ওয়াটারকিপার্স বাংলাদেশ কনসোর্টিয়ামের আয়োজনে শ্যামপুর ডায়িং ইন্ডাস্ট্রি এবং নদী দূষণ শীর্ষক সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত

আপডেট: জানুয়ারি ১৯, ২০২২
0

১৮ জানুয়ারি, ২০২২ মঙ্গলবার:

ওয়াটারকিপার্স বাংলাদেশ এর আয়োজনে শ্যামপুর ডায়িং ইন্ডাস্ট্রি এবং নদী দূষণ শীর্ষক সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। মঙ্গলবার সকাল ১১:০০ ঘটিকায় শ্যামপুর ফায়ার স্টেশন ঘাট এলাকায় এই সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। রাজধানী ঢাকাকে দূষণের হাত থেকে রক্ষা করে একটি বাসযোগ্য নগরী হিসাবে গড়ে তুলতে দূষণবিরোধী শক্তিশালী নাগরিক প্রচেষ্টা বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে ইউএসএআইডি, এফসিডিও এবং কাউন্টারপার্ট ইন্টারন্যাশনালের সহায়তায় দূষণবিরোধী

অ্যাডভোকেসি প্রকল্প বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ওয়াটারকিপার্স বাংলাদেশ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগ এবং স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের বায়ুম-লীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস) কে সাথে নিয়ে একটি কনসোর্টিয়াম গঠন করেছে। এই দূষণবিরোধী অ্যাডভোকেসি কর্মসূচিটি ঢাকা শহরের বায়ু এবং শব্দ দূষণসহ বুড়িগঙ্গা নদীতে নৌযান কর্তৃক দুষণ, ডাইং কারখানা কর্তৃক দূষণ এবং ট্যানারি দূষণ মোকাবেলায় ঢাকা শহরের শব্দ এবং বায়ু দূষণ নিয়ন্ত্রণে স্থানীয় জনগোষ্ঠী, সরকারি সংস্থা এবং উন্নয়ন সহযোগিদের সাথে নিয়ে একত্রে দূষণ পরীবিক্ষণ এবং দূষণবিরোধী কার্যক্রম পরিচালনা করছে।

ওয়াটারকিপার্স বাংলাদেশ কনসোর্টিয়াম তার দুই বছর মেয়াদী দূষণবিরোধী নাগরিক প্রচেষ্টার অংশ হিসাবে শ্যামপুরের ডাইং কারখানার দূষিত বর্জ্য নির্গমণের স্থানগুলো থেকে পানির নমূনা সংগ্রহ করে যে গবেষণাকার্য পরিচালনা করছে সে গবেষণাকার্যের অংশ হিসাবে ওয়াটারকিপার্স বাংলাদেশ কনসোর্টিয়াম তার গবেষণালব্ধ ফলাফল প্রকাশের লক্ষ্যে বুড়িগঙ্গা নদী তীরে অবস্থিত ফায়ার সার্ভিস ঘাট, শ্যামপুর এ এই সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে। এই দূষণবিরোধী সংবাদ সম্মেলনে শ্যামপুর ডায়িং ইন্ডাস্ট্রি কর্তৃক নদী দূষণ সম্পর্কে কিছু বৈজ্ঞানিক তথ্যাবলী তুলে ধরা হয়।

ওয়াটারকিপার্স বাংলাদেশ এর সমন্বয়ক শরীফ জামিলের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এই সংবাদ সম্মেলনে মূল বক্তব্য উপস্থাপন করেন স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ এর পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার। সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা)’র সিনিয়র সদস্য হানিফ সহিদ, বুড়িগঙ্গা নদী মোর্চার অন্যতম সদস্য শিশুদের মুক্ত বায়ু সেবন সংস্থার মোঃ সেলিম, যুব বাপা কর্মসূচির সদস্য সচিব অ্যাডভোকেট রাওমান স্মিতা, যুব বাপা কর্মসূচির সদস্য দেওয়ান নূরতাজ আলম, ওয়াটারকিপার্স বাংলাদেশের প্রকল্প সমন্বয়কারী মোঃ কামরুজ্জামান এবং প্রকল্প পর্যবেক্ষক ও মূল্যায়ন কর্মকর্তা এম এম কবির মামুন।

সংবাদ সম্মেলনের মূল ব্যক্তব্যে অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার বলেন, শ্যামপুরের দূষণের বাস্তবিক অবস্থা বিচারে ওয়াটারকিপার্স কনসোর্টিয়াম বিভিন্ন ঋতুতে পানিতে প্রাপ্ত নয়টি ভিন্ন ভিন্ন রাসায়নিক উপাদান নিয়ে গবেষণা চালায়। পরবর্তিতে এক্সপ্লোরেটোরি স্ট্যাটিস্টিকাল পদ্ধতি ব্যবহার করে পানির রাসায়নিক উপাদানসমূহ বিশ্লেষণ করে পানির একটি গুনমান সূচক দাঁড় করানো হয়। চারটি ভিন্ন ভিন্ন ইন্ডেক্সিং পদ্ধতির মধ্য থেকে সবচেয়ে আধুনিক ও উপযোগী পদ্ধতি সিসিএমই ওয়াটার কোয়ালিটি ইন্ডেক্স ব্যবহার করা হয়। এই পদ্ধতি পানির গুনমানের ঋতুগত এবং স্থানিক পার্থক্যসমূহের বহুমাত্রিক কারণগুলি ব্যাখ্যা করে এবং এইভাবে এটি অন্যান্য পদ্ধতির তুলনায় নদীর পানির শ্রেণী এবং অবস্থা শ্রেণীবদ্ধ করার ক্ষেত্রে সুবিধাজনক। স্থানিক (ংঢ়ধঃরধষ) এবং কালিক (ঃবসঢ়ড়ৎধষ) প্রেক্ষাপটে পানির গুণমান সূচক (ডছও) গণনা করার জন্য ঈঈগঊ কৌশলটিতে জলের জৈব এবং অজৈব উভয় পরামিতি অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এই সূচকে পানির অবস্থা বিশ্লেষণে পানিকে পাঁচটি ভিন্ন ভিন্ন শ্রেণীতে ভাগ করা হয়। যার মধ্যে শ্যামপুরের পানি সবচেয়ে নিচের ক্যাটাগরি অর্থাৎ পুওর (ঢ়ড়ড়ৎ) ক্যাটাগরিতে অবস্থান করে।

পানির পিএইচ পরিমাপে দেখা যায়, শ্যামপুর ডায়িং ইন্ডাস্ট্রির পানিতে পিএইচের মান প্রাক বর্ষা, বর্ষা ও বর্ষা পরবর্তী মৌসুমে যথাক্রমে ৭.৬, ৬.৭ এবং ৮.৫। আমরা জানি পিএইচের আদর্শমান ৭ এর থেকে বেশি প্রদর্শন করলে তা ক্ষারধর্মী এবং কম প্রদর্শন করলে তা অম্লধর্মী। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, শ্যামপুরের পানি বর্ষার সময় অম্লীয় ধর্ম প্রদর্শন করে। এছাড়া বর্ষার পূর্বে এবং বর্ষার পরে সেই পানি ক্ষারীয় ধর্ম প্রদর্শন করে। শ্যামপুরের পানিতে টোটাল সাসপেন্ডেবল সলিডস এর পরিমাণ পরীক্ষা করে পাওয়া গেছে তিন ঋতুতে যথাক্রমে ১০৮, ৫৭ ও ১৯৫। পানিতে টিএসএস এর আদর্শ মান ১০। সুতরাং দেখা যাচ্ছে শ্যামপুরের পানিতে প্রচুর পরিমাণে টিএসএস বা টোটাল সাসপেন্ডেড সলিডস পাওয়া যায় যা পানিতে দ্রবীভূত হয় না এবং পানির নিচে নদীতলে পাতলা আস্তরণ সৃষ্টি করে যা জলজ উদ্ভিদের বিকাশকে বাধাগ্রস্থ করে।

প্রাকবর্ষা, বর্ষা এবং বর্ষা পরবর্তী সময়ে শ্যামপুরের পানিতে রাসায়নিক অক্সিজেন চাহিদা বা সিওডি এর পরিমাণ পরীক্ষা করে দেখা যায়, এই তিন ঋতুতে সিওডি এর পরিমান যথাক্রমে ১৯০, ২২৭ ও ২৭৬। যা আদর্শমান ৪ এর চেয়ে বহুগুণে বেশি। জৈবিক অক্সিজেন চাহিদা বা বিওডি এর পরিমান পরীক্ষা করে দেখা যায় ওই তিন সময়ে বিওডি এর পরিমান যথাক্রমে ৮৭,৭২, ও ১০৬, যা আদর্শমান ০.২ এর তুলনায় অত্যাধিক বেশি। সুতরাং বোঝা যাচ্ছে যে, শ্যামপুরের পানিতে রাসায়নিক ও জৈবিক উভয় প্রকার অক্সিজেন ডিমান্ড অত্যন্ত বেশি, যা এই পানিতে অক্সিজেনের পরিমাণ কম থাকাকে নির্দেশ করে।

পানিতে নাইট্রোজেনের অবস্থা বিশ্লেষণে দেখা যায়, তিনটি ঋতুতে শ্যামপুরের পানিতে অ্যাম্যোনিয়ার পরিমাণ ৪.৮, ৪.২, ও ২.৮ যা আদর্শমান ০.৫ এর চেয়ে বহুমাত্রায় বেশি। উচ্চমাত্রার অ্যাম্যোনিয়া শ্যামপুরের পানিতে নাইট্রোজেন দূষণকে নির্দেশ করে। অতিরিক্ত নাইট্রোজেন নদীর স্বাভাবিক বাস্তুতন্ত্রের জন্য দূষণীয়। শ্যামপুরের পানিতে অতিরিক্ত মাত্রায় তেল ও প্রিজ পাওয়া গেছে। পরীক্ষায় দেখা গেছে, তিনটি ভিন্ন ভিন্ন ঋতুতে শ্যামপুরের পানিতে তেল ও গ্রিজের পরিমাণ যথাক্রমে ২.৬, ১.৯, ও ৫.৬। পানিতে তেল ও গ্রীজের আদর্শমান ০.০১। তেল ও গ্রীজ নদীতে স্বাভাবিক আলো প্রবেশে বাধা সৃষ্টি করে এবং পানির উপরিভাগে একটি আস্তরণ তৈরি করে। এছাড়াও শ্যামপুরের পানিতে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে ফেনলের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়, তিন ঋতুতে যার মান যথাক্রমে ০.১৪, ০.৪৩৫ ও ০.২, যা আদর্শমান ০.০০২ এর তুলনায় বেশি। অতিরিক্ত মাত্রায় ফেনল শ্যামপুরের পানিকে করে তুলেছে আরো বিষাক্ত এবং পানের অনুপোযোগী। পানীয় জলে ফেনলের উপস্থিতি মানবদেহে বিভিন্ন অসুখ যেমন ডায়েরিয়া, লিভারে স্থায়ী সমস্যা প্রভৃতি দেখা দিতে পারে।

সম্মেলনে সভাপতির বক্তব্যে শরীফ জামিল বলেন, শ্যামপুরে বুড়িগঙ্গার পানির দূষণ পরীক্ষা করে দেখার দরকার পড়ে না। পানির দিকে তাকালেই দেখা যায় এর রং গোলাপী। আমরা শ্যামপুর ডায়িং এর রাসায়নিক দূষণের প্রতিবাদ করি। তবে আমরা চাই না ডায়িং শিল্প বন্ধ হোক। আমরা চাই টেকসই উন্নয়ন, আমরা চাই নদী আবার আগের রূপে ফিরে আসুক। এখন মানুষের কিডনী রোগ এবং ক্যান্সারের প্রবণতা বেড়ে গেছে এই দূষণের কারণে। এই সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে আমরা বলতে চাই অবিলম্বে নদী দূষণে দায়ী ডাইং কারখানার বর্জ্য সরাসরি নদীতে ফেলা বন্ধ করতে হবে; ডাইং কারখানাগুলোকে অবশ্যই বর্জ্য শোধনাগার স্থাপন করতে হবে; এবং জনস্বাস্থ্য ও জনস্বার্থ রক্ষায় সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ও উদ্যোক্তাদের নিয়ে অবিলম্বে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। বুড়িগঙ্গা আমাদের প্রাণ, বুড়িগঙ্গা ঢাকার প্রাণ, আর তাই ঢাকাকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে বুড়িগঙ্গা নদীকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে।

সংবাদ সম্মেলনে সংহতি বক্তব্য প্রদান করেন বুড়িগঙ্গা নদী মোর্চার অন্যতম সদস্য মোঃ সেলিম, বাপা’র সিনিয়র সদস্য হানিফ সহিদ এবং যুব বাপা কর্মসূচির সদস্যসচিব অ্যাডভোকেট রাওমান স্মিতা প্রমূখ।

এর আগে সকালে ওয়াটারকিপার্স বাংলাদেশ কনসোর্টিয়াম সদস্যবৃন্দ, বুড়িগঙ্গা নদী মোর্চার সদস্যবৃন্দ এবং বিভিন্ন গণমামাধ্যমের কর্মীরা দোলেশ্বর গুদারাঘাট থেকে নৌকা যোগে বুড়িগঙ্গার বিভিন্ন পয়েন্টে ডায়িং শিল্পের দ্বারা বুড়িগঙ্গার পানি দূষণের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করেন।