ছাত্রলীগ সভাপতি-সম্পাদকদের অধিকাংশই আ”লীগ করতে পারেনি!

আপডেট: জানুয়ারি ৬, ২০২২
0

সোহেল সানি

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু গর্ব করে বলতেন, “স্বাধীনতার ইতিহাস মানে ছাত্রলীগের ইতিহাস আর ছাত্রলীগের ইতিহাস মানে স্বাধীনতার ইতিহাস।” ৪ জানুয়ারি ছিল সেই ছাত্রলীগের জন্মদিন। ১৯৪৮ থেকে ২০২২। এ দীর্ঘসময়ে বহু অর্জনের পাশাপাশি রয়েছে অনেক বিসর্জনও। তারপরও সবকিছু ছাপিয়ে ছাত্রলীগকে বলা হয় আওয়ামী লীগের মাতৃসংগঠন। আওয়ামী লীগকে যদি বলা হয় স্বাধীনতার নেতৃত্বদানকারী দল তবে নিঃসন্দেহে ছাত্রলীগকে বলা যায় স্বাধীনতার পতাকাবাহী সংগঠন। অখন্ড স্বাধীন বাংলার স্বপ্নভঙ্গের পর কলকাতা ফেরত নিখিল বঙ্গ মুসলিম ছাত্রলীগের সোহরাওয়ার্দীপন্থীরাই ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠা করেন। প্রতিষ্ঠাকালীন সংগঠনটির নাম ‘পূর্বপাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ’ হলেও ১৯৫৫ সালের সম্মেলনে ‘মুসলিম’ শব্দটি কর্তন করে অসম্প্রদায়িক নীতি গ্রহণ করা হয়। আওয়ামী লীগের জন্মলাভ সোহরাওয়ার্দী’র নির্দেশনায় ভাসানীর নেতৃত্বে এবং বিকাশ শেখ মুজিবের সাংগঠনিক নৈপুণ্যে। আর সেই শেখ মুজিবই হচ্ছেন ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাতা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক মুসলিম হল মিলনায়তনে নাঈমুদ্দীন আহমেদকে আহবায়ক করে ছাত্রলীগের ১৫ সদস্যের কমিটি আত্মপ্রকাশ করে। তবে শুরুতেই হোঁচট খায়। ভাষা সংগ্রামের উত্তাল তরঙ্গে যখন সংগঠনটির প্রায় সকলে গা ভাসিয়ে তখন ছাত্রলীগ আহবায়ক নাঈমুদ্দীন আহমেদ বিতর্কিত হয়ে পড়েন। নেতৃত্বগ্রহণের দু’মাস ১২ দিনের ব্যবধানে নাঈমুদ্দিন শৃঙ্খলাভঙ্গের দায়ে ছাত্রলীগ থেকে বহিস্কৃত হন। নাঈমুদ্দিন আহমেদ বহিস্কৃত ছাত্রলীগ আহবায়ক নাঈমুদ্দিন আহমেদ ১৯৫৪ সালের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আওয়ামী মুসলিম লীগে শামিল হন। মার্চের আইন পরিষদ নির্বাচনে রাজশাহী থেকে আওয়ামী লীগের কোটায় যুক্তফ্রন্টের ব্যানারে জয়ী হলেও দলে শীর্ষ নেতৃত্বের সারিতে উঠে আসতে পারেননি কখনো প্রয়াত এ নেতা।

ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাতারা কেউ বেঁচে নেই ‘৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ফজলুল হক মুসলিম হলের মিলনায়তন কক্ষে নাজমুল করিমের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত একটি সভায় ‘পূর্বপাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ’ নামে একটি নতুন সংগঠনের আত্মপ্রকাশ ঘটে। রাজশাহীর নঈমউদ্দীন আহমেদকে আহবায়ক করা হয় ১৫ সদস্য পুরাণ ঢাকার ১৫০ মোগলটুলী ‘মুসলিম লীগ ওয়ার্কার্স ক্যাম্প’ই ছিলো পূর্বপাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের প্রথম কার্যালয়। ‘৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ফজলুল হক মুসলিম হলের মিলনায়তন কক্ষে নাজমুল করিমের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত একটি সভায় ‘পূর্বপাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ’ নামে একটি নতুন সংগঠনের আত্মপ্রকাশ ঘটে। রাজশাহীর নঈমউদ্দীন আহমেদকে আহবায়ক করা হয় ১৫ সদস্য বিশিষ্ট ‘আহবায়ক কমিটির অন্যান্য সদস্য হলেন, বরিশালের আব্দুর রহমান চৌধরী, ফরিদপুরের শেখ মুজিবুর রহমান, কুমিল্লার অলি আহাদ, নোয়াখালীর আজিজ আহমেদ, পাবনার আব্দুল মতিন, দিনাজপুরের দবিরুল ইসলাম, রংপুরের মফিজুর রহমান, খুলনার শেখ আব্দুল আজিজ, ঢাকার নওয়াব আলী, ঢাকা সিটির নুরুল কবির, কুষ্টিয়ার আব্দুল আজিজ, ময়মনসিংহের সৈয়দ নুরুল আলম, চট্টগ্রামের আব্দুল কুদ্দুস চৌধুরী। সর্বশেষ প্রয়াত হন শেখ আব্দুল আজিজ। আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সদস্ শেখ আজিজ বঙ্গবন্ধু সরকারের অন্যতম মন্ত্রী ছিলেন। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর কারাবরণ করেন মোশতাকের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে। ১৯৯২ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ছিলেন। শেখ আব্দুল আজিজ খুলনা জেলা আওয়ামী লীগেরও প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। দীর্ঘদিন শয্যাশায়ী ছিলেন বঙ্গবন্ধুরর এ ঘনিষ্ঠ সহচর। অলি আহাদও পরলোকে। ১৯৫৩ সালে আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রথম প্রচার সম্পাদক আব্দুর রহমান বহিস্কৃত হলে শূন্যপদে উঠে আসেন কুমিল্লার অলি আহাদ। ১৯৫৫ সালে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক হওয়ার পর অলি আহাদ সাধারণ সম্পাদক পদ প্রত্যাশী হয়ে ওঠেন। শেখ মুজিবের একই সঙ্গে সাধারণ সম্পাদক ও মন্ত্রীত্ব গঠনতন্ত্র পরিপন্থী বলে দলে উপদলীয় কোন্দলের সৃষ্টি করেন। তিনি শেখ মুজিব মন্ত্রীত্ব ও দলীয় সাধারণ সম্পাদক দুই পদে থাকা নিয়ে বিতর্কের সৃষ্টি করেন। গঠনতন্ত্রে পরিপন্থী ছিল তখন একই সঙ্গে দুটি পদে থাকা। অলি আহাদ মনে করছিলেন শেখ মুজিব মন্ত্রীত্ব রেখে সাধারণ সম্পাদকের পদ ছাড়বেন, তখন সাংগঠনিক সম্পাদক হিসাবে তিনি ভারপ্রাপ্ত হবেন। ( উল্লেখ্য যুগ্ম সম্পাদকের পদ প্রথম কাউন্সিলেই বিলুপ্ত করা হয়) পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারে সোহরাওয়ার্দীর প্রধানমন্ত্রীত্বে ও প্রদেশে আতাউর রহমান খানের মুখ্যমন্ত্রীতত্বে আওয়ামী লীগ যখন ক্ষমতাসীন তখন’সোহরাওয়ার্দী-ভাসানী বিরোধ’ চরমে পৌঁছে। বিশেষ করে বৈদেশিক নীতি নিয়ে। মওলানা ভাসানীর সভাপতির পদ থেকে পদত্যাগ সম্পর্কিত একটা পত্র সাংগঠনিক সম্পাদক অলি আহাদ দলীয় সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবের হাতে তুলে না দিয়ে তা সংবাদপত্রে প্রকাশ করে দেয়। ফলে অলি আহাদ বহিস্কার হন। প্রতিবাদে যে ৯ জন এম এল এ পদত্যাগ করেন, তার মধ্যে ছাত্রলীগের ভারপ্রাপ্ত আহবায়ক ও প্রথম সভাপতি দবিরুল ইসলাম অন্যতম। দবিরুল ইসলাম যে কারণে আওয়ামী লীগ থেকে বহিস্কৃত হন। পাবনার আব্দুল মতিনও এম এল এ ছিলেন। পরলোকে চলে যাওয়া ভাষা সৈনিক মতিনও পরবর্তীতে ভাসানী ন্যাপে অন্তর্ভুক্ত হন। ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য রংপুরের মফিজুর রহমান নোয়াখালীর আজিজ আহমেদ, কুষ্টিয়ার আব্দুল আজিজ, ময়মনসিংহের সৈয়দ নুরুল আলম, চট্টগ্রামের আব্দুল কুদ্দুস চৌধুরী ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে আওয়ামী মুসলিম লীগের পক্ষে যুক্তফ্রন্টের ব্যানারে এম এল এ নির্বাচিত হয়েছিলেন। ঢাকার নওয়াব আলী ও ঢাকা সিটির নুরুল কবির ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাকালীন আহবায়ক কমিটির সদস্য পদ অলংকৃত করলেও জাতীয় রাজনীতিতে শীর্ষতম স্থানে উঠে আসতে পারেননি কখনো।

দবির-খালেক ভারপ্রাপ্ত আহবায়ক দবিরুল ইসলাম ১৯৫৩ সালে ছাত্রলীগের প্রথম সম্মেলনে সভাপতির পদ অলংকৃত করেন। সঙ্গে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন খালেক নেওয়াজ খান। সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক দু’জনকেই পরের বছর বিদায় নিতে হয় ১৯৫৪ এর নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ায়। পূর্বপাকিস্তানের ক্ষমতার ভাগ-বাটোয়ারা নিয়ে শেরেবাংলা -সোহরাওয়ার্দী-ভাসানীর যুক্তফ্রন্ট কোন্দলের মুখে পড়ে আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান শেরেবাংলার কৃষক শ্রমিক পার্টির সরকারের প্রতি অনাস্থা প্রস্তাব পেশ করেন। আওয়ামী লীগের ১৯ জন আইন পরিষদ সদস্য কৃষক শ্রমিক পার্টিতে যোগ দেয়। ছাত্রলীগের প্রথম সাধারণ সম্পাদক খালেক নেওয়াজ খান শেরেবাংলার পার্লামেন্টারি সচিবের পদ গ্রহণ করেন। পূর্বপাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিনকে ঢাকার একটি আসনে হারিয়ে দিয়ে গোটা পাকিস্তানে চমক সৃষ্টি করলেও রাজনীতিতে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারেননি। ফিরতে পারেননি আওয়ামী লীগেও।

দবিরুল ইসলাম

ছাত্রলীগের প্রথম সভাপতি রাজশাহীর দবিরুল ইসলাম। দবিরুল ইসলামের ‘হেবিয়াস কপার্স মামলা’ পরিচালনার জন্যই ঢাকায় আসেন। এতে বিখ্যাত হয়ে যান দবিরুল ইসলাম। ১৯৫৪ এর নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ায় দবিরুল ইসলামকেও ছাত্রলীগ থেকে বিদায় নিতে হয়। ‘৫৫ সালে তাকেও নেতৃত্বের উপদলীয় কোন্দলের শিকার হয়ে আওয়ামী লীগ থেকে বহিস্কার হতে হয়। কামরুজ্জামান

১৯৫৪ সালের দ্বিতীয় সম্মেলনে ছাত্রলীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। শিক্ষকতা পেশা জড়িয়ে নামের সঙ্গে অধ্যক্ষ যোগ করেন। আওয়ামী লীগের থেকে কখনো বিচ্যুত হননি। তবে নেতৃত্বের শীর্ষে উঠে আসেন বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বগ্রহণের মধ্যবর্তী সময়ে। ২০০২ সাল পর্যন্ত

কামরুজ্জামান আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য হলেও এমপি নির্বাচিত না হওয়ায় মন্ত্রীত্বের দেখা পাননি। তিনি পরলোকে গমন করার আগেও লাঠি ভর দিয়ে আওয়ামী লীগের অফিসে ছুটে যেতেন।

এম এ ওয়াদুদ

১৯৫৪ সালে কামরুজ্জামানের শুধু নয়, ১৯৫৫ সালে পরবর্তী সভাপতি আব্দুল মমিন তালুকদারেরও জুটি রূপে এম এ ওয়াদুদ ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বপালন করেন। দু’বার নির্বাচিত হওয়ার মূলে ছিল তার একাগ্রতা ও অপরিসীম সাংগঠনিক দক্ষতা। যদিও এম এ ওয়াদুদ পরবর্তীতে কর্মাধ্যক হিসাবে ইত্তেফাককেই জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ বলে বেছে নেন। ইত্তেফাক প্রতিষ্ঠাতা তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার ন্যায় পদপদবীতে না থাকলেও আওয়ামী লীগের ওপর প্রভাব বিস্তার করতেন ওয়াদুদের মেয়ে সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডাঃ দীপু মনি। ছাত্রইউনিয়ন মতিয়াগ্রুপ করা দীপু মনি আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক।

মমিন তালুকদার

১৯৫৪-১৯৫৫ এবং ১৯৫৬-১৯৫৭ দু’মেয়াদে ছাত্রলীগের সভাপতির পদে দায়িত্বপালনকারী আব্দুল মমিন তালুকদার স্বাধীনতাত্তোর বঙ্গবন্ধু সরকারের প্রতিমন্ত্রী নিযুক্ত হন। আওয়ামী লীগের কোন বড় পদ কখনও অলংকৃত করতে পারেননি। কেন্দ্রীয় সদস্য পদে বেশ কিছুদিন ছিলেন।এখন পরলোকে।

এম এ আউয়াল

আব্দুল মমিন তালুকদারের দ্বিতীয় মেয়াদে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন এম এ আউয়াল। আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে বেশ কাটেনি তার কখনো। স্বাধীনত্তোর ছাত্রলীগের ভাঙ্গনকে কেন্দ্র করে ১৯৭২ সালে স্বাধীনতার অন্যতম নিউক্লিয়াস সিরাজুল আলম খানের তন্ত্র-মন্ত্রে এবং জলিল-রব-সিরাজের নেতৃত্বে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ)গঠিত হলে তাতে যোগ দিয়ে প্রভাবশালী হয়ে ওঠেন। তার আগে তিনি বঙ্গবন্ধু সরকার কর্তৃক আদমজী জুট মিলের প্রধান নির্বাহীর পদ থেকে বরখাস্ত হন। বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে তিনি আসম আব্দুর রবের মতো ১৯৭৩ সালের প্রথম সংসদ নির্বাচনে ঢাকা থেকে প্রার্থী হলেও জামানত হারান। সিপাহী জনতার বিপ্লবের পর প্রয়াত এ সমাজতন্ত্রী এম এ আউয়াল নিজেকে জাসদের মূল নেতা হিসাবে দাবী করেন।

রফিকউল্লাহ চৌধুরী

১৯৫৭-১৯৬০ মেয়াদে ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলেন রফিক উল্লাহ চৌধুরী। সিএসপি পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকারী রফিক উল্লাহ আমলাতান্ত্রিক জীবনব্যবস্থা বেছে নেন। সৎ ও নিষ্ঠার পরিচয় মেলে স্বাধীনতাত্তোর তাকে প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মুখ্যসচিব পদে নিযুক্তির ঘটনায়। রফিক উল্লাহ চৌধুরী বঙ্গবন্ধুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বিনয়ের সঙ্গে বলেন,’পাকিস্তানের আমলাতন্ত্র যা করেছে, তা দয়া করে আপনি করবেন না। আমার নিয়োগে জ্যেষ্ঠতা লংঘণ হয়েছে। যদি আমাকে আপনার পাশে রাখতেই চান, তাহলে আমাকে প্রধানমন্ত্রীর সচিব করতে পারেন।” বঙ্গবন্ধু তাই করেন। রফিক উল্লাহ চৌধুরী বঙ্গবন্ধু হত্যার পর চাকুরী থেকে বরখাস্ত হন। বর্তমান স্পিকার ডঃ শিরীন শারমিন চৌধুরী তার মেয়ে।

রফিক উল্লাহ চৌধুরীর সঙ্গে দু’বছর সাধারণ সম্পাদক ছিলেন কাজী আজাহারুল ইসলাম। ব্যারিস্টারি পড়তে বিলাতে গমন করায় পরবর্তী এক বছর (১৯৫৯-১৯৬০) সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বপালন করেন শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন। ১৯৬০-১৯৬৩ ওই দুই মেয়াদেই সভাপতি হন শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন। স্বাধীনতাত্তোর প্রথম জাতীয় সংসদের চিফ হুইপ নির্বাচিত হওয়া মোয়াজ্জেমের সঙ্গে সাধারণ সম্পাদক হিসাবে জুটি বাঁধা শেখ ফজলুল হক মনির সম্পর্কের টানাপোড়ন ছাত্রলীগের শুরু থেকেই। আওয়ামী লীগে কাঙ্খিত পদ না পাওয়ায় বরাবরই অসন্তোষ ছিল তার মনে। চিফ হুইপ ছিলেন প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদায়। বাকশাল হলে শেখ মনি অন্যতম সম্পাদক হিসাবে ১৫ সদস্যের সর্বেশ্বরী নীতিনির্ধারক মন্ডলীতে ঠাঁই পেলেও কেবল সদস্য পদ নিয়ে খুশী থাকতে হয় শাহ মোয়াজ্জেমকে। বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পর অবৈধ রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাকের প্রতিমন্ত্রী নিযুক্ত হয়ে বিতর্কিত হয়ে পড়েন। জাতীয় চার নেতা হত্যা মামলার অন্যতম আসামী শাহ মোয়াজ্জেম খুনী মোশতাক ডেমোক্রেটিক লীগ গঠনে বলিষ্ঠ ভুমিকা রাখেন। এরশাদ জমানায় প্রথমে মন্ত্রী ও পরে উপপ্রধানমন্ত্রী এবং জাতীয় পার্টির মহাসচিব নিযুক্ত হন। শাহ মোয়াজ্জেম আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতে কখন স্থাব পাননি। বর্তমানে তিনি বিএনপিতে আছেন না থাকার মতো।

শেখ মনি

১৯৬০-১৯৬৩ পর্যন্ত শাহ মোয়াজ্জেমের সঙ্গে শেখ ফজলুল হক মনির জুটি ছিল ছাত্রলীগের ইতিহাসে একটি বলিষ্ঠ জুটি। মুজিব বাহিনীর অন্যতম সংগঠক ও স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগের প্রতিষ্ঠাতা তিনি। বাকশাল হলে শেখ মনি ১৫ সদস্য বিশিষ্ট নির্বাহী পরিষদে সদস্য হন অন্যতম সম্পাদক হিসাবে। বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার দিন তার বাসভবনও খুনীরা হামলা চালায়। এতে তিনি এবং তার অন্তঃ সত্তা স্ত্রী আরজু মনিও নিহত হন। ব্যারিস্টার ফজলে নূর তাপষ এমপি তার পুত্র। ১৯৬৩-১৯৬৫ মেয়াদে ছাত্রলীগের সভাপতি কে এম ওবায়দুর রহমান ও সাধারণ সম্পাদক সিরাজুল আলম খান।

ওবায়দুর রহমান

১৯৬৩-১৯৬৫ মেয়াদে ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলেন কে এম ওবায়দুর রহমান। তার সঙ্গে জুটি বেঁধে ছিলেন সিরাজুল আলম খান। ইতিহাসে দু’জনই বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব। তুখোড় রাজনীতিবিদ। কিন্তু আওয়ামী লীগে টিকে থাকতে পারেননি ওবায়দুর রহমান। তিনি ১৯৬৬ সালে আওয়ামী লীগের সমাজ কল্যাণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৭০ সালে জাতীয় পরিষদে ও স্বাধীনতার পর ‘৭৩ সালে জাতীয় সংসদ সদস্য হন। এরপর প্রতিমন্ত্রী হন। বঙ্গবন্ধু নিহত হবার পর খুনী মোশতাকের প্রতিমন্ত্রী হয়ে বিতর্কিত হয়ে পড়েন। জাতীয় চার নেতা হত্যা মামলার আসামী হয়েছিলেন মোশতাকের দোসর হিসাবে। আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে মোশতাক মন্ত্রিসভার অনেক সদস্যকে টেনে আনা হলেও কে এম ওবায়েদের জন্য তা নিষিদ্ধ ছিল। সামরিক শাসক জেনারেল জিয়াউর রহমান তাকে কাছে টেনে মন্ত্রী করেন। কিছুদিন পর অব্যাহতি দেন। জিয়া নিহত হলে বিচারপতি সাত্তার মন্ত্রিসভা গঠন করেন। কিন্তু তাতে স্থান পাননি তিনি। এরশাদের সামরিক আদালতে দুর্নীতির দায়ে কে এম ওবায়েদের ১৪ বছর জেল হলেও তা ভোগ করতে হয়নি। বেগম খালেদা জিয়া বিএনপির চেয়ারম্যান হলে কে এম ওবায়েদ মহাসচিব নিযুক্ত হন। ১৯৮৭ সালে তাকে এরশাদের সঙ্গে যোগসাজশের দায়ে বহিস্কার করা হয়। মন্ত্রী হওয়ার গুঞ্জণ গুজবে পরিণত হয়। জনতা দল নামে একটা দল গঠন করলেও ১৯’৯৬ সালের নির্বাচনের আগে বিএনপিতে ফিরে গিয়ে স্থায়ী কমিটির সদস্য পদ লাভ করেন। ২০০১ সালে বিএনপি সরকারে এলেও মন্ত্রী হতে পারেননি কে এম ওবায়দুর রহমান। তিনি পরলোকে।

“সিরাজুল আলম খান

বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের প্রবক্তা সিরাজুল আলম খান ১৯৬৩-১৯৬৫ সালে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। স্বাধীনতার নিউক্লিয়াস বলে খ্যাত এই নেতা মুজিব বাহিনীরও কান্ডারী ছিলেন। স্বাধীনতার পতাকা, স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র, বঙ্গবন্ধু ও জাতির পিতা ইত্যাদির নেপথ্যে মূল ক্রীড়নকের ভুমিকায় থাকা সিরাজুল আলম খান আওয়ামী লীগের কোন পদে ছিলেন না। স্বাধীনতার পর মুজিববাদ নয়, বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের ভিত্তিতে সর্বদলীয় সরকার গঠণের দাবি জানান তিনি। ছাত্রলীগের মুক্তিযুদ্ধে চারখলিফা খ্যাত ছাত্রনেতা ডাকসু ভিপি আসম রব ও ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শাহজাহান সিরাজের নেতৃত্বাধীন অংশ সিরাজুল আলম খানের মতবাদের প্রতি সমর্থন দেন। ছাত্রলীগের সভাপতি নূরে আলম সিদ্দিকী ও ডাকসু জিএস আব্দুল কুদ্দুস মাখন মুজিববাদের পক্ষে অবস্থানে ছাত্রলীগ ভেঙ্গে যায়। ১৯৭২ সালে গঠিত হয় সিরাজুল আলম খানের দর্শনেই জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল জাসদ। বঙ্গবন্ধু ও পরে জাতীয় চারনেতা নিহত হওয়ার পর খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে সামরিক অভ্যুত্থান হলে জাসদ ও কর্নেল তাহেরের নেতৃত্বে সিপাহী বিপ্লব সংঘটন করা হয়। জিয়াকে সরিয়ে সেনাপ্রধান হওয়া খালেদ নিহত হন। মোশতাককে সরিয়ে বিচারপতি সায়েমকে রাষ্ট্রপতি করেছিলেন খালেদ মোশাররফ। খালেদ নিহত হলে জিয়া সেনাপ্রধান পদে ফিরে ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হন। সিরাজুল আলম খানের জাসদীয় দর্শন বা তাহের ১২ দফা মানতে অস্বীকার করে জেনারেল জিয়া উল্টো তাহেরকে ফাঁসিতে ঝুলান এবং সিরাজুল আলম খান কারাদন্ড দেন সামরিক আদালতে। সিরাজুল আলম খান পরবর্তীতে রাজনীতির অদৃশ্য হয়ে যান। আজো রহস্যময় এক রাজনীতিবিদ বটে। ফেরদৌস কোরেশী

ফেরদৌস আহমেদ কোরেশী ও আব্দুর রাজ্জাক ও মাজহারুল হক বাকী ও আব্দুর রাজ্জাক জুটিও ছাত্রলীগের ইতিহাসে এক অনবদ্য চরিত্র। ফেরদৌস কোরেশী ছাত্রলীগের সভাপতি শুধু নন, ডাকসু’রও ভিপি ছিলেন।৬৫-৬৬ মেয়াদে। কোরশীও আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে স্থান পাননি। স্বাধীনতাপূর্বই তিনি বঙ্গবন্ধু ঘরণার বিরোধী। বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব হয়েছিলেন জেনারেল জিয়ার আমলে। বিগত ওয়ান ইলেভেনকালে তিনি আলোচনায় উঠে এসেছিলেন। নতুন এক পার্টি গঠনেরও দৌড়ঝাঁপ ছিল নিত্যদিনের মিডিয়ার খবর। কিন্তু ব্যর্থ হয়ে যায় তার সব পরিকল্পনা। যখন সেনাবাহিনী সমর্থিত ফখরুদ্দীনের সরকারের টু মাইনাস থিউরি ভেস্তে যায়। মাজহারুল হক বাকী

১৯৬৫-১৯৬৬ মেয়াদে ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলেন মাজাহারুল হক বাকী। বঙ্গবন্ধুর ছয় দফা আন্দোলনের তুখোড় নেতা হিসাবে সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রাজ্জাকের ন্যায় বলিষ্ঠ ভুমিকায় অবতীর্ণ ছিলেন বাকী। তাকে পরবর্তীতে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে দেখা যায়নি। আব্দুর রাজ্জাক বঙ্গবন্ধু যাকে আদর করে বলতেন “আমার রাজ্জাক” সেই রাজ্জাক ছাত্রলীগের দু’বার সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। স্বাধীনতার অন্যতম নিউক্লিয়াস আব্দুর রাজ্জাকই ছাত্রলীগের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকদের মধ্যে একমাত্র নেতা যিনি আওয়ামী লীগের দু’বার সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। একবার আব্দুল মালেক উকিলের সঙ্গে আরেকবার বঙ্গবন্ধু কন্যা শেং হাসিনার সঙ্গে। বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন।১৯’৮৩ সালে বাকশাল পুনরুত্থানের আগ পর্যন্ত আওয়ামী লীগ কার্যত রাজ্জাকেরই ১৪ শতাংশ সমর্থনপুষ্ট ছিল। ১৯৯২ সালে তিনি আওয়ামী লীগের সঙ্গে বাকশালকে একীভূত করে প্রেসিডিয়াম সদস্য হন। ২০০৯ সালে কাউন্সিলে আমির হোসেন আমু, তোফায়েল আহমেদ, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ও আব্দুল জলিল প্রমুখ নেতার ন্যায় প্রেসিডিয়াম থেকে ছিটকে পড়েন। অনেকটা নীরবে নিভৃতে না ফেরার দেশে চলে গেছেন জননেতা আব্দুর রাজ্জাক। আব্দুর রউফ

১৯৬৮-১৯৬৯ সালে ছাত্রলীগের সভাপতি হন আব্দুর রউফ। আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সুবিধা করতে পারেননি তিনি। ১৯৭৩ সালের ৭ মার্চের প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনী বিজয়ী হওয়ার পর হুইপ হয়েছিলেন উপমন্ত্রীর মর্যাদায়। বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পর খুনী মোশতাকেরও হুইপ হন ১৯৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানকালীন