আল্লাহর সৃষ্টিতে এমন শৃঙ্খলা রয়েছে যে ক্ষুদ্রতম কোনো অসঙ্গতি কেউ ধরতে পারবে না–সূরা মুলক (১-৫ আয়াত )

আপডেট: মার্চ ১৬, ২০২৪
0

সূরা মূলক মক্কায় অবতীর্ণ । এই সূরায় ৩০টি আয়াত রয়েছে। সূরাটিতে সৃষ্টির উৎস, তৌহিদ বা একত্ববাদের আলোচনা, বিশ্বজগতের বিস্ময়কর ব্যবস্থাপনা, পরকাল এবং পাপীদের কঠিন শাস্তি প্রসঙ্গে আলোচনা করা হয়েছে। প্রথমেই এই সূরার ১ ও ২ নম্বর আয়াতের তেলাওয়াত ও তর্জমা বর্ণনা করা হয়েছে। পার্সটুডে থেকে নেয়া ্এই তর্জমা দেশ জনতা ডটকমের পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো—

“বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম।”

“বরকতময় ও মহা মহিমান্বিত তিনি সর্বময় কর্তৃত্ব যাঁর হাতে এবং যিনি সর্ব বিষয়ে সর্বশক্তিমান।”

“যিনি সৃষ্টি করেছেন মৃত্যু ও জীবন, তোমাদেরকে পরীক্ষা করার জন্য- কে তোমাদের মধ্যে আমলের দিক থেকে উত্তম? তিনি পর্যক্রমশালী, ক্ষমাশীল।”

ধর্মীয় আলোচনার ক্ষেত্রে একটি বিষয় আমাদের সামনে স্পষ্ট থাকা দরকার। আর তা হলো- মানুষের পক্ষে আল্লাহর জাত বা প্রকৃতি উপলব্ধি করা সম্ভব নয়। এ কারণে পবিত্র কুরআনের বিভিন্ন সূরায় আল্লাহর কিছু গুণবাচক নামের পাশাপাশি ওই নামের সঙ্গে বিশ্বজগত ও মানুষের সম্পর্কের ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে এজন্য যে, কেউ যাতে একথা বলতে না পারে যে, আল্লাহ এই জগত সৃষ্টি করে তাকে ছেড়ে দিয়ে রেখেছেন।

বিশ্বজগতের ওপর আল্লাহ তায়ালার একচ্ছত্র সার্বভৌম ক্ষমতা ও মালিকানা রয়েছে এবং বিশ্বের প্রতিটি বস্তু আল্লাহর হুকুমের অধীন। কোনো ব্যক্তি বা বস্তু তাঁর শাসনক্ষমতা ও শক্তির বাইরে নয়। জগতে বিদ্যমান সবকিছু নিজের অস্তিত্ব নিয়ে টিকে থাকে একমাত্র তাঁরই ইচ্ছায় এবং তিনি ছাড়া সবকিছু ধ্বংসশীল।

বিশ্বজগতে আল্লাহ তায়ালা যা কিছু সৃষ্টি করেছেন সেগুলোর মধ্যে একমাত্র মানুষই বোধ শক্তিসম্পন্ন। তাকে যেমন কর্মের স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে তেমনি সে এই স্বাধীনতা ব্যবহার করে কোন্‌ পথ বেছে নেয় তা দেখার জন্য আল্লাহ তায়ালা মানুষকে পরীক্ষা করেন। জন্ম থেকে শুরু করে মৃত্যু পর্যন্ত মানুষ কর্মের এই স্বাধীনতা ভোগ করে। এই স্বাধীনতাকে সে কীভাবে ব্যবহার করে তার ওপর মানুষের মর্যাদা নির্ভর করে। সে যত মূল্যবান জিনিস বাছাই করে তার মর্যাদা তত বেড়ে যায়। এখানে উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে, আল্লাহর কাছে আমলের পরিমাণ গুরুত্বপূর্ণ নয় বরং নিয়ত বা আমলের উদ্দেশ্য গুরুতট্বপূর্ণ। সেইসঙ্গে আমল বা কর্মের গুণগত মান একজন মানুষের মর্যাদা নির্ধারণ করে দেয়।

এই দুই আয়াতের কয়েকটি শিক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে:

১- পৃথিবীর প্রতিটি শাসক ও শাসনক্ষমতা একদিন ধ্বংস হয়ে যাবে। একমাত্র যে শাসনের কোনো পতন নেই সেই অপরাজেয় শাসনব্যবস্থার নাম আল্লাহর সার্বভৌমত্ব।

২- মৃত্যু মানুষের জীবনের শেষ বা ধ্বংস নয় বরং মানুষের পার্থিব জীবনের শেষে পরকালীন জীবনে প্রবেশের জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্ধারিত বিধান।

৩- জীবন ও মৃত্যু মানুষকে পরীক্ষা করার জন্য আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে এক ধরনের উপকরণ যাতে জীবনের চড়াই উৎরাইয়ে বিশেষ করে সুখ ও দুঃখের দিনগুলোতে মানুষ ঠিক কোন পথ বেছে নেয় তা পরীক্ষা করা যায়।

এবারে সূরা মূলকের ৩ ও ৪ নম্বর আয়াতের তেলাওয়াত ও তর্জমায় যা বলা হয়েছে—–

“তিনি সৃষ্টি করেছেন স্তরে স্তরে সাত আকাশ। দয়াময় আল্লাহর সৃষ্টিতে তুমি কোন খুঁত দেখতে পাবে না; আবার তাকিয়ে দেখ, কোন ত্রুটি দেখতে পাচ্ছ কি?”

“অতঃপর তুমি বারবার দৃষ্টি ফেরাও, [তুমি দেখতে পাবে যে,] সেই দৃষ্টি ব্যর্থ ও ক্লান্ত হয়ে তোমার দিকে ফিরে আসবে। [কিন্তু তাতে তুমি কোনো ত্রুটি খুঁজে পাবে না]

মহান আল্লাহ মানুষকে অসীম সৃষ্টিজগত সম্পর্কে চিন্তাভাবনা ও গবেষণা করার আহ্বান জানিয়েছেন। এই দুই আয়াতে ভূপৃষ্ঠ, পাহাড়, জঙ্গল, সাগর-মহাসাগর, আকাশমণ্ডলী এবং ভূপৃষ্ঠে বিরাজমান অসংখ্য নিয়ামতরাজির দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকানোর আহ্বান জানিয়ে বলা হচ্ছে, তোমরা বারবার এগুলো সম্পর্কে চিন্তাভাবনা ও গবেষণা করে দেখো, মহাশক্তিধর আল্লাহ ছাড়া আর কারো পক্ষে কি এই অসীম বিশ্বজগত সৃষ্টি করা সম্ভব? অণু-পরমাণুর মতো আণুবিক্ষণিক পদার্থ থেকে শুরু করে বিশাল আসমান এবং কোটি কোটি গ্রহ-নক্ষত্র- এসব কিছুই সুনির্দিষ্ট ও সুবিন্যস্ত নিয়মে সৃষ্টি করা হয়েছে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, সৃষ্টিজগতের এই সুশৃঙ্খল বিন্যাসের বিষয়টি নতুন নতুন আবিষ্কারের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের সামনে নিত্যনতুন রূপে ধরা পড়ছে।

এখানে একটি কথা উল্লেখ না করলেই নয় আর তাহলো, বস্তুবাদীরা ধর্মকে মানুষের অজ্ঞতা ও কুসংস্কারের ফসল বলে মনে করে। তাদের ধারণা, জ্ঞান[বিজ্ঞানের উন্নতির ফলে মানবজীবন থেকে ধর্মের মূলোৎপাটন ঘটবে। কিন্তু তাদের সে ধারনা মিথ্যা প্রমাণ করে এই আয়াতে মানুষকে বেশি বেশি গবেষণা এবং বিশ্বজগতের বিস্ময় সম্পর্কে আরো বেশি জানার চেষ্টা করতে বলা হয়েছে যাতে আল্লাহর জ্ঞান ও ক্ষমতার প্রতি তার ঈমান আরো বেশি দৃঢ় ও মজবুত হয়। প্রকৃতপক্ষে এই দুই আয়াতে জ্ঞানী মানুষকে কাফির ও অবিশ্বাসীদের সামনে এই যুক্তি তুলে ধরতে বলা হয় যে, এত বিশাল বিস্ময়কর সৃষ্টি কি পরিকল্পনাহীন কোনো দুর্ঘটনার মাধ্যমে তৈরি হতে পারে?

এই দুই আয়াতের কয়েকটি শিক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে:

১- মহান আল্লাহ দয়া ও মায়া করে এই বিশ্বজগত সৃষ্টি করেছেন। কোনো সৃষ্টির প্রতি আল্লাহর এমন কোনো ঋণ ছিল না যে সেই ঋণের দায় শোধ করার জন্য তিনি এই জগত সৃষ্টি করেছেন। কিংবা কোনো সৃষ্টিই আল্লাহ তায়ালার এমন কোনো প্রয়োজন পূরণ করতে সক্ষম নয় যে, সেই প্রয়োজন পূরণ করার জন্য আল্লাহ বিশ্বজগত সৃষ্টি করেছেন।

২- আল্লাহর সৃষ্টিজগতে শ্রেষ্ঠতম শৃঙ্খলা বিরাজ করছে এবং এই সৃষ্টিতে ক্ষুদ্রতম কোনো অসঙ্গতি কেউ ধরতে পারবে না।

৩- ভূমিকম্প, বন্যা, ঘুর্ণিঝড় ও খরার মতো প্রাকৃতিক বিপর্যয়গুলোর দিকে মনযোগের সঙ্গে দৃষ্টি দিলে আমরা দেখতে পাবো, এসব বিপর্যয় আল্লাহর সৃষ্টিজগতে কোনো অসঙ্গতির কারণে হয়নি। বরং এটি এমন এক ব্যবস্থাপনা আমাদের সামনে তুলে ধরে যেখানে আমাদেরকে এসব বিপর্যয়ের কারণ চিহ্নিত করে নিজেদেরকে সেসবের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়ার উপায় বের করতে হবে। (তাওয়াশিহ)

এবারে সূরা মূলকের ৫ নম্বর আয়াতের তেলাওয়াত ও তর্জমা শোনা যাক:

“আর অবশ্যই আমি নিকটবর্তী আসমানকে সুশোভিত করেছি প্ৰদীপমালা দ্বারা এবং সেগুলোকে করেছি শায়তানের প্রতি নিক্ষেপের উপকরণ এবং তাদের জন্য প্রস্তুত রেখেছি জ্বলন্ত আগুনের শাস্তি।”

আগের আয়াতগুলোতে সপ্ত আসমানের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে যা থেকে সৃষ্টিজগতের বিশালতা এবং আসমানের স্তরে স্তরে সাজানো থাকা সম্পর্কে ধারনা পাওয়া যায়। এরপর এই আয়াতে বলা হচ্ছে: তোমরা খালি চোখে যে তারকারাজি দেখতে পাও তা আসমানের সর্বনিম্ন স্তরের নক্ষত্র যা রাতের আঁধারে তোমাদের জন্য চমৎকার আলো হয়ে ধরা দেয়। মিল্কি ওয়ে বা ছায়াপথ আল্লাহ তায়ালার এমনই এক বিস্ময়কর সৃষ্টি যা রাতের অন্ধকারে দেখে মানুষ চোখ জুড়িয়ে নেয়।

এমনকি যে উল্কাপিণ্ড প্রচণ্ড গতিতে ভূপৃষ্ঠের দিকে ধাবিত হয় সেগুলিও আল্লাহ তায়ালার আয়ত্বের বাইরে নয়। মহান আল্লাহ এসব উল্কাপিণ্ড দিয়ে যেসব শয়তানি শক্তি আসমানের খবরাখবর সংগ্রহের জন্য আড়ি পাততে চায় তাদেরকে আঘাত করেন। এর ফলে জ্বলন্ত উল্কাপিণ্ডের আঘাতে এসব শয়তান ভস্মিভূত হয়ে যায়। সূরা সাফফাতের ৭ ও ৮ নম্বর আয়াতে এই ঘটনার বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে।

সূরা মূলকের ৫ নম্বর আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:

১- বিশ্বজগতকে যেমন সুশৃঙ্খলভাবে সৃষ্টি করা হয়েছে তেমনি এই জগতের আলাদা সৌন্দর্য রয়েছে। মহান আল্লাহ এই আসমান ও জমিন সৃষ্টি করার সময় এগুলোর সৌন্দর্যের প্রতি বিশেষভাবে দৃষ্টি দিয়েছেন।

২- এই জগতে এমন কিছু শয়তানি শক্তি আছে যারা সৃষ্টির ব্যবস্থাপনায় প্রভাব বিস্তার করে তাতে অচলাবস্থা তৈরি করতে চায়। কিন্তু তারা আল্লাহ তায়ালার শক্তির সামনে পরাভূত হয় এবং জ্বলন্ত উল্কাপিণ্ডের আঘাতে ধ্বংস হয়ে যায়।

পার্সটুডে