আইনের সুশাসন প্রতিষ্ঠা ও ন্যায় বিচার উপযোগী সমাজ গড়তে আন্দোলনের বিকল্প নেই- বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ

আপডেট: জুন ২, ২০২১
0

নারী ও কন্যা নির্যাতন এবং সামাজিক অনাচার প্রতিরোধ জাতীয় কমিটির উদ্যোগে ‘‘সংবিধান, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও সাংবাদিক রোজিনা ইসলামের নিগ্রহ’’ বিষয়ে অনলাইন মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে।
১ জুন, ২০২১ মঙ্গলবার নারী ও কন্যা নির্যাতন এবং সামাজিক অনাচার প্রতিরোধ জাতীয় কমিটির উদ্যোগে ‘‘সংবিধান, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও সাংবাদিক রোজিনা ইসলামের নিগ্রহ’’ বিষয়ে অনলাইন মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় মডারেটরের দায়িত্ব পালন করেন নারী ও কন্যা নির্যাতন এবং সামাজিক অনাচার প্রতিরোধ জাতীয় কমিটির চেয়ারপারসন ব্যারিস্টার এম. আমীর-উল ইসলাম।

লিখিত বক্তব্য উপস্থাপন করেন জাতীয় কমিটির সদস্য ও বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সাধারণ সম্পাদক অ্যাড.মাসুদা রেহানা বেগম। মতবিনিময় সভায় আরো বক্তব্য রাখেন নারী ও কন্যা নির্যাতন এবং সামাজিক অনাচার প্রতিরোধ জাতীয় কমিটির আহ্বায়ক ও বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি ডা.ফওজিয়া মোসলেম, জাতীয় কমিটির সম্মানিত সদস্য বিচারপতি নিজামুল হক নাসিম, মানবাধিকার কর্মী অ্যাড.সুলতানা কামাল, মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক, সাংবাদিক অজয় দাশগুপ্ত, জাতীয় প্রেসক্লাবের সভাপতি ফরিদা ইয়াসমিন, সাংবাদিক বাসুদেব ধর, অধ্যাপক ড. শাহনাজ হুদা, অধ্যাপক তাসলিমা ইয়াসমিন, আদিবাসী নেতা সঞ্জীব দ্রং, রাষ্ট্র বিজ্ঞানী ড. রওনক জাহান, ডা. রশিদ-ই -মাহবুবসহ জাতীয় কমিটির অন্যান্য সদস্যবৃন্দ।

সভায় সামাজিক অনাচার প্রতিরোধ জাতীয় কমিটির আহ্বায়ক ও বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি ডা.ফওজিয়া মোসলেম বলেন, সমাজে সামাজিক ন্যায়বিচার না থাকলে মানবাধিকার লংঘনের ঘটনা ঘটতে থাকে। সাংবাদিক রোজিনার প্রতি সংঘটিত ঘটনাটিও তেমন। আমাদের আন্দোলনের দুই ধরণের ধারাকে দেখতে হবে। এধরণের ঘটনা বন্ধে দীর্ঘমেয়াদী আন্দোলন চালিয়ে যেতে হবে। ঘটনার প্রতিহত করতে দীর্ঘমেয়াদী আন্দোলন চালিয়ে যেতে হবে। আমরা ন্যায়বিচারহীন প্রতিহিংসামূলক একটি সমাজ দেখছি। আইনের সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে, ন্যায়বিচারের উপযোগী সমাজ গড়ে তুলতে সামাজিক প্রতিরোধ কমিটিসহ সকলকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে আহ্বান জানান তিনি।


জাতীয় কমিটির সম্মানিত সদস্য বিচারপতি নিজামুল হক নাসিম বলেন, মহিলা পরিষদের প্রতি শ্রদ্ধা আজীবন ধারণ করি। প্রথম আলোয় ৩০ মে প্রকাশিত বিচারপতি আব্দুল মতিন স্যারের লেখা সর্বত্র প্রচার করার অনুরোধ জানান তিনি। উনার লেখা আজকের সভায় উপস্থাপন করা হলো এরপর আর কিছু বলার থাকে না। এটা নারী-পুরুষের প্রশ্ন নয় বরং মানুষের অধিকারের প্রশ্ন, সত্য জানার প্রশ্ন।

জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক বলেন, আমরা আমাদের সংবিধানকে ভুলে গেছি, স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রকে ভুলে গেছি। আইনের সঠিক প্রয়োগ নিয়ে কিভাবে সামনে এগিয়ে যাওয়া যায় সেলক্ষ্যে কাজ করতে হবে। সাংবাদিকদের মর্যাদা যাতে ক্ষুন্ন না হয় তারজন্য আইন প্রণয়নে কাজ করতে আ্হ্বান জানান তিনি।

মানবাধিকার কর্মী অ্যাড.সুলতানা কামাল বলেন, এ দেশের মালিক জনগণ।দূর্নীতিমুক্ত জীবন যাপনের অধিকার তাদের আছে। একজন সাংবাদিককে হেনস্তা কোনভাবেই গ্রহণয়োগ্য নয়। সংবিধানে বর্ণিত সামাজিক ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে হবে।

রাষ্ট্র বিজ্ঞানী ড. রওনক জাহান বলেন, সাংবাদিক রোজিনা অনেক অনুসন্ধানী প্রতিবেদন করেছেন। তার বিরুদ্ধে তথ্য চুরির অভিযোগ আনা হয়েছে। যে আইনে মামলা হয়েছে তা সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক হলে এটা কিভাবে হয়?

জাতীয় প্রেসক্লাবের সভাপতি ফরিদা ইয়াসমিন বলেন, তথ্য চুরির অপবাদ দিয়ে, তল্লাসির নামে একজন সাংবাদিককে হেনস্তা করা হয়েছে। সাংবাদিকদের সুরক্ষা আইন করতে হবে। সংবাদ মাধ্যমে স্বাধীনতা না থাকলে গণতন্ত্র, রাষ্ট্র এগোতে পারে না।

সভায় বক্তারা বলেন সাংবাদিক রোজিনা ইসলামের প্রকাশিত খবরগুলো অত্যন্ত বস্তুনিষ্ঠ। রোজিনা ইসলামকে ঝুঁকি নিয়ে কাজ করার জন্য ধন্যবাদ জানিয়ে তারা বলেন তার কাজটা অত্যন্ত প্রশংসার দাবি রাখে। হঠাৎ তার হেনস্তার খবর আমাদের হতবাক করে। যারা দেশের জন্য ভালো কাজ করে তাকে সরকার পুরস্কৃত না করে কেন হেনস্তা করল এনিয়ে প্রশ্ন তোলেন। তারা আরো প্রশ্ন তোলেন কেন সচিবালয়ের কর্মকর্তারা আইন নিজের হাতে তুলে নিল? সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক আইন গুলো রদ করতে করণীয় সম্পর্কে, সামাজিক অনাচারের প্রেক্ষিত থেকে বক্তারা বলেন রাষ্ট্র পরিচালকরা দুর্নীতিতে শূন্য সহনশীলতার কথা বললেও বাস্তবে ভিন্ন চিত্র দেখা যাচ্ছে। দুর্নীতি প্রতিরোধেএদেশের জনগণের দায় আছে, সংবিধান অনুযায়ী প্রত্যেকে কাজ করতে পারে। এখানে বাংলাদেশ এক লজ্জাজনক অবস্থায় আছে। আমাদের রাস্ট্র এখনো নাগরিকের রাষ্ট্র হতে পারেনি। সাংবাদিকদের দায়িত্ব থাকে সমাজের অসঙ্গতিগুলো সকলের সামনে তুলে ধরা। অথচ এখানে কাজ করতে যেয়ে অনাচারের দিকটি দেখা যাচ্ছে। তথ্য গোপনীয়তা তারা কার স্বার্থে করছেন? আইন হাতে তুলে নেয়ার মত ঘটনা ঘটছে কেননা রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের দুর্নীতিগ্রস্তরা বারবার একই ঘটনা ঘটিয়ে পার পেয়ে যায়। এই ঘটনায় সাংবাদিক সমাজ তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে।

তথ্যচুরির অপবাদে যে আইনের ধারায় মামলা করা হয়েছে তা অত্যন্ত সাংঘর্ষিক। এই ঘটনায় নারী নির্যাতনের দিকটিও এসেছে। একজন সাংবাদিক যেকোনো উপায়ে তথ্য সংগ্রহ করতে পারেন জনগণের স্বার্থে। তারা আরো প্রশ্ন করেন গণমাধ্যম ছাড়া কোন সমাজ কি অগ্রসর হতে পারবে? গণমাধ্যম হলো রাষ্ট্রের সহায়ক শক্তি। গণমাধ্যমের স্বাধীনতা রক্ষার জন্য প্রত্যেকেই ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে। বাংলাদেশে আদিবাসী, পাহাড়ি মানুষের উপরে যখন নির্যাতন হয় তখন সাংবাদিকও নিরাপদ নয়।যাদের মানুষের সেবা দেওয়ার কথা তারা মানুষকে নির্যাতন করছে। রাষ্ট্র যদি নাগরিকের প্রতি অবিচারের ঘটনায় মর্মাহত না হয় তবে সেই রাষ্ট্র কিভাবে সকলের জন্য কল্যাণকর হবে। রিমান্ডের নামে ভয়ভীতি দেখিয়ে তথ্য আদায় স্বাভাবিক আচরণ নয়।এবিষয়ে আইন মন্ত্রণালয়কে আরো কাজ করতে হবে। সাংবাদিকদের প্রতি নানা সময়ে সংঘটিত ঘটনার উল্লেখ করে বক্তারা বলেন, ঘটনার সত্যপ্রকাশে গণমাধ্যম সবসময় তৎপর থাকে। এটা কি রাষ্ট্রের জন্য হুমকি হতে পারে, দেশদ্রোহীতার কাজ হতে পারে। অনুসন্ধানী প্রতিবেদনগুলো সবসময়ই সরকারের জন্য সহায়ক হয়। রোজিনার জামিনের বিষয়টি যখন আসল তখন কেন রিমান্ডের প্রশ্ন আসলো এটি আমাদের ভাবায়। সরকার এবং গণমাধ্যমকে মুখোমুখি দাড় করিয়ে দেয়ার জন্য সরকারী কর্মকর্তাদের কেউ কেউ তৎপর কিনা সেটা দেখতে হবে। আইনী প্রক্রিয়ার মাধ্যমে রোজিনাকে কিভাবে মুক্তি দেয়া যায় সেবিষয়ে আরো কাজ করতে হবে। অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা মানে সরকারের বিরোধীতা করা নয়। ১৯২৩ সালের প্রচলিত ব্রিটিশ আইনের সমালেচনা করে বলেন গণমাধ্যমের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে আইনটি সাংঘর্ষিক । আইন কাঠামোকে সংশোধন করতে কাজ করতে হবে। বিভিন্ন আইনের আওতায় কিভাবে সাংবাদিকদের সুরক্ষা দেয়া যায় সেলক্ষ্যে কাজ করতে হবে।

সভার মডারেটর নারী ও কন্যা নির্যাতন এবং সামাজিক অনাচার প্রতিরোধ জাতীয় কমিটির চেয়ারপারসন ব্যারিস্টার এম. আমীর -উল ইসলাম বলেন, বৃটিশ শাসনামলে প্রণীত অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট,১৯২৩ অনেক পুরাতন আইন। ৩৯-২ এর কথাগুলো ন্যায়সঙ্গত কিনা তা বিচার করবে আদালত। অনুচ্ছেদ ৩৯ কে বুঝতে হলে আমাদের বাকস্বাধীনতা কে বুঝতে হবে।আইনজীবীদের নিয়ে লিগ্যাল ডিফেন্স টিম করা প্রয়োজন।

লিখিত বক্তব্য উপস্থাপনকালে সহ-সাধারণ সম্পাদক অ্যাড.মাসুদা রেহানা বেগম বলেন, মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর গণপরিষদের প্রথম অধিবেশনে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ১৯৭২ সালের ৪ঠা নভেম্বর গৃহীত সংবিধানের তৃতীয় ভাগে বর্ণিত হয়েছে “মৌলিক অধিকার “। যার প্রথম অনুচ্ছেদ অর্থাৎ অনুচ্ছেদ -২৬(১) এ বলা হয়েছে- এই ভাগের বিধানাবলীর সহিত অসামঞ্জস সকল প্রকাশিত আইন যতখানি অসামঞ্জস্যপূর্ণ,এই সংবিধান প্রবর্তন হইতে বাতিল হইয়া যাইবে। গণমাধ্যম রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের অনুচ্ছেদ -৩৯ এ গণমাধ্যম ও সাংবাদিকদের দায়িত্ব পালনে স্বাধীনতার নিশ্চয়তা প্রদান করা হয়েছে। সম্প্রতি সাংবাদিক রোজিনা ইসলামের বিরুদ্ধে বৃটিশ শাসনামলে প্রণীত অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট,১৯২৩ এর অধীনে মামলা দায়ের হয়েছে। রাষ্ট্রকে গণমাধ্যম ও সাংবাদিকদের স্বাধীনভাবে, নির্ভয়ে দায়িত্ব পালনের পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও সাংবাদিকদের সুরক্ষা আইন প্রণয়নসহ বর্তমানে প্রচলিত নাগরিক অধিকার পরিপন্থী বলে বিবেচিত বিভিন্ন আইনের ধারা বিলোপের বিষয়ে উদ্যোগ গ্রহণ করবেন।

অনলাইন মতবিনিময় সভায় জাতীয় কমিটির সদস্য বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাড. এস. এম.এ সবুর, ডাকসুর সাবেক জিএস মাহবুব জামান, বিশিষ্ট চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. লতিফা শামসুদ্দিন, ড. সানজীদা আখতার, জাতীয় কমিটির সদস্য ও বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভাপতি রেখা চৌধুরী, সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু, যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক সীমা মোসলেম, লিগ্যাল এইড সম্পাদক সাহানা কবির, অর্থ সম্পাদক দিল আফরোজ বেগম, প্রশিক্ষণ-গবেষণা ও পাঠাগার সম্পাদক রীনা আহমেদ, আন্তর্জাতিক সম্পাদক রেখা সাহা, রোকেয়া সদন সম্পাদক নাসরিন মনসুর, বিভিন্ন প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সাংবাদিকবৃন্দ এবং সংগঠনের কর্মকর্তা উপস্থিত ছিলেন।
সভা সঞ্চালনা করেন সংগঠনের লিগ্যাল এ্যডভোকেসি ও লবি পরিচালক অ্যাড. মাকছুদা আখতার লাইলী।