একজন ডেমিয়েন একটা রাষ্ট্র এবং একটা চিরস্থায়ী চিরধ্বংসের গল্প

আপডেট: আগস্ট ২১, ২০২৩
0

ডা . জাকারিয়া চৌধুরী :

অশুভ অটিস্টিক ডেমিয়েন বা এন্টি ক্রাইস্ট এর জন্মের কথা অনেকেই জানতো। the women সিনেমায় দেখা যায় এন্টি ক্রাইস্ট এই প্রেতকে ঠেকানোর জন্য এমন কোন পথ বাকি রাখা হয়নি যতটুকু সম্ভব ছিল। শুভ সঙ্ঘ সব রকম পথেই এর জন্ম ঠেকানোর চেষ্টা করে গেছে অবিরাম। কিন্তু বিধি বাম। ইটালির বিখ্যাত এক চার্চে নিযুক্ত স্বয়ং এক পোপ এর জন্মের বিষয়টি তত্ত্বাবধান করে। সেই পোপ শিয়ালের গর্ভে জন্ম নেয়া শিশু ডেমিয়েনকে হসপিটালে অন্য শিশুর সাথে বদলে দেয়। জন্মসুত্রেই অশুভ এই প্রেত শিশু বিলিয়ন ডলারের মালিক বনে সোনার চামচ মুখে নিয়ে পালিত হতে থাকে। শুভ সঙ্ঘ ডেমিয়েনকে হারিয়ে ফেলে। মাত্র আট বছর বয়সে ডেমিয়েন তার পালিত মাকে হত্যা করে ভবিষ্যতের প্রথম পাগলা ঘন্টিটি বাজিয়ে নিজের পরিচয়ের জানান দেয়। চার্চে ঢং ঢং ঢং ঢং……… করে ঘন্টা বেজে উঠে বড্ড সময়ে।

এ কথাগুলো কিছুটা ‘শেষ অশুভ সংকেত’ বইটির মুখবন্ধের মত।

জানিনা কেন, আমি অন্তত শ’খানেক বার বইটি পড়েছি। যত না পড়েছি তার চেয়েও হাজার গুন সময় এর দিকে তাকিয়ে থেকেছি। বারবার-ই মনে হয়েছে আমি যেন সে চলচিত্রের কোন ভাসমান ছায়া। ছায়া হয়ে সব কিছু প্রত্যক্ষ করছি। প্রতিটা ক্ষনে যেমন ঘটনা বদলেছে তেমনি প্রতিমুহূর্তে আমিও যেন সেসবের স্বাক্ষি হয়ে কখনো ভুতের মত, কখনো যেন নিরব ছায়ার মত আবির্ভূত হয়েছি দৃশ্যায়নের স্থানে। আমি যেন হাত পা বিহীন শুধুই এক সত্ত্বা যে সব কিছু দেখেও কিছু করতে পারেনা, কিছু বলতে পারেনা। এমন অসহায় দুর্ভাগা এক অস্তিত্ব যে স্বপ্নেও ব্যাথা অনুভব করে চিৎকার করে উঠে। আমি কি বোকা !! বইয়ের গল্প পরে শিওরে উঠি। আতংকে অস্থির হয়ে দুয়ার জানালা বন্ধ করে সব কিছু থেকে মুক্তি পেতে চাই। মুক্তি মুক্তি মুক্তি। হায় মুক্তি, হায়রে সাধের মুক্তি।

ছোট বেলার অবেলা সময় গুলো কাটিয়েছি দিঘীর পাড়ের শন ক্ষেতের ধারে। চৈত্রের তাপ আর সেই তাপের ভাপে অল্প কিছুদিনেই শনেরা শুকিয়ে হলদে হয়ে যেত। আমার শৈশবের সেইসব ভাই আর তাঁদের বন্ধুরা গোপনে ম্যাচ নিয়ে হাজির হত শনের বনে। নিদারুন আনন্দে তারা সেখানে আগুন ধরিয়ে দিয়ে দিত । দাউ দাউ করে দাবানলের মত সে আগুন মুহূর্তেই ছড়িয়ে পড়ত সারা বনে। আমি কত যে চিৎকার করে বাধা দিয়েছি তার কোন হিসেব নেই। সব কিছুতেই আমার ভয়। আমি ভয়ে জমে যেতাম, ভাবতাম যদি এ আগুন সারা গ্রামে ছড়িয়ে পরে ?

সবাই হাসত। আমাকে বোকা এবং ভিতু বলে উপহাস করতো। কোন উপায় বুদ্ধি না পেয়ে কিছু কাচা গাছ ছিঁড়ে সে আগুনে ঝাঁপিয়ে পড়তাম। ঝাঁপিয়ে পড়তাম আগুন নেভানোর কাজে কিন্তু সে আগুন কখনো নিভেনি। মা অফিস থেকে ফিরে কাঁদো কাঁদো গলায় বলত- আহারে আহারে। আমার মানিকের সারা মুখ পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। তোরা কেউ তাকে দুরে নিতে পারলি না? সাথীরা হাসতে হাসতে উত্তর দিয়েছে- তোমার ছেলে জেনে শুনেই আগুনে ঝাপ দেয়। এখানে কার কি করার আছে !! আসলেই তো। আমি জেনে শুনেই আগুন নিয়ে খেলা করে গেছি অবিরাম। লাভের মাঝে শুধু মুখ আর মাথার অর্ধেক চুল পুড়ে যেত। আগুন নিয়ে খেলার অভ্যাস এই বুড়ো বয়সেও ছাড়তে পারিনি। এ এক সর্বনাশা নেশা। আপনি নেশা ছাড়লেই সে যে আপনাকে ছেড়ে চলে যাবে তার মানে নেই।

এই মহা সংসারে থরে থরে সাজানো আছে আমাদের জীবনের এইসব দিনরাত্রির লক্ষ কোটি গল্প। প্রতিটা গল্পেই আছে একটা করে ডেমিয়েন। এ গল্প গুলোর কিন্তু সিনেমাটিক এন্ডিং নেই। এ তো জীবনের গল্প। জীবনের গল্পের শেষে সবাই একসাথে মিলিত হয় না। এখানে যদি ছায়াছবির মত সুখে শান্তিতে বসবাসের মধ্যেই গল্পের সমাপ্তি টানা হত তাহলে তা আর মনের গহীনে স্থান করে নিতে পারত না। এখানে শুভ’রা সংখায় খুব কম বলেই হয়ত ভীষণ নিরাপত্তাহীন জীবন যাপন করে। এখানে ডেমিয়েনেরাই রাজা মহারাজা।

দলে ভারী। এরাই চিরসুখী জন। সংসারে তারা বীর, সমাজে তারা বীর। যদি কেউ গুনাক্ষরেও এই প্রশ্ন তুলে – ভাই, আপনি কি বীর? কিভাবে বীর হলেন ? তাহলেই হল। আপনি আগুনে ঝাপ দিলেন। এখন আপনার মুখ, চোখ সমেত পাপড়ি আর মাথার অর্ধেক চুল পুড়ে খাক হয়ে যাবে। এর পরবর্তী পর্বে শুরু হয়ে আপনার বিচার।

এখানে বাদী, আইনজীবী এবং বিচারক সকলেই এক একজন আস্ত এক একটা ডেমিয়েন। এমনকি আপনার নিযুক্ত আইনজীবীও মৌলিক স্বার্থের দোহাই তুলে সেই কাতারে নিজের নাম লিখাবে। আপনার সবচে আস্থাভাজন ব্যাক্তি যাকে আপনি সব কিছু খুলে বলেছিলেন সে-ই আপনার বিরুদ্ধে রায় লিখে ওদের হাঁতে তুলে দিবে। আপনি জানতেও পারবেন না আপনার প্রিয় লোকটি কখন কিভাবে একেবারে নামমাত্র মুল্যে বিক্রি হয়ে গেছে। নিজের দিকে তাকিয়ে দেখুন, এইবার আপনি এক জীবন্ত পাপেট।

আপনি কেবল চেয়ে চেয়ে দেখবেন এখানে একটা ষ্টেজ শো হবে। লাইভ। জীবন্ত পাপেট দিয়ে যে অসাধারন নাটক মঞ্চস্থ হবে, তার গিনিপিগ স্বয়ং আপনি। নাটক শেষে দর্শকেরা তুমুল করতালিতে পরিচালকদের ধন্যবাদ জানাবে। ক্লান্ত শ্রান্ত আপনার দিকে কেউ ফিরেও তাকাবে না। বরং নতুন নতুন আরেকটা পাপেট শো’র জন্য ব্যাপক গনদাবি তৈরি হবে। নতুন গল্পে নতুন শো। নতুন পুতুল খোঁজার কাজ এগিয়ে চলবে বিপুল বিক্রমে।

দিনশেষে পুতুল হিসেবে আবার আপনাকেই খুঁজে নেয়া হবে। এদিকে আমার মত বোকা কেউ এই সময়ে হয়ত কাচা গাছ দিয়ে অন্য কোন প্রান্তে আগুন নিভানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে নিয়ত। না, এ আগুন বাড়তে দেয়া যাবেনা কিছুতেই, এ আগুন বাড়তে দেয়া যাবেনা কিছুতেই- আপনি হয়ত মনে মনে বিরবির করেই যাচ্ছেন। আপনার সাথিরা এদিকে আপনার কান্ডে হয়ত তখন হেসে খুন। আগের পাপেটটা পাওয়া গেছে। নতুন গল্পের নতুন চরিত্র। স্টেজ শো জম্পেস হবে। নতুন স্টেজে নতুন শো। কি অপরূপ কি অপরূপ আজকের শো। পোড়া কপালের নতুন চরিত্র আর পুতুল দুটোই পাওয়া গেছে একসঙ্গে এবং বিনামুল্যে।

২১.০৮.২০২৩

লেখক: নির্বাহী সম্পাদক দেশ জনতা ডটকম