অটো রাইস মিলের মালিক বলায় খেপলেন খাদ্যমন্ত্রী, চাইলেন পদত্যাগ করতে

আপডেট: সেপ্টেম্বর ৩০, ২০২১
0

খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদারকে অটো রাইস মিলের মালিক বলায় তিনি ক্ষিপ্ত হয়ে পদত্যাগ করতে চেয়েছেন। বৃহস্পতিবার খাদ্য অধিকার বাংলাদেশ আয়োজিত এক ওয়েবিনারে চালের দাম বেশি হওয়ার কারণ হিসেবে অটো রাইস মিলগুলোর ভূমিকাকে কয়েকজন দায়ী করেন। বাজারে অদৃশ্য শক্তির ভূমিকা নিয়ে কথা ওঠে। এ সময় বাংলাদেশ ভূমিহীন সমিতির সভাপতি সুবল সরকার বলে ওঠেন, ‘মন্ত্রী নিজেই তো অটো রাইস মিলের মালিক।’

‘খাদ্য উৎপাদন, আমদানি ও বাজার পরিস্থিতি: প্রেক্ষিত খাদ্য অধিকার’ শীর্ষক ওয়েবিনারে সুবল সরকার ওই অভিযোগ তোলার পর মন্ত্রী সঙ্গে সঙ্গে বলেন ওঠেন, ‘এটা কে বলেছেন, দয়া করে সামনে এসে বলেন। ফ্রন্টে এসে বলেন।’ এ সময় আয়োজকদের পক্ষে সঞ্চালক খাদ্য অধিকার বাংলাদেশের সাধারণ সম্পাদক মহসীন আলী এ ধরনের কথা এ ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক নয় বলে মন্তব্য করেন।

তখন খাদ্যমন্ত্রী বলেন, ‘এ কথা যে বলেছে, তাকে সামনে আসতে হবে। প্রমাণ দিতে হবে। এই কথা পুরো অনুষ্ঠানকে কলঙ্কিত করেছে। আমার মনে হয়, সভা থেকে প্রস্থান করা উচিত। এই কলঙ্ক নেওয়ার চেয়ে আমার পদত্যাগ করা ভালো। আপনারা চাইলে আমি আজই পদত্যাগ করতে পারি।’

এ সময় মহসীন আলী ও সভার সভাপতি কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ সুবল সরকারকে ক্ষমা চাইতে বলেন। সুবল সরকার তখন তাঁর ক্যামেরা চালু করে বলেন, ‘আমি বলেছি, মন্ত্রী নওগাঁর লোক। তাঁর এলাকায় সবচেয়ে বেশি ধান-চাল হয়। সেখানেই সবচেয়ে বেশি চাল মজুত হয়। তাঁর এলাকায় সবচেয়ে বেশি চালকল। তাই এই কথা বলেছি। মন্ত্রী আমার কথায় মন খারাপ করলে আমি ক্ষমা চাচ্ছি।’

কাজী খলীকুজ্জামান আহমদ বক্তব্য প্রদানকারী সুবল সরকারকে ব্যক্তিগতভাবে চেনেন উল্লেখ করে বলেন, ‘ওনাকে আমি ব্যক্তিগতভাবে চিনি। দীর্ঘদিন ধরে মানুষের জন্য কাজ করছেন। উনি হয়তো ভুলবশত এই কথা বলেছেন। মন্ত্রীর কাছে উনি ক্ষমা চেয়েছেন। মাননীয় মন্ত্রী, আপনি ওনাকে ক্ষমা করে দেবেন, আশা করি।’

এরপর খাদ্যমন্ত্রী শান্ত হন। নিজের বক্তব্যের শুরুতেই মন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার বলেন, ‘আমার এলাকায় সবচেয়ে বেশি চালকল, এটা ঠিক নয়। দিনাজপুর, বগুড়ায় সবচেয়ে বেশি চালকল। আর আমি কৃষক। আমার পরিবারের সবাই কৃষক। তবে আমি প্রশ্নবাণে জর্জরিত হয়েছি। বলা হয়েছে, আমাদের সঙ্গে কৃষি মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ের অভাব আছে। এটা ঠিক নয়। আমাদের মধ্যে কোনো সমন্বয়ের অভাব নেই। তবে এটা স্বীকার করতে হবে, কিছুটা তথ্যবিভ্রাট আছে। মন্ত্রী হিসেবে আমাকে স্বীকার করতে হবে।’

খাদ্যমন্ত্রী আরও বলেন, ‘প্রায়ই সাংবাদিকেরা আমাকে প্রশ্ন করেন, চালের দাম বাড়ল কেন। তাঁদের জন্য আমি বলতে চাই, ২০১৭ ও ২০১৮ সালে চালের কোনো আমদানি শুল্ক ছিল না। ফলে চালের দাম কম ছিল। আমরা ২০১৯ সালে দায়িত্ব নেওয়ার পর চাল আমদানি নিরুৎসাহিত করতে ৬২ শতাংশ শুল্ক আরোপ করি। তখন কথা উঠল, চাল রপ্তানি করতে হবে। দরকার হলে ব্যবসায়ীদের ভর্তুকি দিয়ে রপ্তানি করতে হবে। আমরা খাদ্য মন্ত্রণালয় থেকে চিঠি দিয়ে রপ্তানি বন্ধ করেছি।’

খাদ্যমন্ত্রী বলেন, ‘২০২০ সালে আমরা লক্ষ্যমাত্রার ৭০ শতাংশ সংগ্রহ করতে পারিনি। আমনের ১২ শতাংশ মাত্র সংগ্রহ করতে পেরেছি। পরে আমরা সরকারিভাবে ১১ লাখ টন আমদানি করার চুক্তি করেছি। এবার ১৭ লাখ টন চাল আমদানির অনুমতি দিয়েছি। আমাদের ২০ হাজার চালকল রয়েছে। ৭০০ থেকে ৮০০ চালকল সারা বছর চালু থাকে। বাকিগুলো রুগ্‌ণ হয়ে যাচ্ছে। যাঁরা সব সময় চালান, তাঁদের আমরা তদারকির মধ্যে রেখেছি। শর্ষের মধ্যে অনেক ভূত রয়েছে। পাইকারেরা চালান পরিবর্তন করে দাম বাড়িয়ে দেন।’

খাদ্যমন্ত্রী এরপর বলেন, ‘আমাদের দেশের ব্যবসায়ীদের সততার অভাব রয়েছে। তাঁদের মধ্যে মানবতার চেয়ে লাভের প্রতি বেশি লোভ রয়েছে। বাজার তদারকি করতে হলে মূল্য কমিশন করতে হবে। তাঁদের মধ্যে চালের বাজারদর নির্ধারণ করা উচিত। মাঠপর্যায়ে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের আরও সক্রিয় হতে হবে। সততা ও নিষ্ঠার মধ্যে থেকে নিজেকে দুর্নীতিমুক্ত রেখে আমি কাজ করছি। আমাদের চেষ্টার ত্রুটি নেই। কৃষি মন্ত্রণালয় তাঁদের বিষয়গুলো দেখবে, আশা করি।’

ভার্চ্যুয়াল এই ওয়েবিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বাংলাদেশ কৃষি সাংবাদিক ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সাহানোয়ার সাইদ শাহীন। তিনি বলেন, চাল-গমসহ খাদ্যশস্য উৎপাদন বাড়লেও জনসংখ্যার তুলনায় খাদ্যচাহিদা কতটুকু, তা যৌক্তিকভাবে নির্ধারণ করা নেই। বর্তমান উৎপাদন ও ব্যবহারের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনাও সুবিন্যস্ত নয়। ত্রুটি রয়েছে খাদ্য উৎপাদন, আমদানি ও ব্যবসায়, যা দূর করা অত্যন্ত জরুরি।

সম্মানীয় অতিথির বক্তব্যে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক মো. শাহজাহান কবীর বলেন, ‘দেশে চালের উৎপাদন বেড়েছে এবং আমদানিও কম করতে হচ্ছে। গম উৎপাদন চাহিদার তুলনায় কম হওয়ায় প্রায় ৬০ লাখ মেট্রিক টন গম আমদানি করতে হয়। ২০১০ সাল থেকে আমরা খাদ্যে, অর্থাৎ চালে উদ্বৃত্ত উৎপাদন করে যাচ্ছি। তারপরও বাজার নিয়ন্ত্রণের জন্য আমাদের চাল আমদানি করতে হয়। যদিও বাজারে অদৃশ্য হাতের কারণে মাঝেমধ্যে দাম বৃদ্ধি পায়, সংকটের সৃষ্টি হয়।’

ইউএনডিপি, বাংলাদেশের প্রধান অর্থনীতিবিদ নাজনীন আহমেদ বলেন, ‘সাম্প্রতিক সময়ে কৃষিতে সাফল্য এসেছে। কারণ, সরকার কৃষি গবেষণায় যথেষ্ট মনোযোগ দিয়েছে। তবে বাজারে আমরা খাদ্যশস্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণ করতে পারছি না। দেশের বড় ৫০টি অটো রাইস মিলের হাতেই থাকে বেশির ভাগ চালের মজুত। ফলে প্রচলিত আইন না ভেঙেই তারা চালের বাজার নিয়ন্ত্রণে বড় প্রভাবক হিসেবে কাজ করছে। ফলে এ মজুত আইনের সংশোধনের ব্যাপারে উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। প্রণয়ন করতে হবে খাদ্য অধিকার আইন।’

সভাপতির বক্তব্যে কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ বলেন, বাংলাদেশে শুধু খাদ্য নয়, সব বিষয়েই তথ্য নিয়ে নানা ধরনের বিভ্রান্তি রয়েছে, সেটি দূর করার উদ্যোগ সরকারকেই নিতে হবে। মূল্য কমিশন গঠিত হলেও তাদের সুপারিশ যথাযথভাবে হবে, সে নিশ্চয়তা দিতে হবে।