চুয়াডাঙ্গা থেকে ভারতে পাচারের সময় ২৩ নারীকে উদ্ধার ,র‌্যাবের জালে ধরা ১১ জনের সিন্ডিকেট

আপডেট: অক্টোবর ৩০, ২০২১
0

র‌্যাবের অভিযানে রাজধানীর মিরপুর, উত্তরা, তেজগাঁও এবং চুয়াডাঙ্গা থেকে বিদেশে পাচার হতে যাওয়া ২৩ জন নারী ভিকটিম উদ্ধার; দুটি পাচার সিন্ডিকেটের মূলহোতাসহ ১১ জন গ্রেফতার করা হয়েছে।

র্যাব জানায় , সাম্প্রতিককালে মে ২০২১ মাসে পার্শ্ববর্তী দেশে বাংলাদেশের এক তরুণীর পৈশাচিক নির্যাতনের একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। এর প্রেক্ষিতে র‌্যাব পার্শ্ববর্তী দেশে মানব পাচারকারী চক্রের অন্যতম হোতা বস রাফিসহ চক্রের বেশ কয়েকজন সদস্যকে গ্রেফতার করে। এছাড়াও একজন মহিয়সী “মা” জীবনের সর্বোচ্চ ঝুঁকি নিয়ে নিজে পার্শ্ববর্তী দেশে পাচার হয়ে মেয়েকে পাচারকারীদের নিকট হতে উদ্ধারের ঘটনা প্রিন্ট ও সোশ্যাল মিডিয়াতে ভাইরাল হলে পাচারকারী চক্রের কাল্লু-সোহাগ @ কাল্লু-নাগিন সোহাগ @ মামা-ভাগিনা @ কালা-নাগিন সিন্ডিকেটের ০৩ সদস্যকে গ্রেফতার করে র‌্যাব।

উল্লেখিত ঘটনাসমূহ দেশব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টি করে এবং বিভিন্ন গণমাধ্যমে ব্যাপক প্রচারণার ফলে বেশ কয়েকজন মানব পাচারের শিকার ভিকটিম প্রতিকারের আশায় র‌্যাবের নিকট অভিযোগ করে। প্রাপ্ত অভিযোগের ভিত্তিতে র‌্যাব ছায়া তদন্ত শুরু করে ও গোয়েন্দা নজরদারী বৃদ্ধি করে।

এরই ধারাবাহিকতায় র‌্যাব-৪ এর একাধিক আভিযানিক দল গতরাতে অভিযান চালিয়ে রাজধানীর মিরপুর, উত্তরা ও তেজগাঁও হতে ২২ জন নারী ও চুয়াডাঙ্গা জেলার জীবনগর এলাকা হতে ০১ জন নারীসহ সর্বমোট ২৩ জন বিদেশ পাচার হতে যাওয়া নারী ভিকটিমদের উদ্ধার করা হয়। গ্রেফতার করা হয় মানব পাচার চক্রের ০২টি চক্র। তন্মধ্যে ঢাকার মোহাম্মদপুর, খিলক্ষেত ও চুয়াডাঙ্গা হতে পার্শ্ববর্তী দেশে পাচার চক্রের মূলহোতা (১) মোঃ কামরুল ইসলাম @ জলিল @ ডিজে কামরুল@ ড্যান্স কামরুল (৩৭), কুমিল্লা এবং তার চক্রের সদস্য (২) মোঃ রিপন মোল্লা (২২), চাঁদপুর, (৩) মোঃ আসাদুজ্জামান সেলিম (৪০), গাজীপুর, (৪) মোঃ নাইমুর রহমান @ শামীম (২৫), ঝিনাইদহ এবং বনানী, পল্লবী, তেজগাঁও ও উত্তরা হতে মধ্যপ্রাচ্যে মানবপাচার চক্রের মূলহোতা (১) মোঃ নুর-নবী ভুইয়া রানা (৪৪), লক্ষীপুর, এবং তার চক্রের সদস্য (২) মোঃ আবুল বাশার (৫২), নোয়াখালী (৩) মোঃ আল ইমরান (৪১),লালমনিরহাট, (৪) মনিরুজ্জামান (৩৫), কুমিল্লা, (৫) মোঃ শহিদ সিকদার (৫৪), পিরোজপুর (৬) প্রমোদ চন্দ্র দাস (৬২), কুমিল্লা (৭) টোকন (৪৫), গোপালগঞ্জ’দেরকে গ্রেফতার করা হয়। উক্ত অভিযানে জব্দ করা হয় ৫৩ টি পাসপোর্ট, ২০ টি মোবাইল, ০৮ বোতল বিদেশী মদ, ২৩ ক্যান বিয়ার, ০২ টি মোটর সাইকেল, ০১ টি ল্যাপটপ, ০১ সেট কম্পিউটার, ৯১,০৪০/- টাকাসহ মানব পাচার সংশ্লিষ্ট গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্র।

পার্শ্ববর্তী দেশে মানব পাচার চক্র।
৫। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, পাশ্ববর্তী দেশে মানব পাচারকারী চক্রের মূলহোতা গ্রেফতারকৃত মোঃ কামরুল ইসলাম @ জলিল @ ডিজে কামরুল @ ড্যান্স কামরুল । এই চক্রের সদস্য সংখ্যা প্রায় ১৫-২০ জন। ২০১৯ সাল হতে এই চক্রটি সক্রিয়ভাবে মানব পাচার মত অপরাধ করে আসছে। চক্রটি দেশের বিভিন্ন জেলা হতে কমবয়সী মেয়েদের প্রতারণামূলক ফাঁদে ফেলে এবং প্রলোভন দেখিয়ে পার্শ্ববর্তী দেশে পাচার করে। প্রথমে চক্রটি ভিকটিমদের নাচ/ডেন্স শিখানোর নামে প্রত্যন্ত অঞ্চলের থেকে সুন্দরী মেয়েদের ঢাকায় নিয়ে আসতো। তাদেরকে বেপোয়ারা জীবন যাপনে অভ্যস্ত করে ফেলা হত। পরবর্তীতে তাদের পাশ্ববর্তী দেশে বিভিন্ন চাকুরীর কথা বলে প্রলুব্ধ করে পাচার করতো। এই ভাবে এই চক্রটি গত ২/৩ বছরে প্রায় শতাধিক মেয়েকে পার্শ্ববর্তী দেশে পাচার করে। ভিকটিমদের পার্শ্ববর্তী দেশে মার্কেট, সুপারশপ, বিউটি পার্লারসহ লোভনীয় চাকুরীর প্রলোভন দেখিয়ে আকৃষ্ট করত। মূলতঃ পাশ^বর্তী দেশে অমানবিক এবং অনৈতিক কাজ করানোর উদ্দেশ্যে তাদের পাচার করা হতো। এই চক্রটি রাজাধানী ঢাকাসহ দেশের বেশ কয়েকটি এলাকায় সক্রিয় রয়েছে। গ্রেফতারকৃতরা আরও জানায়, ভিকটিমদেরকে সীমান্তের অরক্ষিত এলাকা দিয়ে পার্শ্ববর্তী দেশে পাচার করে। এই চক্রের সাথে পাশ^বর্তী দেশের সিন্ডিকেটের যোগসাজশ রয়েছে। পাশ্ববর্তী দেশের চক্রের সদস্যরা ভিকটিমদের ভূয়া কাগজপত্র তৈরি করে। অতঃপর বিপুল অর্থের বিনিময়ে বিভিন্ন শহরে/প্রদেশে অনৈতিক কাজ করানোর উদ্দেশ্যে বিক্রয় করে দিত। এরপর থেকে ভিকটিমদের আর কোন সন্ধান পাওয়া যায় না। এই চক্রের মূলহোতা গ্রেফতারকৃত ডিজে কামরুল।

৬। গ্রেফতারকৃত মোঃ কামরুল ইসলাম @ জলিল @ ডিজে কামরুল @ ড্যান্স কামরুল ২০০১ সালে কুমিল্লা হতে ঢাকায় পাড়ি জমায়। প্রাথমিক পর্যায়ে সে বাড্ডা এলাকায় রিক্সা চালক হিসেবে জীবিকা শুরু করে। কিছুদিন পর সে একটি কোম্পানীর ডেলিভারী ভ্যান চালক হিসেবে কাজ নেয়। অতঃপর সে ড্যান্স গ্রুপের সাথে জড়িয়ে পড়ে। পরবর্তীতে সে হাতিরঝিল এলাকায় “ডিজে কামরুল ড্যান্স কিংডম” নামে একটি ড্যান্স ক্লাব প্রতিষ্ঠা করে। উক্ত ড্যান্স ক্লাবের মাধ্যমে সে বিভিন্ন উঠতি বয়সী মেয়েদের বিনোদন জগতে প্রবেশের নামে প্রলুব্ধ করত। একপর্যায়ে তাদের উচ্চ বেতনে চাকুরীর প্রলোভন দেখিয়ে প্রলুব্ধ করে পাশ^বর্তী দেশে পাচার করত। গ্রেফতারকৃত কামরুল ইসলাম @ জলিল বেশ কয়েকবার পার্শ্ববর্তী দেশে ভ্রমণ করে। পাশ^বর্তী দেশের নারী পাচারকারী চক্রের সাথে সখ্যতা গড়ে উঠে। ২০১৯ সালে এপ্রিল মাসে সে তার ড্যান্স ক্লাবের ০১ নারীকে পাশ্ববর্তী দেশের বিউটি পার্লারে অধিক বেতনে চাকুরির প্রলোভন দেখিয়ে পাচার করে। উক্ত ঘটনায় ভিকটিম এর বোন তার বিরুদ্ধে বাড্ডা থানায় মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইনে একটি মামলা দায়ের করলে, সে ২০১৯ সালের মাঝামাঝি সময়ে বাড্ডা থানা পুলিশ কর্তৃক আটক হয়। উক্ত মামলায় ০৩ মাস কারা অন্তরীণ ছিল। পরবর্তীতে জামিনে বের হয় এবং পুনরায় তার নারী পাচার কার্যক্রম অব্যাহত রাখে। চক্রটি প্রলোভনের শিকার নারীদের পরিকল্পনা মোতাবেক বিভিন্ন সীমান্তবর্তী জেলায় অবস্থিত সেইফ হাউজে অবস্থান করাত। পরবর্তীতে সেইফ হাউজে থাকা অবস্থায় তাদের নিকট হতে মোবাইল নিয়ে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করা হত। এরপর সুবিধাজনক সময়ে এই চক্রের সদস্যরা নারী ভিকটিমদের অরক্ষিত সীমান্ত দিয়ে পার্শ্ববর্তী দেশে পাচার করে। এই চক্রের গ্রেফতারকৃত রিপন, সেলিম এবং শামীম নারী পাচারের অবৈধ কাজে মূলহোতা’কে সহায়তা প্রদান করত বলে স্বীকার করে।
৭। গ্রেফতারকৃত মোঃ রিপন মোল্লা ডেলিভারী ম্যান হিসেবে কাজ করে। সে মূলহোতার পক্ষে মানবপাচারে পাশ^বর্তী দেশের দালালের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখত। সে পাচার যোগ্য নারীদের ছবি পাশ^বর্তী দালালের কাছে প্রেরণ করে। পাশ^বর্তী দেশের দালালদের ওকে রিপোর্ট অনুযায়ী পাশ^বর্তী দেশে পাচার করা হত। গ্রেফতারকৃত মোঃ আসাদুজ্জামান সেলিম বর্তমানে উত্তরা এলাকায় ব্যবসা করে এবং পাশাপাশি মূলহোতা কামরুলের মানব পাচারসহ অন্যান্য অনৈতিক কাজে সহযোগিতা করত। গ্রেফতারকৃত মোঃ নাইমুর রহমান @ শামীম সীমান্ত এলাকায় সেইফ হাউজ পরিচালনা, অবৈধভাবে সীমান্ত পারাপার ও পাশ^বর্তী দেশের দালালের কাছে ভিকটিমদের হস্তান্তর করে।
মধ্যপ্রাচ্য ভিত্তিক পাচার চক্র।
৮। এই চক্রের গ্রেফতারকৃত মধ্যপ্রাচ্য ভিত্তিক পাচার চক্রের সদস্যদের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, এটি মধ্যপ্রাচ্যে মানব পাচারকারী একটি চক্র। চক্রে দেশে ১০-১২ জন সক্রিয় সদস্য রয়েছে। ৫/৭ বছর যাবত এই চক্রটি সক্রিয়ভাবে নারী ও পুরুষ মানব পাচার করে আসছে। হাউজকিপিং, নার্স, রেস্টুরেন্ট ইত্যাদি পেশায় নারী কর্মীদের বিনা অর্থে প্রেরণের প্রলোভন দেখিয়ে উঠতি বয়সী তরুণী ও মধ্য বয়স্ক নারীদের প্রলুব্ধ করত এই চক্রটি। মূলত বিদেশে পাচারের মাধ্যমে ভিকটিমদের বিক্রি করে দেওয়া হত। এ পর্যন্ত চক্রটি ইতিমধ্যে ৩০-৩৫ জন নারী’কে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে পাচার করেছে। পাচারকারীরা ঢাকায় কয়েকটি সেইফ হাউজ পরিচালনা করে। বেশকয়েকদিন উক্ত সেইফ হাউজে ভিকটিমদের আটকে রেখে পরবর্তীতে মধ্যপ্রাচ্যে পাচার করা হয়। মধ্যপ্রাচ্যে ভিকটিমদের একটি নির্দিষ্ট পরিমান টাকার বিনিময় বিক্রি করা হত। চক্রটি রাজাধানী ঢাকাসহ দেশের বেশ কয়েকটি এলাকায় সক্রিয় রয়েছে। চক্রটি কয়েকটি ধাপে বিভিন্ন দেশে নারীদের পাচার করে আসছে। প্রথমত তারা রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকা হতে উঠতি বয়সী এবং আর্থিক ভাবে অস্বচ্ছল যুবক-যুবতী ও মধ্যবয়স্ক নারীদের টার্গেট করে তাদের সাথে সখ্যতা গড়ে তোলে এবং বিদেশে বিভিন্ন লোভনীয় চাকুরীর প্রলোভন দেখায়। এতে তারা রাজী হলে প্রথমত তাদের ঢাকায় অবস্থিত সাজানো অফিসে এনে বিশ্বাস যোগ্যতা অর্জন করে এবং বিদেশে যাওয়ার জন্য স্বল্পকালীন ভূয়া প্রশিক্ষণ এর ব্যবস্থা করে। এ সময় কোন নারী বিদেশে যেতে অনীহা প্রকাশ করে পাসপোর্ট ফেরত চাইলে তাদের নিকট দেড় হতে দুই লক্ষ টাকা দাবী করতো। এই মধ্যপ্রাচ্যে মানব পাচারকারী চক্রের মূলহোতা গ্রেফতারকৃত মোঃ নুর-নবী ভুইয়া রানা।
৯। গ্রেফতারকৃত মোঃ নুর-নবী ভুইয়া রানা লক্ষীপুরের স্থানীয় একটি কলেজ হতে ১৯৯৬ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেন। ১৯৯৬ সালে সে ঢাকায় এসে একটি প্রাইভেট কোম্পানীতে চাকুরী দিয়ে কর্মজীবন শুরু করে। পরবর্তীতে ১৯৯৮ সাল হতে তিনি সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং ওমানে প্রবাসী হিসেবে কাজ করে। ওমানে থাকা অবস্থায় মানব পাচারকারী একটি চক্রের সাথে তার পরিচয় হয় এবং তখন থেকেই মানব পাচার কার্যক্রমের সাথে জড়িয়ে পড়ে। পরবর্তীতে ২০২০ সালে ওমান থেকে দেশে ফিরে মানবপাচারের সাথে পুরোপুরি জড়িয়ে পড়ে। গ্রেফতারকৃত আবুল বাশার, ইমরান, মনিরুজ্জামান, শহীদ এবং প্রোমদ এই চক্রের স্বক্রিয় সদস্য এবং নুর নবী ভূইয়ার নেতৃত্বে মানব পাচারের এই অবৈধ কার্যক্রমে জড়িয়ে পড়ে।
১০। পাশ^বর্তী দেশে মানব পাচার চক্রের মূলহোতা ডিজে কামরুল এর নামে ডিএমপি, বাড্ডা থানায় মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইনে ০১টি মামলা রয়েছে। এছাড়া অপর চক্রের সদস্য মনিরুজ্জামান এর নামে ডিএমপি, সবুজবাগ থানায় বাংলাদেশ পাসপোর্ট আইনে, প্রমদ এর নামে ডিএমপি, পল্টন থানায় প্রতারণার এবং টোকন এর নামে যশোর জেলার অভয়নগর থানায় প্রতারণা ও জালিয়াতির ০১টি করে মামলা রয়েছে।