অচেনা মরু প্রান্তে বিরামহীন জলপ্রবাহ কোন কাজে আসবে!!

আপডেট: এপ্রিল ১০, ২০২৩
0

ডা জাকারিয়া চৌধুরী:

খুব বেশিদিন আগে তো লিখিনি। তবু এতো কান্না আসে কেন ?

অচেনা মরু প্রান্তে বিরামহীন জলপ্রবাহ কোন কাজে আসবে? তবুও চোখ ভেসে যায় জলে—-
প্রিয় অরিন,
আজকের পুরোটা দিন কাটল নানান এলেবেলে কর্মকান্ডে। এলেবেলে কান্ড বুঝো ? উদাহরন দেই। চা খাওয়ার জন্য মরে যাচ্ছি কিন্তু সামান্য চা বানাতে ইচ্ছে করছে না। তবু চা বানালাম। টেবিলে চায়ের কাপ রেখে কখন যে বড় তালাটা খুজতে শুরু করেছি মনে নেই। ঘরের কোথাও তালা পেলাম না। দারোয়ানকে ডেকে পাঠালাম তালা কিনে আনবার জন্যে। কিচেনে গিয়ে হাড়ি, ছাকনি ধুয়ে তুলে রাখলাম। ফিরে এসে দেখি চা বরফ হয়ে গেছে। এক চুমুক চা খেয়েই মনে হলো বাবুর গরম কাপড় গুলো খুজে বের করতে হবে।

আলমিরা খুলে তোমার একটা পাঞ্জাবি বের করলাম। কবে ধুয়ে রেখেছি মনে নেই। আয়রন বের করলাম। সেটাকে আয়রন করে ভাজ করা কাপড়ের সাথে তুলে রাখলাম। তারপর মনে হল, আজ চা খাওয়া হয়নি। চা বানাতে যাব, দেখি টেবিলে কাপের প্রায় পুরো চা-ই রয়ে গেছে। ধীরে সুস্থে বসে চা খেতে গিয়ে মনে হল আয়রনের কানেকশন খোলা হয়নি। গেলাম আয়রনের কানেকশন খুজতেগত কুড়ি বছর ধরে জমানো ধুলো, বালি, ঝুল ঝালি পরিস্কার করলাম। সংসারের প্রতিটা কোনাকাঞ্চি ধুয়ে মুছে সাফ করলাম। এসব করতে করতে কত কি যে আবিস্কার করেছি তুমি ভাবতেও পারবে না।

চারটা চিরুনি, তেরটা বল পয়েন্ট কলম, পিংপং বল, টেনিস বল, বাস্কেট বল, ফুটবল, প্লাস্টিকের ক্রিকেট ব্যাট, একটা ফোমের জুতা। ফোমের জুতা কোনটা মনে আছে তোমার ? নিরুর জন্মের দুই মাস আগে নিউ মার্কেটের চটপটি খাবার জন্য আমার প্রান যায় যায় অবস্থা। এমন শরীরে তুমি কিছুতেই আমাকে নিউ মার্কেটে নিয়ে যাবেনা। ততক্ষনে আমার জেদ যেন চেপে বসেছে। একাই যাবার জন্য রেডি হয়ে গেলাম। অগত্যা কোন উপায়ন্তর না পেয়ে আমাকে চটপটি খাওয়াতে নিয়ে গেলে। আমার প্রতি তোমাকে এতটা সিরিয়াস হতে দেখিনি কোনদিন। মনে মনে এটা ভেবে খুব হেসেছিলাম যে, মা হবার আগে নারীকে যতটা নরম আর অক্ষম দেখায় ততটা অক্ষম হলে এ জগতে কেউ মা হতে পারত কিনা সন্দেহ আছে আমার।

আমি পরপর দুই প্লেট চটপটি খেয়ে ফেললাম। ইচ্ছে করছিল আরও কিছুক্ষন হাটাহাটি করি। বাসায় ফিরলে সেই ত আমার গৃহবন্দী জীবন । তোমাকে বলার সাহসও পাচ্ছিলাম না। বলাকা সিনেমা হলের বিপরীত দিকের গেট দিয়ে বের হতে গিয়েই লোকটাকে চোখে পড়ল। পাতলা ফোমের উপরে নিচে কাপড় দিয়ে সেলাই করা জুতা বিক্রি করছে। আমি জানতামই না, নিউবর্ন বেবীদের এমন জুতা পাওয়া যায়।

আমার অনাগত সন্তানের জন্যে জুতা কিনতে দাঁড়িয়ে পড়লাম। স্পষ্টই তুমি বিরক্ত হচ্ছিলে। আর আমিও জুতা ছাড়া যাব না। এবারেও তুমি হার স্বীকার করে নিলে। জুতা জোড়ার দাম কুড়ি টাকা। আমাদের কুড়ি বছরের সংসারের প্রায় কুড়ি বছর আগের জিনিস। বাবুর জন্যে জীবনের প্রথম কেনাকাটা। তখন কি যে আনন্দ হচ্ছিল আমার, তোমাকে তা কিছুতেই বলে বোঝাতে পারব না। সেই জুতা খুজে পেলাম আজ, তাও একটা। আমাদের ছোট পরিবারের ছোট ফ্ল্যাটের কোথাও দ্বিতীয় জুতাটি খুঁজে পেলাম না। পরে বুঝলাম, এটাই আমাদের আজকের বাস্তবতা। আমরা যে আলাদা হয়ে যাচ্ছি, জুতাটি যেন তারই প্রতিচ্ছবি। কি আশ্চর্য, তাইনা ?!

কি আর করা। সেই একটি জুতাকেই ডিটারজেন্ট দিয়ে ধুয়ে শুকিয়ে আলমিরাতে তুললাম। বাবুর শুধু-মাত্র খেলনা-ই পেয়েছি একাশিটি। সেসবের প্রায় সব গুলোই সাজিয়ে রেখেছি আলমারির স্যুটের কবাটে। তোমার তো স্যুট ছিল না। এটা ফাকা-ই থাকত। আজ ভরে দিয়ে গেলাম। বড় খেলনার প্রতিটিকে পলিথিনে মুড়িয়ে রেখেছি যেন বালুতে সয়লাব না হয়ে যায়। আমাদের বাবুটা, স্যরি তোমার বাবুটা তো আবার ধুলোবালি, ময়লা কাপড় পছন্দ করেনা। এই বয়সেই তার যে রুচি, বাব্বাহ। মাশয়াল্লাহ। সে অনেক হ্যান্ডসাম আর স্বাবলম্বী হয়ে উঠেছে দিনে দিনে। খেয়াল করেছ ? এর দিকে তাকালে আমার দুনিয়া আধার হয়ে যায়। সে এখনো জানেনা, আমি চলে যাচ্ছি।

আজই চলে যাচ্ছি। স্কুল শেষে তার বড় ফুপ্পি এসে নিয়ে যাবে। তাকে সেখানে দুই তিন দিন রেখে দিতে বলেছি। ফিরে এসে দেখবে পাখি নাই, ফুড়ুৎ। আমি জানি কতটা অভিমান নিয়ে জন্মেছে সে। কাউকে কিচ্ছু বুঝতে দেবে না। মা কোথায় ? এই প্রশ্ন তোমাকে একবারের বেশি দুইবার করবে না।

ঠিক না ? আমার প্রতি ঘৃণা জন্মায় এমন কিছু তাকে বলে দিও। মিথ্যে ভালোবাসাকে সত্য ভেবে যুগ যুগ ধরে অপেক্ষা বড় কষ্টের, বড় নির্মম যাতনার। সে যেন আমার কথা ভেবে জীবনের একটি ঘন্টাও নষ্ট না করে। জানো, স্টুডেন্ট লাইফে যখন বিভিন্ন ভার্সিটিতে এডমিশন টেষ্ট দিয়ে বেড়াচ্ছিলাম তখন কিছুতেই বুয়েটে পরীক্ষা দেবার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে আমার ছিল না। আমার কাছে ইঞ্জিনিয়ারিং হচ্ছে একটা ভয়াবহ বিষয়।

আমি পড়লাম চিকিৎসা বিজ্ঞান নিয়ে আর তোমার বাবু পড়তে চায় বুয়েটে এবং সে যোগ্যতা যে তার আছে সেটা আমি আর তোমার চেয়ে বেশি আর কে জানে বল। সে যদি কোনদিন মাইক্রোসফটের বড় কোন প্রোগ্রামার হয় তাহলে খুব মজা হবে, তাইনা ? নিজের লিয়ার জেটে করে আসা যাওয়া করবে যখন যেখানে খুশি। তাকে কিন্তু কোনভাবেই বিমান চালনা রপ্ত করতে দিও না। অতি বুদ্ধিমানেরা কি কিছুটা বে খেয়ালি হয় ? আমার মনে হয়, জেট নিয়ে আকাশে ওঠার পর সে হয়ত ঘুমিয়ে পড়বে কিংবা কোন বইয়ে ডুবে যাবে। থাক বাবা অত চিন্তা করে কাজ নেই। গত কয় মাসে এক লক্ষ ছিয়াশি হাজারবার সুরা ইয়াসিন পড়েছি শুধুমাত্র এই ঘরে যেন কোন বিপদ না আসে। তুমি কিন্তু অবশ্যই কিছু কিছু অভ্যাস ছেড়ে দেবে। বিশেষ করে মদ পান করে ঘরে এসো না আর ঘরে সিগারেট খেয়ে এখানে সেখানে ছুড়ে ফেলে ঘর নোংরা করবে না। তোমার বাবু এসব একদম পছন্দ করেনা। মনে থাকবে তো ?

বাবুর জন্ম সময়ের কথা কি মনে আছে নাকি ভুলে বসে আছ ? অক্টোবর মাসের প্রথম সপ্তাহ। শীত কেবল শুরু হল। যেদিন হাসপাতালে ভর্তি হলাম সেদিন সকাল থেকেই সে কি বৃষ্টি ! পুরো শান্তিনগর এলাকা ডুবে গেল। এই বৃষ্টিতেই আমাকে নিয়ে এলে হাসপাতালে। কথা ছিল বিকেল পাঁচটায় আমার সিজার হবে। দুপর দুটো থেকে তুমি এক প্রকার গায়েব। তুমি আর তোমার বন্ধু বারে গিয়ে বসে আছো।

চারটার সময় রুমে ফিরে এলে ঠিকই কিন্তু আমার সাথে তোমার কোন কথা নেই। তুমি ভাতিজা ভাতিজি, এটা সেটা নিয়ে ব্যাস্ত হয়ে গেলে। যতক্ষন রুমে ছিলে ততক্ষন আমি তোমার দিকেই তাকিয়ে ছিলাম। একটা মানুষ এমন নির্লিপ্ত আর অদ্ভুত অস্বাভাবিক হয় কিভাবে তাই ভাবছিলাম। সাড়ে চারটার দিকে তুমি’একটু আসছি’ বলে আবার কোথায় যেন উধাও হয়ে গেলে। ঠিক এ সময় নার্সেরা আমাকে নিয়ে যেতে এলো। আমার খুব ইচ্ছে ছিল যাবার সময় তুমি আমার হাত ধরে এগিয়ে দেবে, এই ফাঁকে আমিও তোমার কাছে ক্ষমা চেয়ে নেব। অথচ তোমার টিকিটিও দেখা গেল না। নিরুর জন্মের কয়েক মিনিট পর তাকে আমার পাশে শুইয়ে দেয়া হলো। ছেলেটা হাসি মুখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।

প্রথম সন্তানের মুখ প্রথমবার দেখার অনুভুতি যে কি, তা পৃথিবীর কোন মা সম্ভবত ব্যাক্ত করতে পারবে না। আর আমি তো গাধা মা। বাবুকে দেখেই আমি ভ্যা করে কেঁদে দিলাম। কে যেন তোমার কাছে দৌড়ে গিয়ে আজান দিতে বলল। তুমি জানিয়ে দিলে আজান কিভাবে দিতে হত তা তুমি জান না। পরে সেই দায়িত্ব পালন করেন তোমার সেঝো ভাই। তুমি শুধু চুপচাপ এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলে। তুমি আনন্দিত নাকি ব্যাথিত না কি কিছুই বুঝা যায়নি। আচ্ছা তুমি এমন কেন বলবে ? তুমি তোমার ভাব প্রকাশ করতে পার না নাকি তুমি আজন্ম-ই একটা পাথর বিশেষ ?, পরে বলেছিলে কারো হাতে ক্যামেরা দেখতে না পেয়ে তুমি ক্যামেরা কিনতে বায়তুল মোকাররাম মার্কেটে গিয়েছিলে।

স্ত্রীকে এভাবে ফেলে কেউ যে বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে ক্যামেরার দোকানে চলে যেতে পারে তা ভেবে খুব অবাক হয়েছিলাম। যাই হোক, তোমার সেদিনের কেনা ক্যামেরাটা না থাকলে সত্যই বিপদ হত। তোমার শিশুর জন্মক্ষণকে ধরে রাখা যেত না। যে জন্যে এত কথা বলা, তা হচ্ছে তোমার এবং তোমার বাবুর প্রিয় এই ক্যামেরা আছে আলমারির প্রথম ড্রয়ারে। পুরো চার্জ দিয়ে চার্জার সহ টিস্যু পেপারে মুড়িয়ে রেখে গেছি। আমার প্রেম,পরিনয়,বিয়ে থেকে বাবুর জন্ম এবং বেড়ে উঠার প্রায় হাজার দশেক ছবি আছে গুগুল ফটোজে। এর পাসওয়ার্ড দিয়েছিলে আমার নামে। এখন ইচ্ছে হলে সব কিছু পরিবর্তন করে নিতে পার।

আমার হাতে এখনো নয় সাড়ে নয় ঘন্টা সময় আছে। কাজ খুঁজে পাচ্ছি না। সব কিছু ঝাপসা লাগছে। মুখে পানি দিয়ে এক কাপ কড়া চা খেলে মনে হয় চোখে আবার দেখব। কি মনে হয় ? অন্ধ হবার বয়স কি হয়ে গেছে ? নাকি প্রলয়ের অগ্রিম সতর্কতা নেবার প্রয়োজন কখনো অনুভব করিনি ? আচ্ছা তুমি কি জানো ,মানুষ নাকি সর্বংসহা ? আমার ধারনা কথাটা মিথ্যা।
০৯,০৪.২০২৩ ইং


প্রিয় কথকতা