জীবনের সর্বাবস্থায় রাসূলুল্লাহ (সা.)এর ‍সুন্নাহ অনুসরণ করতে হবে: আল্লামা মুফতি জসিমুদ্দীন

আপডেট: এপ্রিল ১৫, ২০২২
0

জামিয়া আহলিয়া দারুল উলূম মুঈনুল ইসলাম হাটহাজারী মাদ্রাসার সহকারী পরিচালক ও নূরানী তালিমুল কুরআন বোর্ড চট্টগ্রাম বাংলাদেশ-এর প্রতিষ্ঠাতা মহাসচিব আল্লামা মুফতি জসিমুদ্দীন বলেছেন, জীবনের সর্বাবস্থায় হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.)এর ‍সুন্নাহ অনুসরণ করতে হবে। এতেই মুমিন জীবনের দুনিয়া ও আখিরাতের জীবনে শান্তি ও কামিয়াবী নিহিত।

শনিবার (৯ এপ্রিল) বাদ ইশা দারুল উলূম হাটহাজারী মাদ্রাসার শিক্ষাভবনে অনুষ্ঠিত নূরানী তালিমুল কুরআন বোর্ড চট্টগ্রাম বাংলাদেশ কর্তৃক পরিচালিত মুআল্লিম প্রশিক্ষণ কোর্সে প্রশিক্ষণার্থী তরুণ আলেমদের উদ্দেশ্যে তিনি এসব কথা বলেন।
নূরানী তালিমুল কুরআন বোর্ড চট্টগ্রাম বাংলাদেশ কর্তৃক পরিচালিত দারুল উলূম হাটহাজারী মাদ্রাসা কেন্দ্রে মুআল্লিম প্রশিক্ষণ কোর্সে অংশগ্রহণকারীদের একাংশকে দেখা যাচ্ছে।

উল্লেখ্য, চলতি রমজানে নূরানী তালিমুল কুরআন বোর্ড চট্টগ্রাম বাংলাদেশ কর্তৃক দারুল উলূম হাটহাজারী মাদ্রাসা কেন্দ্রে পরিচালিত মুআল্লিম প্রশিক্ষণে প্রায় সাড়ে ছয়শত প্রশিক্ষণার্থী ভর্তি হয়েছেন। ১০ জন শিক্ষকের তত্ত্বাবধানে উক্ত প্রশিক্ষণ কোর্স ২৫ রমজান শেষ হবে।

প্রশিক্ষণার্থী মুআল্লিমদের উদ্দেশ্যে আল্লামা মুফতি জসিমুদ্দীন আরো বলেন, ইসলামের প্রতিটি বিধানই মানব কল্যাণের জন্য নির্ধারণ করা হয়েছে।গবেষণা করলে দেখা যাবে, ইবাদত-বন্দেগী থেকে শুরু করে ইসলামী বিধান ও নির্দেশণার সবকিছুই যদি মেনে চলা হয়, তাহলে জগতে শান্তি আর শান্তি বিরাজ করবে। কোথাও কোন জুলুম-অত্যাচার থাকবে না। অবিচার ও বেইনসাফি থাকবে না। সম্পদের সুষম বণ্টন নিশ্চিত হবে। মানুষের নিরাপত্তা ও মর্যাদা সমুন্নত থাকবে। আর ইসলামের বিধানকে চিনতে ও বুঝতে হলে রাসূল (সা.)এর সুন্নাহ সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন এবং সাহাবায়ে কেরামের জীবনী অধ্যয়ন করতে হবে।

তিনি বলেন, মহান আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনের সূরা আলে ইমরানের ৩১ নং আয়াতে ইরশাদ করেছেন, “হে রাসূল! (স.) আপনি বলুন! যদি তোমরা আল্লাহর ভালবাসা পেতে চাও, তবে আমার অনুসরণ কর। তাহলে আল্লাহ তোমাদেরকে ভালবাসবেন এবং তোমাদের গুনাহসমূহ মাফ করে দেবেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ ক্ষমাশীল ও দয়াময়”। আল্লাহতায়ালা সূরা হাশনের ৭নং আয়াতে ইরশাদ করেছেন, “রাসূল (স.) তোমাদের যা আদেশ দেন, তা তোমরা গ্রহণ কর এবং যা নিষেধ করেন তা থেকে তোমরা বিরত থাক”। সূরা নিসার ৮০নং আয়াতে তিনি আরো ইশাদ করেছেন, “যে রাসূলের (স.) আনুগত্য করল,সে যেন আল্লাহরই আনুগত্য করল। আর যে বিমুখ হল,আমি আপনাকে তাদের উপর তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে প্রেরণ করিনি”।

আল্লামা মুফতি জসিমুদ্দীন বলেন, পবিত্র কুরআনে সুন্নাহর অনুকরণ-অনুস্বরণের জন্য অত্যাধিক গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। পবিত্র কুরআন এ কথাও বলেছে,কেউ যদি সুন্নাহর অনুসরণ না করে,তবে তার ঈমান যথাযথ হবে না। মহান আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন,তোমার পালনকর্তার কসম! সে লোক ঈমানদার হবে না,যতক্ষণ না তাদের মধ্যে সৃষ্ট বিবাদের ব্যাপারে তোমাকে অর্থাৎ নবী (সা.)কে ন্যায়বিচারক বলে মনে না করে। অতঃপর তোমার মীমাংসার ব্যাপারে নিজের মনে কোন রকম সংকীর্ণতা পাবে না এবং তা সন্তুষ্টিচিত্তে তা কবুল করে নেবে।

হাদীসের উদ্ধৃতি দিয়ে আল্লামা মুফতি জসিমুদ্দীন বলেন, হযরত রাসূলুল্লাহ রাসূলুল্লাহ (স.)এর সুন্নাহ আঁকড়ে থাকার ব্যাপারে তিনি ইরশাদ করেছেন, আমি তোমাদের কাছে দু’টি জিনিস রেখে যাচ্ছি। যতক্ষণ তোমরা সে দু’টি জিনিস আঁকড়ে থাকবে, ততক্ষণ পথভ্রষ্ট হবে না। যথা- আল্লাহর কিতাব ও আমার সুন্নাহ।

আল্লামা মুফতি জসিমুদ্দীন উপস্থিত তরুণ আলেমদেরকে উদ্দেশ্য করে বলেন, আল্লাহ নিজ রহমতে আপনাদেরকে বাছাই করে দ্বীনি ইলম অর্জনের তাওফীক দান করেছেন। সুতরাং এই ইলমকে নিয়ামত হিসেবে গ্রহণ করে এর গুরুত্ব ও মর্যাদা দিতে হবে। নিজের জীবনকে আপনারা সুন্নাহ অনুযায়ী গড়ে তুলবেন। আর দ্বীনি তালিমকে নিজেদের লক্ষ্য হিসেবে স্থির করবেন। এতে দ্বীনি শিক্ষা বিস্তার, আদর্শ সমাজ ও দেশগড়ায় আপনাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত হবে। যাতে আপনাদের দুনিয়া ও আখিরাতের জীবন সম্মান ও মর্যাদাজনক হবে, ইনশাআল্লাহ।

তরুণ আলেমদের উদ্দেশ্যে আল্লামা মুফতি জসীমুদ্দীন বলেন, জীবন চলার পথে আপনারা সর্বক্ষেত্রে রাসূলুল্লাহ (সা.)এর সুন্নাতের পূর্ণ অনুসরণ করে চলবেন। গুরুত্বের সাথে জামাআতের সাথে নামায আদায় করবেন। দৈনিক কুরআন তিলাওয়াত করবেন। সকল উম্মতে মুহাম্মদীর ইহ-পরকালীন কল্যাণে নিজেদেরকে সদা নিয়োজিত রাখবেন। ইলমে ওহী এবং হুযূর (সা.)এর তরীক্বার প্রচার-প্রসারকে আল্লাহ তাআলার বিরাট এক নিয়ামত হিসাবে ধারণ করবেন, যে নিয়ামতের বিপরীতে জগতের সব কিছু নগন্য ও তুচ্ছ। সাধ্যমতো দেশ, জাতি ও উম্মাহর কল্যাণে কাজ করে যাবেন। পরিবার, প্রতিবেশী, আত্মীয়-স্বজন, সমাজের কল্যাণে সজাগ থাকবেন। যেখানেই থাকুন না কেন, দ্বীনি ইলমের প্রচার-প্রসারে কাজ করে যাবেন এবং দাওয়াত ও তাবলীগে সময় লাগাবেন। সুস্থির ও বুদ্ধিমত্তার সাথে পরিবেশ-পরিস্থিতি বুঝে দ্বীনি কাজ আঞ্জাম দিবেন।

এ পর্যায়ে আল্লামা মুফতি জসিমুদ্দীন তরুণ আলেমদের উদ্দেশে রাসূল (সা.)এর অন্তিম অসিয়তের উল্লেখ করে বলেন, হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.)এর সাহাবায়ে কেরামের প্রতি শেষ অসিয়ত ছিল তিনি ইরশাদ করেন, “আমি তোমাদেরকে আল্লাহ্কে ভয় করার এবং (তোমাদের আমিরের কথা) শোনার ও তাঁর অনুগত থাকার উপদেশ দিচ্ছি, হোক না সে ইমাম একজন হাবশী গোলাম। আমার পর তোমাদের মধ্যে যারা বেঁচে থাকবে, তাদের মধ্যে অল্প দিন পরই মতভেদ দেখতে পাবে। তখন তোমরা আমার হিদায়াত প্রাপ্ত খুলাফায়ে রাশিদীনের সুন্নাতকে আঁকড়ে ধরবে এবং তা দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরে রাখবে। অর্থাৎ- সুন্নাতের উপর খুব অটল ও অবিচল থাকবে। নবাবিষ্কৃত বিষয় থেকে বেঁচে থাকবে। কেননা, প্রত্যেক নবাবিষ্কৃত কাজই বিদআত এবং প্রত্যেক বিদআতই গোমরাহী”।

আল্লামা মুফতি জসিমুদ্দীন রাসূল (সা.)এর আরেকটি হাদীসের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, সাহাবী আবু যর (রাযি.) সূত্রে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি একবার হুযূর (সা.)এর দরবারে উপস্থিত হয়ে বললাম, হে আল্লাহর রাসূল (সা.)! আমাকে কিছু নসীহত করুন। তিনি বললেন, আমি তোমাকে আল্লাহ্কে ভয় করার উপদেশ দিচ্ছি। কেননা, তাঁর ভয়ই সকল কাজের সৌন্দর্য। আমি বললাম, আরও কিছু নসীহত করুন। তিনি বললেন, “কুরআন তিলাওয়াত ও আল্লাহর যিকরকে তোমার জন্য আবশ্যক করে নাও। কেননা, এর দ্বারাই আকাশে তোমার ব্যাপারে আলোচনা হবে এবং পৃথিবীতে হবে তোমার জন্য নূর”। প্রিয় নবী (সা.)এর এই নসীহতই আপনাদের জীবন পরিচালনার জন্য পথনির্দেশিকা হিসেবে যথেষ্ট মনে করি।

তিনি বলেন, আপনারা সাহাবা, তাবেয়ী, তবে-তাবেয়ী, মুহাদ্দেসীন, মুজতাহিদীন, আউলিয়ায়ে কেরাম, আকাবিরে দেওবন্দ ও আকাবিরে হাটহাজারী’র মাসলাকের সাথে গভীরভাবে জড়িত হওয়ায় আপনাদের কাঁধেও দাওয়াতের মহান দায়িত্ব এসে পড়েছে। এ দায়িত্ব যথাযথভাবে পালনের উদ্দেশ্যে এ ক্ষেত্রে আপনাদেরকে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের আদর্শকে আক্বীদা ও আমল, তথা জীবনের সর্বক্ষেত্রে শক্ত হাতে ধারণ করে চলতে হবে। আপনারা ইলমী দক্ষতা, খোদাভীতি, একনিষ্ঠতা, আল্লাহর উপর ভরসা ও সুন্নাত অনুসরণের মজবুত হাতিয়ার নিয়ে দেশ ও জাতির পথপ্রদর্শনে আত্মনিয়োগ করবেন। এবং তালিম, দাওয়াত ও তাবলীগ, ইমামত, বক্তৃতা-বিবৃতি, ওয়াজ-নসীহত ও ক্ষুরধার লেখনীর মাধ্যমে পথহারা এই জাতিকে পথের দিশা দান করবেন। মনে রাখবেন, এ পথ অমসৃণ ও অনেক কণ্টকাকীর্ণ। ধৈর্য, সহনশীলতা, দৃঢ়তা, গাম্ভীর্যতা, ত্যাগ-তিতীক্ষা ও সহমর্মিতা দ্বারা এসব বাধা অতিক্রম করতে হবে। পদদলিত করতে হবে যশ ও খ্যাতির লোভ লালসাকে। এতেই নিহিত রয়েছে সুদীর্ঘ এক যুগ ব্যাপী কঠোর সাধনার সার্থকতা। আপনারাই হচ্ছেন ভবিষ্যত জাতির কান্ডারী, দ্বীনের ধারক-বাহক। তাই আপনাদেরকে ইলম, আখলাকের প্রতিটি স্তর অতি মেহনত ও পরিশ্রমের মাধ্যমে অতিক্রম করতে হবে। দোয়া করি, মহান আল্লাহ আপনাদেরকে দেশ ও জাতির জন্য সঠিক পথপ্রদর্শক হিসেবে কবূল করুন।

বয়ান শেষে আল্লামা মুফতি জসিমুদ্দীন তরুণ আলেমদেরকে নিয়ে বিশেষ দোয়া-মুনাজাত পরিচালনা করেন।