনও অংশে কম। যাহার এত এত গুন তাহার প্রতি অসম্মান দেখাইবার কারনে মনে মনে খুব অনুতপ্ত হইলাম। গাছে উঠিবার সময় সে উপুড় হয়, আমি তাহাকে সিড়ি রুপে পাই। আহা কি আনন্দ আকাশে বাতাসে ! আমাদের শিশুকালের লিভিং বার্বি। সে বিদ্যা শিক্ষা করিয়া সু-মানুষ হইতে আসিয়াছিল। তাহার পিতা মাতার বড় বড় স্বপ্ন ছিল। সে এখন এই বাড়ির বান্ধা চাকর। বিনা প্রশ্নের জীবন্ত বার্বি। আমি তাহার ঘাড়ে বসিয়া দোল খাই, লাথি দিয়া নাক ফাটাইয়া ফালাই, যাহা ইচ্ছা তাহাই করিয়া বেড়াই। আমি সবার ছোট, আমার বিরুদ্ধে নালিশ করিবে, এমন বুকের পাটা কার !!?

যেমন ঝড়ো দুপুরে কাক ভেজা হইয়া একদিন পিতা পুত্র এই বাড়িতে একরাশ প্রত্যাশা আর বড় হইবার সাধ সমেত উপস্থিত হইয়াছিল, তেমনই ঝড়ো দুপুরে অন্য আরেকদিন তাহার পিতা ইহলোক ত্যাগ করিল। গরীব মরিলে তাহার আত্মীয় স্বজন লোক বাছিয়া বিলাপ করে। ধনী আত্মীয় আসিলে আকাশ বাতাস কাপাইয়া কাঁদে যেন তাকেই বেশি শোকগ্রস্থ মনে হয়, কিছু দিবার থাকিলে যেন তাহার হাতেই দেওয়া হয়। আবার গরীবের মরা বাড়িতে আরও গরীব কেহ আসিলে তাহারে তাড়াইবার জন্যে সবাই যেন একপায়ে খাড়া থাকে। সবাই দ্রুততার সাথে মরা ব্যাক্তিকে দাহ করিতে ব্যাস্ত হইয়া পরে। পাছে কার না কার উপর কোন বেলায় খাওয়াইবার দায় না বর্তাইয়া যায়। তাহার পিতাকে দাহ করা হইবার পর তাহার মাতা একেবারে নিঃস্ব হইয়া পরিল। এইদিকে আমার আম্মাও ততদিনে বিভিন্ন জটিল রোগে শয্যাশায়ী হইয়া বিছানায় পড়িল। আম্মার সেবার জন্য নতুন কাউকে খুব বেশি দুরে খুজিতে হইল না। তাহারা বিদ্যা শিক্ষা লাভ করিয়া, বড় হইয়া, চাকরি বাকরি করিয়া তাহাদের পিতামাতার মুখ উজ্জ্বল করিতে এই দুয়ারে পা রাখিয়াছিল কোন এক ভয়ংকর ঝড়ো দুপুরে, আগেই বলিয়াছি। তাহারা এখনো বিশ্বস্ততার সাথে এই সংসারের অর্থাংশে ( যেই অংশে টাকার প্রবাহ স্থিতিশীল, চলমান এবং বর্ধিষনু ) গোলামীতেই দিন গুজরান করিতেছে। পাঠক, মনে রাখিবেন কথা গুলো। কারন, পরের কেইস স্টাডি যে আরও নির্মম। সময়ের সাথে বার্বিও কিন্তু আকার, আকৃতি, চেহারা, সাইজ আর দামে বাড়িয়াছিল। আমাদের জীবন্ত বার্বি গুলোকেও আমরা যুগ অনুযায়ী চালাইয়াছি খুবই চালাকি আর বিচক্ষনতার সহিত। বুঝিয়াছেন নিশ্চয়ই !!

কেইস স্টাডি-২:

এই ছেলেটা খুব কাছের আত্মীয়। একেবারে কাচা রক্তের বন্ধন হইতে আগত। চেহারায় বোকাসোকা ভাব আছে, কথা বলে কম। বলিবে কি, সে যে কথা বলিতে শুরুই করেছে সাত কি আট বছর বয়সে। পড়াশোনা করেনি। আমি এরে কুমিল্লায় লইয়া আসি। অশোকতলার ইসহাক সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়েও একদিন প্রত্যুষে ভর্তি করাইয়া দেই। আমার চোখে যেই ছেলে বেকুব সেই ছেলেই নাকি তলে তলে মারাত্মক দুরন্ত। তো মারাত্মক দুরন্ত প্রকৃতির এই ছেলে শুধুমাত্র পড়াশোনার কথাতেই বোবা হইয়া যায়। আমি কিছুতেই তাহাকে স্কুলিং করাইতে পারিলাম না। বইপত্র হাতে লইয়া সে নিয়ম করিয়া স্কুলের পানে বাহির হইয়া যায়, বাহিরেই নাকি সময় কাটায়। স্কুলের ধারে কাছেও তাহার কোন পদচিহ্ন পড়িয়া থাকিতে দেখা যায় না। ফলে এক সময় হতাশ হইয়াই তাহাকে আমার সাথে ঢাকা লইয়া আসি। আমার সাথেই রাখি। আমার পেশার সাথে সে যুক্ত হইতে পারিলে আর যাহাই হউক, বার্বির জীবন তাহাকে বাছিয়া নিতে হইবে না নিশ্চিত। এইভাবে মাস ছয়েক সে ছিল ভালই। তারপরে আমাদেরই ( সেই অর্ধাংশ ) অন্য একটা পরিবারে দরকার হইয়া পড়ে নতুন একটা বার্বির। তাহারা তাহাকে ফুঁসলাইয়া নিয়ে গেল তাহাদের আয়েশী কোঠায়। সেইখান হইতে তারে আজ পর্যন্ত বের করা গেল না। দুই বোনের, দুই জা, দুই সংসারে পালা করিয়া সে বার্বির অভিনয় করিয়া যাইতেছে, করিয়া-ই যাইতেছে। যাহাদেরই বাচ্চা কাচ্চার আদর আপ্যায়নের বা স্কুলিং এর ক্ষেত্রে বডি গার্ডের দরকার হয় তাহারাই তাহাকে রিক্রুট করিয়া লয় । কেহই তাহার মত অনুগত গোলামকে একেবারেও হাতছাড়া করিতে চাহিল না। তাহার বর্তমান কাজ হইতেছে ঘর ঝাড়ু দেওয়া, রোগীর সেবা করা, বিভিন্ন ফাই ফরমায়েশ পালন করা। এই বার্বির জন্য অনুতাপ আর মায়া আমার দুই-ই ছিল, আছে, থাকিবে। তাহাকে যখন এখানে লইয়া আসি, আমি সত্যিই জানিতাম না সে-ই আমাদের পরবর্তী বার্বি। আমি মনে করেছিলাম, তাহাকে মানুষের মত মানুষ করিয়া তুলিব। আমি জানিতাম না অমানুষের পক্ষে কাউকে মানুষ করার স্বপ্ন দেখাও হাস্যকর, তাই না ?

সুদীপ, পরিশেষে লিখিলো- আমরা সবাই বার্বি। জীবনের কোন না কোন চক্রে মানুষকে একবার হইলেও বার্বির জীবন পার করিতে হয়। জীবনের সাত পাক কিংবা সাত চক্র বিনা উপদ্রবে পার করিবেন ? কখনোই তাহা সম্ভব নহে। বাধা পরিবেন। হয় চক্রে নয়তো কোনো পাকের বক্রে। একেই হয়তো জীবন বলে। সুদীপ তাহার খাতা বন্ধ করিলো।
বেভারলি হিলস।

লেখক: ডা.জাকারিয়া চৌধুরী , নির্বাহী সম্পাদক ,দেশ জনতা ডটকম