কৌশলে শতাধিক দুঃস্থের ভিজিএফ’র টাকা আত্মসাৎ করলো ইউপি মেম্বার

আপডেট: মে ১২, ২০২১
0

শাহজাহান আলী মনন, সৈয়দপুর (নীলফামারী) প্রতিনিধিঃ
পবিত্র ঈদুল ফিতর উপলক্ষে দুঃস্থ অসহায় গরীবের জন্য প্রধানমন্ত্রীর দেয়া ভিজিএফ’র টাকা আত্মসাৎ করেছে ইউপি মেম্বার। কৌশলে শতাধিক দুঃস্থের প্রায় ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকা হাতিয়ে নিয়েছে একজনই।

এমন ঘটনা ঘটেছে নীলফামারীর সৈয়দপুর উপজেলার বাঙ্গালিপুর ইউনিয়নে। ওই ইউনিয়নের ৭ নং ওয়ার্ড মেম্বার গত ১১ মে শতবর্ষী এক বৃদ্ধের অভিযোগের প্রেক্ষিতে হাতে নাতে ধরা পড়লেও তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেয়ায় অন্য মেম্বাররাও একই কৌশল অবলম্বন করছে। ফলে হাজার হাজার দুস্থ মানুষ সুবিধা প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হয়েছেন।

উপজেলার বাঙ্গালিপুর ইউনিয়নের মোঃ জাবেদ আলী জানায়, ৭ নং ওয়ার্ড মেম্বার মোঃ জুলফিকার আলী ভিজিএফ’র ৪৫০ টাকা দেয়ার জন্য আমার ও আমার স্ত্রীর জাতীয় পরিচয় পত্রের ফটোকপি (এনআইডি) ও এককপি করে ছবি নিয়েছে।

কিন্তু দেয়ার সময় শুধু আমার স্ত্রী কে টাকা দিয়েছে। আমারটা কেনো হলোনা জিজ্ঞাসা করায় মেম্বার বলে তোমারটা হয়নি। প্রতি পরিবারের একজনই পাবে। এতে আমার ছবি ও এনআইডি’র ফটোকপি ফেরত চাইলে তা দিতে অস্বীকার করেন। এমনকি তালিকায় আমার নাম আছে কিনা তাও দেখতে দেয়নি।

তিনি অভিযোগ করেন যে, এভাবে মেম্বার প্রায় সবার কাছ থেকেই ২:টি করে কাগজ ও ছবি নিয়ে একজনকে দিয়েছে আর অন্যজনেরটা তার লোকজনের মাধ্যমে তুলে আত্মসাৎ করেছে। এছাড়া একই নামে ২ টি স্লিপ দিয়ে তার লোকজনকে দিয়ে আগেই টাকা তুলে নেয়ায় পরে প্রকৃত দুস্থ উপকারভোগী এসে টাকা না পেয়ে ফেরত যাচ্ছে। তাদেরকে বলা হচ্ছে আপনার টাকা আগেই তোলা হয়েছে। কিন্তু একজনের হাতে স্লিপ থাকা সত্বেও টাকা অন্যজন কিভাবে কোন স্লিপে তুলে নিলো তার কোন জবাব দেয়া হচ্ছেনা।

এমনই অভিযোগ করেন ওই ওয়ার্ডের কাশেম আলী নামে একজন শতবর্ষী বৃদ্ধ। তিনি বলেন, আমার কাছ থেকে ২টি কাগজ ও ছবি নিয়ে শুধু আমার স্ত্রী নামে স্লিপ দিয়েছে। আমার স্ত্রী অসুস্থ হওয়ায় আমি অনেক কষ্ট করে ইউনিয়ন পরিষদে এসে প্রায় ২ ঘন্টা লাইনে দাঁড়িয়ে চরম ধাক্কাধাক্কির পর বুথে পৌছলে বলা হয় আমার টাকা আগেই তুলে নেয়া হয়েছে।

বাধ্য হয়ে বঞ্চিত হয়ে কাঁদতে কাঁদতে ফেরত যাওয়ার সময় এক যুবক আমার ঘটনা জেনে মেম্বারকে চ্যালেঞ্জ করে বুথে নিয়ে গিয়ে ট্যাগ অফিসারকে বিষয়টি জানায়। পরে ট্যাগ অফিসার তার কাছে রক্ষিত স্লিপ দেখায়। এতে দেখা যায় আমার স্ত্রীর নামে ২ টি স্লিপ দেয়া হয়েছে। দুইটাতেই মেম্বার জুলফিকারের স্বাক্ষর ও সীল আছে।

এমন পরিস্থিতিতে বিষয়টা যেন জানাজানি না হয় বা মেম্বারের কৌশল ধরা না পড়ে সেজন্য মোবাইলে অন্য মেম্বার ষষ্টিচরণ কে ডেকে এনে ট্যাগ অফিসারের মধ্যস্থতায় আমাকে ৪৫০ টাকা দিয়ে বিদায় করা হয়। এ ঘটনা ধরা না পড়লে আমি হয়তো কোন টাকাই পেতামনা। মেম্বার আমার প্রাপ্য অধিকার আত্মসাৎ করতো। অনেক মানুষ আমার মতো ফিরে গেছে।

এমন ২ স্লিপের শিকার হয়ে অনেকেই টাকা পাননি। অথচ সেই টাকা নিজ লোক দিয়ে তুলে খেয়েছে মেম্বার। কারণ বিতরনের সময় সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির উপস্থিতি নিশ্চিত না করায় মায়ের স্লিপে ছেলে, স্ত্রীর টাতে স্বামী, ভাবির স্লিপে দেবর টাকা তুলেছে। এসুযোগ কাজে লাগিয়েই মেম্বাররা টাকা আত্মসাৎ করেছে। এভাবে ওয়ার্ডের প্রায় শতাধিক মানুষের টাকা পকেটে ভড়েছে জুলফিকার মেম্বার।

শুধু তাই নয়, প্রত্যেক সুবিধাবোগীর কাছ থেকে স্লিপ দিতে ২০ টাকা থেকে ৫০ টাকা করে নেয়া হয়েছে। উম্মে কুলসুম নামে এক বৃদ্ধা বলেন, জুলফিকার মেম্বার স্লিপের জন্য ৫০ টাকা চাইছিলো। দিতে না পারায় স্লিপ দেয়নি। এখন পারিষদে আসছি যদি চেয়ারম্যান দেয় সে আশায়। তিনি বলেন সবার কাছ থেকেই টাকা নিয়েছে মেম্বাররা।

এব্যাপারে ট্যাগ অফিসার উপজেলা পল্লী উন্নয়ন কর্মকর্তা আল মিজানুর রহমান ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে বলেন, জুলফিকার মেম্বারের তালিকা ও স্লিপ বিতরনে অনেক ত্রুটি ছিলো। একারনে টাকা বিতরনে চরম ভোগান্তিতে পড়েছি আমরাও। একই নামের একাধিক স্লিপ দেয়ায় অনেককে ফিরিয়ে দিতে হয়েছে।

জুলফিকার মেম্বারের সাথে কথা হলে তিনি অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, তসরুপের কোন ব্যাপার নয়, ভুল করে কাসিম আলীর স্ত্রী রোকেয়া বেগমের নামে (৩৭১৩ নং) দুইটা স্লিপ লেখা হয়েছিলো। এমনটা হতেই পারে। পরে তো সমাধান করা হয়েছে। এটা নিয়ে কথা বলে আর লাভ নাই।

যার স্লিপ তাকে না দিয়ে আরেকজনকে দিয়েছেন কেনো এবং অন্যজন কি করে সে টাকা উত্তোলন করলো? এমন প্রশ্ন করা হলে কোন সদুত্তর দিতে পারেনি মেম্বার।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অনেকেই অভিযোগ করেন, এভাবে নানা কৌশলে জুলফিকার মেম্বার সহ অন্য মেম্বার ও চেয়ারম্যানরা দুঃস্থদের টাকা মেরে দিয়েছে। জুলফিকার মেম্বার একাই প্রায় শতাধিক মানুষের ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকা পকেটস্থ করেছে।

ভিজিএফ’র টাকা বিতরন নিয়ে এমন কৌশলের ঘটনা প্রতিটি ইউনিয়নেই ঘটেছে। প্রশাসনের যথাযথ তদারকি ও তৎপরতা না থাকায় উপজেলার হাজার হাজার প্রকৃত দুস্থরা প্রধানমন্ত্রীর ঈদ উপহার সহায়তা থেকে বঞ্চিত হয়েছে। আর তা লুটেপুটে খেয়েছে জনপ্রতিনিধি ও দলীয় স্বচ্ছল প্রভাবশালী ব্যক্তিরা।