ধোঁয়াবিহীন তামাকের ঝুঁকিতে নারী ও দরিদ্র মানুষঃ তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধনের বিকল্প নেই

আপডেট: সেপ্টেম্বর ২৪, ২০২৩
0

ড. মোঃ রফিকুল ইসলাম:

তামাকজাত দ্রব্য হিসেবে ধূমপানের ক্ষতির সঙ্গে আমরা সবাই কমবেশি পরিচিত হলেও ধোঁয়াবিহীন তামাকের ক্ষতিকর দিকের সাথে আমাদের পরিচিতি নেই বললেই চলে। ধোঁয়াবিহীন তামাকজাত দ্রব্য সাধারণত তামাক পাতা থেকে তৈরি, যা না পুড়িয়ে সরাসরি সেবন করা হয়, সেটা চিবিয়ে, মুখে রেখে দিয়ে বা নাক দিয়ে গন্ধ শুঁকে হতে পারে। এ সমস্ত দ্রব্য ব্যবহারকারীরা সাধারণত মুখে চিবিয়ে খান বা রেখে দিয়ে কিংবা পিকের সাথে রস খেয়ে ফেলে দেন। স্বাভাবিকভাবেই অন্যান্য তামাকদ্রব্যের মতোই ধোঁয়াবিহীন তামাকে নিকোটিন আছে এবং তা মুখের ভেতর দিয়ে শরীরে প্রবেশ করে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে ধোঁয়াযুক্ত তামাকের তুলনায় ধোঁয়াবিহীন তামাক ব্যবহারকারীর সংখ্যা যেমন বেশি, তেমনি ক্ষতির মাত্রাও অনেক অনেক বেশি। আর এই ধোঁয়াবিহীন তামাকের মূল ঝুঁকিতে রয়েছে দেশের নারী ও অর্থনৈতিক ভাবে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী। কিন্তু কেবল ধোঁয়া না ছড়ানোর কারনেই এই বিপুল ক্ষতির মাত্রা আমাদের অগোচরে থেকে যাচ্ছে। যা সামগ্রিক দিক থেকে জাতিকে পঙ্গু করে ফেলছে। বাংলাদেশসহ অন্যান্য দক্ষিণ এশীয় দেশগুলিতে ঐতিহ্যগতভাবে সামাজিক রীতিনীতি ও সংস্কৃতি তরুণ এবং মহিলাদের ধূমপানের পক্ষে নয়। তবে ধোঁয়াবিহীন তামাকজাত পণ্য যেমন জর্দা, গুল, সাদাপাতা বা আলাপাতা, পান মসালা এবং খইনির মত তামাকজাত দ্রব্যের বিরুদ্ধে এমন কোন বিধিনিষেধ নেই। দৈনন্দিন জীবনযাত্রা, সামাজিক উত্সব এবং বিয়েসহ সবধরনের অনুষ্ঠানগুলোতে ধোঁয়াবিহীন তামাককে স্বাভাবিক ভাবে গ্রহণ করা হয়। যা নীরব ঘাতক হিসেবে কাজ করছে দেশের স্বাস্থ্য খাতে। ধোঁয়াবিহীন তামাকের এই প্রবল আঘাত রুখতে হলে আমাদেরকে জনসমক্ষে এবং দেশের নীতিনির্ধারকদের সামনে এর ক্ষতিকর দিক তুলে ধরে প্রয়োজনীয় আইনি ব্যবস্থা নিতে হবে।

২০২১ সালের বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ধোঁয়াহীন তামাক পণ্য সবচেয়ে কম দামে পাওয়া দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ তৃতীয়। এসবের মধ্যে ২০৪০ সাল নাগাদ বাংলাদেশকে তামাকমুক্ত করার ঘোষণা দিয়েছে সরকার। তামাকের যে ভয়াবহ স্বাস্থ্যঝুঁকি, মূলত সেটা মাথায় রেখেই এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি তামাকের স্বাস্থ্যঝুঁকি বলতে আমাদের প্রথমেই ধূমপানের কথাই মাথায় আসে এবং ধূমপানকে কেন্দ্র করেই মূলত তামাক বিরোধী কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়। ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ আইন ২০১৩ (সংশোধনী) তে প্রথমবার ধোঁয়াবিহীন তামাককে চিহ্নিত করা হয়। ফলে সহসাই বোঝা যাচ্ছে আমরা এই বিষয়ে কতটা পিছিয়ে ছিলাম এবং আছি। এ কারণেই আমাদের অগোচরে রয়ে যাচ্ছে তামাকের সবচেয়ে বড় ভয়াবহ ক্ষতি যা মূলত ধোঁয়াবিহীন তামাকের কারনে হচ্ছে। ধোঁয়াবিহীন তামাক থেকে প্রতিনিয়ত তৈরি হচ্ছে নানান স্বাস্থ্য জটিলতা। মানুষ বিভিন্ন মারাত্বক রোগে আক্রান্ত হচ্ছে এবং ঘটছে মৃত্যুর ঘটনা। যা দেশের অর্থনৈতিক ভাবে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী এবং বিশেষ করে নারীদেরকে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রেখেছে। বাংলাদেশে ধোঁয়াবিহীন তামাক ব্যবহারের ক্ষেত্রে নারীদের ভয়াবহ চিত্র তামাক বিরোধী নারী জোট- তাবিনাজ এর জরিপে স্পষ্ট ভাবে উঠে এসেছে। বাংলাদেশে ধূমপান করে ২ কোটি ১৯ লক্ষ মানুষ তার তুলনায় ধোঁয়াবিহীন তামাক সেবন করে ২ কোটি ৫৯ লক্ষেরও বেশী মানুষ এবং দুঃখজনক ভাবে ১ কোটি ৩৪ লক্ষ নারী ধোঁয়াবিহীন তামাক ব্যবহার করে। তাবিনাজ করা জরিপের তথ্যমতে, বাংলাদেশে ধোঁয়াবিহীন তামাক ব্যবহারকারীদের মধ্যে হাজারে পুরুষের সংখ্যা ৬৩, যেখানে নারীর সংখ্যা ৩৭৯। গ্লোবাল ইয়ুথ টোব্যাকো সার্ভে ২০১৩ অনুযায়ী, বাংলাদেশে ১৩ থেকে ১৫ বছরের শিশুদের মধ্যে ধূমপায়ী ২ দশমিক ৯ শতাংশ এবং ধোঁয়াবিহীন তামাক ব্যবহারকারী ৪ দশমিক ৫ শতাংশ। নিঃসন্দেহে এ পরিস্থিতি উদ্বেগজনক।

ধোঁয়াবিহীন তামাকে প্রায় দুই হাজারের মতো রাসায়নিক পদার্থ থাকে, যা মরণব্যাধি রোগ ডেকে আনে। ধোঁয়াবিহীন তামাক মুখের ক্যানসার, খাদ্যনালী ক্যান্সার এবং অগ্ন্যাশয় ক্যান্সার, হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোকসহ অনেক জটিল রোগের কারণ। এ ছাড়াও অকাল গর্ভপাত, সন্তান জন্ম দেয়ার সময় জটিলতা, জন্মের সময় ওজন কম হওয়া এবং মায়ের মৃত্যুসহ নানাবিধ সমস্যার জন্য দায়ী এসব তামাক। যারা এসব পণ্য ব্যবহার করেন, তাঁদের অনেকেই জানেন না এটা কতটা ক্ষতিকর বা এ থেকে শরীরের কী কী সমস্যা হতে পারে। এটা মূলত ধোঁয়াবিহীন তামাকের ভয়াবহ ক্ষতিকর দিক এবং এর বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রচারের অভাবেই হচ্ছে। ধোঁয়াবিহীন তামাক ব্যবহার নারী, শিশু, মধ্যবয়সী, বয়স্ক ব্যক্তিদের মধ্যে, এবং অশিক্ষিত ও অর্থনৈতিক ভাবে পিছিয়ে থাকা জনগোষ্ঠীর সাথে জড়িত। প্রধানত নারী এবং বিশেষ করে গরীব মানুষের মধ্যে ধোঁয়াবিহীন তামাক ব্যবহারের প্রবণতা অত্যন্ত বেশি। মূলত ধোঁয়াবিহীন তামাকের দামও অনেক কম এবং সহজেই হাতের নাগালে পাওয়া যায় বলে নারীদের মধ্যে বিশেষ করে গ্রামের দরিদ্র এবং অশিক্ষিত নারীরা এতে সবচেয়ে বেশি আসক্ত। বাজারে সর্বনিম্ন ৫ টাকা থেকেই শুরু হয় এসব পণ্যের দাম। আর নাগালের মধ্যেই দাম থাকায় এসমস্ত পণ্য খুব সহজে চলে যাচ্ছে গরীব মানুষের হাতে। তামাক পাতা প্রক্রিয়াজাত করে সাদা পাতা তৈরী করে বাজারে বিক্রয় করা হয়। এ পাতা কোন কারখানায় উৎপাদিত হয় না। এ পর্যন্ত সাদা পাতা বিক্রয়ের উপর কোন করারোপও করা হয়নি। তাই এটি অনেক সস্তা। অন্যান্য পণ্য যেমন গুল-জর্দার ক্ষেত্রেও নুন্যতম কর আরোপ করা হয়েছে। কিন্তু দেশ জুড়ে অগণিত কারখানা এইসব করের বাইরে থাকছে এবং যারা কর দিচ্ছে তারা খুবই সামান্য কর দিচ্ছে। বেশির ভাগ জর্দা এবং গুলের প্যাকেটে রাজস্ব আদায় নির্ধারণী কোন চিহ্নই নেই যা রাজস্ব ফাঁকির বড় প্রমাণ। এছাড়াও, এসব পন্যের নানান ধরনের ব্যবহার, প্যাকেটের ধরণ ও মাপের ভিন্নতা নানান ভাবে এরা কর ফাঁকি দিয়ে থাকে। আবার এসব কারখানায় অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে মূলত নারী ও শিশুরা চরম স্বাস্থ্য ঝুঁকির মধ্যে কম বেতনে কাজ করে। যা নজর এড়িয়ে যাচ্ছে সবার। এই পণ্যগুলি নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে অন্যতম প্রধান চ্যালেঞ্জ হচ্ছে তাদের কম কর এবং ফলস্বরূপ কম দাম এবং উপযুক্ত নজরদারি। এইভাবে ধোঁয়াবিহীন তামাক শিশু-কিশোর, নারী এবং গরীব মানুষের কাছে সহজ আসক্তি হিসেবে গ্রহণযোগ্যতা পাচ্ছে। ধোঁয়াবিহীন তামাকের ব্যবহার গরিবদের মধ্যে বেশী হওয়ায় কর আরোপের মাধ্যমে দাম বৃদ্ধি করে ব্যবহার কমানো অত্যন্ত জরুরী।

বাংলাদেশে প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে ধোঁয়াবিহীন তামাক ব্যবহারের উচ্চ প্রবণতা থাকা সত্ত্বেও, তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন এবং করের ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত গুরত্ব দেয়া হয়নি। বাংলাদেশে ধোঁয়াবিহীন তামাক ব্যবহারের তথ্য নীতিনির্ধারণ এবং কার্যকর নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা বাস্তবায়ন করার জন্য পর্যাপ্ত কাঠামো নেই। ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ (সংশোধন) আইন, ২০১৩ এর ধারা অনুযায়ী, সব তামাকজাত দ্রব্যের প্যাকেট, মোড়ক, কার্টন বা কৌটার উভয় পার্শ্বে মূল প্রদর্শনী তলের উপরিভাগে অন্যূন শতকরা পঞ্চাশ ভাগ পরিমাণ স্থান জুড়ে তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহারের কারণে সৃষ্ট ক্ষতি সম্পর্কিত রঙিন ছবি ও লেখা সম্বলিত স্বাস্থ্য সতর্কবাণী মুদ্রণ করা বাধ্যতামূলক। কিন্তু ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানগুলো নানান ভাবে পণ্যের মোড়কে সচিত্র সতর্কবার্তা আরো ছোট করে দেখায় এবং এমনভাবে সেটি থাকে যা বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই চোখেই পড়ে না। যার ফলে ভোক্তারা সচেতন হতে পারছে না এবং বাড়ছে মৃত্যুর হারও। দিনশেষে ধোঁয়াবিহীন তামাক আমাদের দৃষ্টির আড়ালেই থেকে যাচ্ছে আর নীরব ঘাতক হয়ে শেষ করছে দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে। যার প্রভাব পড়ছে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ওপর, স্বাস্থ্য খাতে এবং সামগ্রিক ভাবে দেশের উন্নয়নে। তামাকবিরোধী সংগঠনগুলোর পরিসংখ্যানে অনুসারে, বাংলাদেশে ধোঁয়াবিহীন তামাক পণ্য ব্যবহারকারীর সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। ক্রমাগত ভাবে দ্রুত বৃদ্ধি পাওয়া এই আসক্তি দেশের স্বাস্থ্য খাতের জন্য চরম হুমকি বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। আর এ কারণেই তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধন করে বিড়ি-সিগারেটের সিঙ্গেল স্টিক বা খুচরা শলাকা এবং প্যাকেট ছাড়া বা খোলা ধোঁয়াবিহীন তামাকপণ্য বিক্রয় নিষিদ্ধ করা এবং সব ধরনের পণ্যে কর বৃদ্ধি বিশেষ করে ধোঁয়াবিহীন তামাকেও কর বৃদ্ধির দাবি জানিয়েছে তামাক বিরোধী সংগঠনগুলো ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। তামাকমুক্ত দেশ গড়তে চাইলে সবার আগে ধোঁয়াবিহীন তামাককে না বলতে হবে। আর ধোঁয়াবিহীন তামাকের যে বহুল-বিস্তৃত ব্যবহার তা কমিয়ে আনার জন্য তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের সংশোধনের বিকল্প নেই।

লেখকঃ ড. মোঃ রফিকুল ইসলাম

পরিচালক, স্বাস্থ্য সুরক্ষা ফাউন্ডেশন

সহযোগী অধ্যাপক, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়