আবাসিক এলাকায় বিপদজনক মিশ্র ব্যবহার দ্রুত বন্ধ করার আহবান বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের

আপডেট: জুন ৩০, ২০২১
0
file photo

নগর ব্যবস্থাপনায় সুশাসন প্রতিষ্ঠা ছাড়া নগরে বিস্ফোরণ ও অগ্নি দূর্যোগ এড়ানো সম্ভব নয়ঃ
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স (বি.আই.পি.)

রাজধানীর মগবাজারে বিস্ফোরণে ঘটনায় প্রাণহানি ও ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির ঘটনায় গভীর দুঃখ প্রকাশ করছে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স (বি.আই.পি.)। একইসাথে এই দূর্ঘটনার পেছনে নিরাপদ পরিসেবা প্রদানে সেবা সংস্থাসমূহের নজরদারির অভাব, ভবনে অনাবাসিক ও বাণিজ্যিক ব্যবহারের ক্ষেত্রে ভবন মালিক ও ব্যবহারকারীদের নিরাপত্তা সংক্রান্ত বিষয়ে উদাসীনতা, বিদ্যমান আইন ও বিধি-বিধান অনুসরণের গাফিলতির দায় আছে। ঢাকা শহরের মত জনবহুল ও অতি ঘন শহরের পরিকল্পনা ও উন্নয়ন ব্যবস্থাপনায় পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনার যে ধরনের মানদণ্ড অনুসরণ করতে হয়, তার অনুপস্থিতি বহুলাংশে দায়ী। একটি শহরকে নিরাপদ করে গড়ে তুলতে প্রাতিষ্ঠানিক ও ব্যক্তি পর্যায়ে যে রকম প্রচেষ্টা থাকা প্রয়োজন তা এখানে নেই।

যে সকল শহর বৈশ্বিক বাসযোগ্যতার সূচকে সামনের দিকে অবস্থান করে থাকে, তারা তাদের নগরের ভৌত পরিকল্পনার পাশাপাশি নগর ব্যবস্থাপনার দিকে অত্যন্ত গুরুত্ব প্রদান করে হয়ে থাকে। একথা অনস্বীকার্য যে ঢাকা শহরের অধিকাংশ এলাকা অপরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠেছে এবং ঢাকা শহরের ব্যবস্থাপনায় নগর পরিকল্পনার প্রকৃত অনুশীলন করবার মত সুযোগ সীমিত। এই বাস্তবতায় ঢাকা শহরের বাসযোগ্যতা নিশ্চিত করতে নগর ব্যবস্থাপনা ও নগর সংস্থাসমূহের সুশাসন প্রতিষ্ঠায় অত্যধিক গুরুত্ব দেবার কোন বিকল্প নেই। অথচ দুঃখজনক বাস্তবতা হচ্ছে, নগর ব্যবস্থাপনা ও নগর সংস্থাসমূহের সুশাসনে প্রবল ঘাটতির কারণে ঢাকা শহরে অগ্নি দূর্ঘটনা, বিস্ফোরণ, ভবন ধসের মত দূর্যোগ দিনের পর দিন বেড়েই চলছে।

অল্প সংখ্যক পরিকল্পিত এলাকা ব্যতীত পুরাতন ঢাকার মত বসবাসের জন্য বিপদজনক এলাকা এখন তৈরী হয়েছে ঢাকা শহরের বিভিন্ন এলাকায়। মোহাম্মদপুর, মিরপুর, যাত্রাবাড়ি, খিলগাঁও, মগবাজার, হাজারীবাগ সহ নগরের ঝূঁকিপূর্ণ এলাকা নগর এলাকার সর্বত্রই ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। আবাসিক ভবনে অতি ঝূঁকিপূর্ণ মিশ্র ব্যবহার নগর এলাকার মানুষের জীবনকে ঝূঁকির মধ্যে ফেলেছে মারাত্মকভাবে। মানুষের জীবনের সর্বাংগীণ নিরাপত্তা দেবার যে মহান অভিপ্রায় নিয়ে বিশ্বে নগর পরিকল্পনার চর্চা শুরু হয়েছিল, যথাযথ ব্যবস্থাপনা ও নগর সুশাসনের অভাবে বিপদজনক মিশ্র ব্যবহারের মাধ্যমে মানুষের জীবন ও জীবিকা এখন মারাত্মক ঝুঁকির সম্মুখীন।

পৃথিবীর দেশে দেশেই নগর পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনার সাফল্যের মূলে আছে নগর সংস্থাসমূহের আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা এবং সাধারণ নাগরিকদের আইন মানতে বাধ্য করবার জন্য প্রয়োজনীয় আইনি কাঠামো তৈরী করা এবং তদনুযায়ী পরিকল্পনা ও এতদসংশ্লিষ্ট আইনের কঠোর বাস্তবায়ন করা। এক্ষেত্রে পরিকল্পনার অনুশাসন ও আইন ভংগকারী নাগরিকদের যেমন দৃষ্টান্তমূলক জরিমানা ও দণ্ড প্রয়োগ করা হয়, তদ্রুপভাবে নগর সংস্থাসমূহের গাফিলতি থাকলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের তদন্ত ও বিচারের আওতায় এনে দৃষ্টান্ত স্থাপন করা হয়, যেন ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি না হয়। অথচ আমাদের দেশে এ ধরনের দূর্ঘটনার ক্ষেত্রে তদন্ত কমিটি করা হলেও দোষী ব্যক্তি, ভবন মালিক কিংবা দায়িত্বে অবহেলাকারী নগর সংস্থার সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গদের এ ধরনের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেবার নজির নেই বললেই চলে।

বরং এ ধরনের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষসমূহের দায় এড়ানোর জন্য তদন্ত রিপোর্টকে প্রভাবিত করবার নজির দেখা যায় প্রতিনিয়ত। নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লার পশ্চিমতল্লার মসজিদে বিস্ফোরণসহ সাম্প্রতিক এ ধরনের ঘটনায় এই দৃশ্যের পুনরাবৃত্তি দেখা যাচ্ছে। মগবাজারের বিস্ফোরণের ঘটনাতে নির্মোহ তদন্তের পূর্বেই বিভিন্ন সেবা সংস্থার দায় এড়ানোর বক্তব্য দেখা যাচ্ছে। আমাদের ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর এ ধরনের বিস্ফোরণ বা অগ্নি ঘটনার ক্ষেত্রে আন্তরিকতার সাথে সাধ্যমতো কাজ করবার চেষ্টা করে থাকে; অথচ সেবা সংস্থাগুলো যদি আন্তরিকভাবে নজরদারি করতো এবং তাদের উপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করতো তাহলে এ ধরনের অনেক দূর্ঘটনাই এড়ানো সম্ভবপর হত। উপরোক্ত বাস্তবতায় ভবিষ্যতে এ ধরনের ভয়ংকর ঘটনা এড়ানোর জন্য বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স (বি.আই.পি.) নিম্নের প্রস্তাবনাগুলো তুলে ধরছেঃ

– ভবন সংশ্লিষ্ট সকল সেবা সংস্থাসমূহের নিয়মিত ভিত্তিতে প্রতিটি ভবন ও স্থাপনায় স্ব-স্ব পরিসেবা লাইন ও সংযোগসহ আনুষঙ্গিক পরিদর্শনপূর্বক নিয়মিত ভিত্তিতে প্রতিবেদন তৈরী করবার মাধ্যমে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ।
– ইমারতের পরিসেবা, অগ্নি নিরাপত্তা ও বসবাসের নিরাপত্তা সংক্রান্ত কারিগরী ব্যক্তিদের সুনির্দিষ্ট সংস্থা ও পেশাজীবিদের সংস্থা দ্বারা নিবন্ধনের মাধ্যমে নিবন্ধিত ব্যক্তিদের মাধ্যমে পরিসেবা সংশ্লিষ্ট সেবা প্রদান ও তত্ত্বাবধান নিশ্চিত করা।
– ভবন ও স্থাপনার মালিক ও তত্ত্বাবধানকারী ব্যক্তি বা কর্তৃপক্ষ উপযুক্ত পেশাজীবি ও কারিগরি ব্যক্তিদের পরিবীক্ষণ সাপেক্ষে পরিসেবা লাইন ও সংযোগসহ অগ্নি নিরাপত্তা ও বসবাসের নিরাপত্তা সংক্রান্ত আনুষঙ্গিক বিষয়ের প্রতিবেদন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে নিয়মিত ভিত্তিতে জমা দেবার উদ্যোগ গ্রহণ।

– নগর এলাকায় ভূমি ব্যবহার এর ক্ষেত্রে পরিকল্পনার ব্যত্যয় করে যে সকল অনুমোদনহীন ও বিপদজনক ব্যবহার বর্তমানে বিদ্যমান আছে, সেগুলো অপসারণপূর্বক যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
– বহুতল ভবনে কিংবা আবাসিক এলাকায় বিপদজনক মিশ্র ব্যবহার অতি দ্রুত বন্ধ করা এবং অনুমোদিত মিশ্র ব্যবহারের ক্ষেত্রে মান নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে কঠোর নজরদারি করা।
– গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানি প্রভৃতি পরিসেবা সংশ্লিষ্ট নিম্নমানের যন্ত্র, পাইপ, উপকরণ প্রভৃতির উৎপাদন ও ব্যবহার কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা।
– গ্যাস সিলিণ্ডার, কম্প্রেসার প্রভৃতি ব্যবহারের জন্য কঠোর নীতিমালা তৈরী করা এবং উপযুক্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা ও নিয়মিত তদারিক ও নজরদারি নিশ্চিত করবার জন্য উপযুক্ত পরিকাঠামো ও জনবল নিশ্চিত করবার জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করা।
– প্রাথমিক ও সেকেন্ডারি সড়কসহ নগর এলাকার সড়কসমূহের আশেপাশের ভূমি ব্যবহার গুলো বিশ্লেষণপূর্বক উপযুক্ত কর্মকৌশল গ্রহণের মাধ্যমে সড়ক নিরাপত্তা ও বসবাসের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।
– বিশ্বের আধুনিক শহরগুলোর ন্যায় স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলসমূহে বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষকে সমন্বয় করবার মাধ্যমে ওয়ার্ড কাউন্সিলসমূহকে শক্তিশালী করবার মাধ্যমে এলাকাভিত্তিক সামাজিক নজরদারি বৃদ্ধি করবার মাধ্যমে নগর এলাকার ঝূঁকি সমূহ চিহ্নিত করবার মাধ্যমে নগর ঝূঁকি হ্রাস করবার প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করা।
– নগরের বিভিন্ন পরিকল্পনা ও সেবা সংস্থার মধ্যে কার্যকর সমন্বয় নিশ্চিত করবার মাধ্যমে জনগণের জীবনের নিরাপত্তাকে প্রাধান্য দিয়ে বিভিন্ন পরিকল্পনা ও উন্নয়ন কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স মনে করে, নগরের বসবাস নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে নগর সংস্থা, নাগরিক ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ সকলের সম্মিলিত দায়িত্ব ও কর্তব্য আছে। এ ক্ষেত্রে সঠিক পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার কোন বিকল্প নেই। আমাদের সাম্প্রতিক বিস্ফোরণ ও অগ্নি দূর্ঘটনাসমূহের নির্মোহ তদন্তের মাধ্যমে করণীয়গুলো ঠিক করতে পারলে এ ধরনের প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতি ভবিষ্যতে এড়ানো সম্ভব। এক্ষেত্রে নগর সংস্থা ও নাগরিকদের দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করবার উদ্যোগ সরকার ও রাষ্ট্রকেই নিতে হবে বলে মনে করে বি.আই.পি.।